আল্লাহকে পেতে হলে হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করা জরুরি

আল্লাহকে পেতে হলে হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করা জরুরি

ড. পিয়ার মোহাম্মদ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত দিক নির্দেশনা এবং হযরত রাসুল (সা.) এর জীবনাচার মিলেই ইসলাম পরিণত হয়েছে একটি পরিপূর্ণ জীবনাদর্শে। অথচ হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করার বিষয়ে অনেকের মধ্যেই উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ বলে থাকে আল্লাহ্ আমাদের মালিক, কাজেই তাঁর নির্দেশনা পালন করলেই চলে। তারা ভেবে দেখে না, মানব জাতিকে মহান আল্লাহ্ নিজেই নির্দেশনা দিয়েছেন হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করে চলার জন্য। হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করে চলার অর্থই আল্লাহর নির্দেশনা পালন করা। প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনাচার হলো আল-কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালনার এক জীবন্ত উদাহরণ। সেজন্য আল্লাহর রাসুলকে অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করতে পারলেই মহান আল্লাহর নাজিলকৃত পবিত্র কুরআনের বিধানমতে জীবন পরিচালনা করা হয়।

মহান আল্লাহ্ মানব জাতিকে তাঁর প্রিয় রাসুল কুল কায়েনাতের রহমত বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে আনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে রাসুল (সা.)! আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তবে আমার অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেবেন। আল্লাহ্ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩১) পরের আয়াতে তিনি হযরত রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের বাইরে গেলে কী হবে তাও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। ঘোষণা হয়েছে- “হে রাসুল (সা.)! আপনি বলে দিন, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং রাসুলের। তবে যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে জেনে রেখো আল্লাহ্ কাফেরদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আলে ইমরান ৩: আয়াত ৩২) এতে বুঝা যায় যে বিশ্বনবির অনুসরণ ও আনুগত্যের মধ্যেই আল্লাহর আনুগত্যের শামিল। হযরত রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের মাধ্যমেই আল্লাহর আনুগত্য করা যায় এবং বিশ্বনবির অনুসরণই মহান আল্লাহর ভালোবাসা লাভের পূর্বশর্ত।

মহান আল্লাহ্ রাসুল (সা.)-কে সারা জাহানের মানুষের জন্য প্রেরণ করেছেন। তাঁকে অনুসরণ করা সবারই দায়িত্ব। তাঁকে অনুসরণ করার মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের মুক্তির পথ। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে সাহাবায়ে কেরামের জনসমুদ্রে মানবতার মুক্তির দূত মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন- আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটিকে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কোনো ধরনের পথভ্রষ্টতা তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না; একটি হলো, আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি হলো- তাঁর রাসুলের আহলে বাইত। এ প্রসঙ্গে হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- “আমি তোমাদের কাছে এমন দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি সে সব ধারণ করে রাখো, তবে আমার পরে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর এ দু’টির মধ্যে একটি জিনিস অপর জিনিসটির চেয়ে মহান আর সেটি হলো- আল্লাহর কিতাব। আকাশ থেকে জমিন পর্যন্ত বিস্তৃত এক সুদৃঢ় রজ্জু। আর আমার পরিবার- আমার আহলে বাইত। হাউজে কাওসারে আমার কাছে আগমন করা পর্যন্ত এঁরা আর কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমরা লক্ষ্য রাখবে এঁদের (আমার আহলে বাইতের) বিষয়ে তোমরা আমার পর কীরূপ ব্যবহার করছ।” (তিরমিযী শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১৯; ই.ফা.বা. কর্তৃক অনূদিত তিরমিযী শরীফ ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৩) সুতরাং আমাদের সামগ্রিক কামিয়াবির জন্য আল-কুরআনের নির্দেশনার পাশাপাশি হযরত রাসুল (সা.)-এর আহলে বাইতকে এবং হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনাদর্শকে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করে নিতে হবে। প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে তাঁর জীবনাচারকে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে চলতে হবে।

মহান আল্লাহ্ তাঁর জিকিরকারি বান্দাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন- “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও শেষ বিচারের দিনকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে, তাদের জন্য অবশ্যই উত্তম আদর্শ রয়েছে রাসুলুল্লাহর মধ্যে।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ২১) অর্থাৎ আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করতে হলে হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করতে হবে। বিশ্বনবিকে ভালোবাসা এবং তাঁকে অনুসরণ করা মু’মিন হওয়ার পূর্বশর্ত। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- হযরত রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও অন্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি ভালো না বাসবে, সে মু’মিন হতে পারবে না।” (বোখারি শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭ এবং মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯) এ বিষয়ে আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেছেন- “রাসুল (সা.)-কে যে যতটুকু ভালোবাসতে পারবে, সে ততটুকু ইমানদার।” কাজেই ইমানের অধিকারী হতে হলে রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে তাঁকে অনুসরণ করে জীবন পরিচালনা করতে হয়।

হযরত রাসুল (সা.) হলেন- গোটা মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় এক মহত্তম আদর্শ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই তাঁর আদর্শ উন্মুক্ত ও অবারিত; যে কেউ তাঁকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুসরণ করে স্বীয় সামগ্রিক পরিমণ্ডলকে বরকতময় করতে পারে। মহান আল্লাহর পরেই মর্যাদার দিক থেকে কুল কায়েনাতের শিরোমণি হচ্ছেন মহানবি (সা.); তাই তাঁকে সর্বাবস্থায় সবারই উচিৎ হবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁর উচ্চ মাকামের প্রতি খেয়াল রাখা এবং তাঁকে অনুসরণ করা। হযরত রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসার মাধ্যমেই মুক্তি অর্জন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন- “কোনো মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর জন্য এ অবকাশ নেই যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল যখন কোনো কাজের নির্দেশ দেন, তখন সে কাজে তাদের কোনো নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করলে, সে তো প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৩৬) এ বিষয়ে হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে অবস্থান করবে।” (তিরমিজি শরিফ)। কাজেই এশকে রাসুল এবং এশকে এলাহি অর্জন করতে হলে অবশ্যই হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। এশকে রাসুল অর্জন করার প্রধান শর্ত আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব অন্তরে সৃষ্টি করা এবং মনে প্রাণে রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ করা।

বিশ্বনবি হযরত মোহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল ছিলেন। তিনি বিবাদ পছন্দ করতেন না। চেষ্টা করতেন সবার সাথে সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতে। আমাদেরও হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণের মাধ্যমে সে চরিত্র অর্জন করতে হবে। এ ব্যপারে মহান আল্লাহর নির্দেশনা হলো- “তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সূরা আনফাল ৮: আয়াত ৪৬) মহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ থেকেও বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে- “অতএব যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন সতর্ক হয় যে, তাদের উপর বিপর্যয় আপতিত হবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক আজাব তাদেরকে গ্রাস করবে।” (সূরা নূর ২৪: আয়াত ৬৩) এতে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করার বিকল্প নেই। আর সেটিই হলো সহজ ও সোজা পথ।

জীবনের সফলতা পেতে হলে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শের পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। তাঁর আদর্শ বাদ দিয়ে অন্য কারো আদর্শ অনুসরণ করে জীবনে সফল হওয়া যাবে না। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে।” (সূরা আহযাব ৩৩: আয়াত ৭১) জান্নাত প্রাপ্তির পূর্বশর্ত হিসেবে হযরত রাসুল (সা.)-এর অনুসরণের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আরো এরশাদ হয়েছে- “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে বেহেশতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত হয়; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এ হলো বিরাট সাফল্য।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ১৩) হযরত রাসুল (সা.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে সবার জন্য অনুসরণীয়, অনুকরণীয় ও মুক্তির কাণ্ডারী হিসেবে। সেজন্য মহান আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তি মহানবির প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের উপর নির্ভরশীল।

মহান আল্লাহ্ বলেন- “রাসুল তোমাদের যা দেন, তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো। আর ভয় করো আল্লাহকে। নিশ্চয় আল্লাহ্ কঠোর শাস্তিদাতা।” (সূরা হাশর ৫৯: আয়াত ৭) এতে বুঝা যায়, হযরত রাসুল (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনে আল কুরআনে যত নির্দেশনা এসেছে এবং তার সাথে হযরত রাসুল (সা.) নিজের বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে যেসব কাজ করেছেন, তা সবাইকে নিজের পরিমণ্ডলে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাতেই নিশ্চিত হবে মহান আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। এ আনুগত্যের বিষয়ে আরো এরশাদ হয়েছে- “হে ইমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসুলের এবং তাদের, যারা তোমাদের মধ্যে ফয়সালার অধিকারী। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে মতভেদ করো, তবে তা প্রত্যর্পণ করো আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রতি- যদি তোমরা ইমান এনে থাকো আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি। আর এটাই উত্তম এবং পরিণামে কল্যাণকর।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৫৯) এতে বুঝা যায়, পার্থিব জীবনে কোনো মতভেদ দেখা দিলে আল্লাহ্ ও রাসুলের দেওয়া দিক নির্দেশনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। হযরত রাসুল (সা.)-এর কোনো ফয়সালা, নিয়মাবলি ও কার্যাবলির ব্যাপারে সামান্যতম কোনো ভিন্নতর মনোভাব পোষণ করলে তারা মু’মিন হিসেবে গণ্য হবে না। মহান আল্লাহ্ বলেন- “তবে না; আপনার রবের কসম! তারা মু’মিন হবে না, যে পর্যন্ত তারা আপনার উপর বিচারের ভার অর্পণ করে সেসব বিবাদ-বিসম্বাদের, যা তাদের মধ্যে সংঘটিত হয়, তারপর তারা নিজেদের মনে কোনোরূপ দ্বিধা-সংকোচ বোধ না করে আপনার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৬৫)

অন্যত্র এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করলো সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে, আমি তো আপনাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাইনি।” (সূরা আন নিসা ৪: আয়াত ৮০) কাজেই কেউ যদি রাসুল (সা.)-কে বাদ দিয়ে জীবনের কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করে, তবে তা আল্লাহর দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। মানব জীবনের সকল স্তরে যদি আল্লাহ্ নির্দেশিত এবং রাসুল (সা.) প্রদর্শিত নির্দেশাবলির প্রতিফলন না ঘটে, তবে তা হবে আনুগত্যহীন কাজ এবং তা এক পর্যায়ে মানুষকে কুফরির দিকে নিয়ে যায়। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্যের মধ্যেই আল্লাহর রহমত পাওয়ার নিশ্চয়তা বিদ্যমান। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ্ আরো বলেন- “তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো, যেন তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।” (সূরা নূর ২৪: আয়াত ৫৬)

হযরত রাসুল (সা.)-এর অবাধ্যতা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কারণ। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন- “আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।” (সূরা জ্বিন ৭২: আয়াত ২৩) আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য না করা আমল বরবাদ হওয়ার কারণ; আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-“হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর এবং রাসুলের আনুগত্য করো, আর তোমরা তোমাদের আমলগুলো বিনষ্ট করো না।” (সূরা মোহাম্মাদ ৪৭: আয়াত ৩৩) আল্লাহ্ তায়ালা ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য না করলে ফিতনা ও শাস্তি অবতীর্ণ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- “কাজেই যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে তারা সতর্ক হোক যে বিপদ বা বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা নূর ২৪: আয়াত ৬৩) হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শের প্রতি বিরাগভাজন হওয়া ধর্ম থেকে বের হয়ে যাওয়ার শামিল। হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন- “যে আমার আদর্শের প্রতি বিরাগভাজন হয় সে আমার দলভুক্ত নয়।” (মুসলিম ও বুখারি শরিফ)।

মু’মিনের জীবনে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। মহব্বতে রাসুল তো ইমানের রুহ, মু’মিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই এশক ও মহব্বত ছাড়া না ইমানের পূর্ণতা আসে, আর না তার স্বাদ অনুভুত হয়। আর নিছক ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, বরং পার্থিব সমস্ত কিছুর উপর এ ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হবে। ভালোবাসার সার কথা হচ্ছে, আমি যাকে ভালোবাসি তাঁর চিন্তা-চেতনা, চাওয়া-পাওয়ার সাথে একাত্ম থাকা। ভালোবাসা হলো- প্রেমাস্পদের সাথে সর্বাবস্থায় একাত্ম থাকা। সুতরাং হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি মহব্বতের প্রকাশ হচ্ছে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর জীবনাচার অনুসরণ করা। যদি তা অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে মহব্বতের দাবি করা অযৌক্তিক।

যে যাকে ভালোবাসে সে তার কথা বেশি বলে। বার বার তার আলোচনা করতে থাকে। সুতরাং রাসুল প্রেমিকের কাজই হবে তাঁর আনুগত্য, আর শ্বাস-প্রশ্বাস হবে তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ। সে যত বেশি তাঁর স্মরণ করবে ততই তার অন্তরে তাঁর প্রতি মহব্বতের প্লাবন প্রবাহিত হতে থাকবে। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করার জন্য আল্লাহ্ পাক নির্দেশ দিয়েছেন- “নিশ্চয় আল্লাহ্ স্বয়ং ও তাঁর ফেরেশতারা নবির উপর দরূদ পাঠ করেন, হে মু’মিনগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরূদ পড়ো এবং শ্রদ্ধার সাথে সালাম পেশ করো।” (সূরা আল আহযাব ৩৩: আয়াত ৫৬)

মহান আল্লাহ্ পাকের নৈকট্য লাভের পথ একটিই আর তা হলো- হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা। তাঁর আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা। এ কারণেই মহান আল্লাহ্ হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসাকে অত্যাবশ্যক করে দিয়েছেন। হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ছাড়া ইমান পরিপূর্ণ হয় না। হযরত রাসুল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসার আলামত হলো তাঁর অনুসরণ করা। পরম করুণাময় আল্লাহ্ নবি রাসুলদের মাধ্যমে যে ধর্ম বা জীবন বিধান মানব জাতির জন্য নাজিল করেছেন, তা যথাযথভাবে মেনে চলার মধ্যেই ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নিহিত। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সবার জীবন পরিচালনা করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে, ইবাদত হলো আল্লাহ্ ও রাসুল (সা.)-এর মর্জি মোতাবেক কাজ করা।

হযরত রাসুল (সা.)-এর বরকতেই এ পৃথিবীতে অসংখ্য মাখলুকাত সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বিশ্বের সর্বকালের সর্ব যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং তাঁর আবির্ভাব না হলে আমরা কোনো কিছুই পেতাম না। কালেমা তাইয়্যাবাতে মহান প্রভুর নামের সাথে হযরত রাসুল (সা.)-এর নাম সংযুক্ত আছে। এতে বুঝা যায় শুধু মহান আল্লাহর প্রতি ইমান আনাই যথেষ্ট নয়, বরং হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতিও ইমান আনা জরুরি। আমাদের মহান মোর্শেদ সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) বলেছেন- “হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং তাঁকে অনুসরণ করা ছাড়া কারো মুক্তি নেই। দয়াল রাসুলকে অনুসরণ করলে মহান আল্লাহ্ খুবই খুশি হন। আল্লাহ্ তায়ালা কারো উপর খুশি হলে তার আর চিন্তা কী?” আসলে বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণ এতই তাৎপর্যপূর্ণ যে, কোনো মানুষ যদি আন্তরিকভাবে এ কাজটি করেন, তাহলে মহান আল্লাহ্ তার প্রতি অত্যন্ত সদয় হন এবং অবারিত রহমত দান করে থাকেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবকে ভালোবাসেন এবং তিনি চান সৃষ্টিকুল তাঁকে ভালোবাসুক এবং তাঁকে অনুসরণ করুক। সেজন্য হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করার অর্থ আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা।

ইমান বা বিশ্বাস হচ্ছে ভালোবাসার বীজ। মহান আল্লাহ্ এ ভালোবাসার বীজকে অঙ্কুরিত ও বিকশিত করেন এবং ভালোবাসার প্রবৃদ্ধি ঘটান। আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করতে হয়। হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করা যে কত প্রয়োজন, তা মহান আল্লাহ্ বারবার স্পষ্ট করে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করতে না পারলে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব নয়। হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করেই মহান আল্লাহর ভালোবাসার দরজায় হাজির হওয়া যায়। আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বশেষ নবি ও রাসুল। তাঁর তিরোধানের পর থেকে শুরু হয়েছে বেলায়েতের যুগ। হযরত রাসুল (সা.)-এর ধর্ম এ বেলায়েতের যুগে অলী-আল্লাহগণ প্রচার করে যাচ্ছেন। তাঁদেরকেও ভালোবাসা এবং অনুসরণ করা প্রয়োজন। হযরত রাসুল (সা.) বলেন- “আনা খাতামুন নাবিয়্যিন” অর্থাৎ আমি শেষ নবি। (মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৪৮) অন্যত্র সাহাবিদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- “শায়েখ তাঁর পরিবার তথা সম্প্রদায়ের মাঝে ঐরূপ, নবি তাঁর উম্মতের মাঝে যেরূপ।” (তাফসীরে মাজহারী ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১৮) এর অর্থ হযরত রাসুল (সা.)-এর পরবর্তী এ বেলায়েতের যুগে নায়েবে রাসুল অলী-আল্লাহগণ মোর্শেদরূপে দায়িত্ব পালন করবেন। এ যুগে অলী-আল্লাহগণের নিকট গিয়ে প্রেমের শিক্ষা গ্রহণ করে তাঁদের অনুসরণ করার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর রহমত পাওয়া যাবে।

মোহাম্মদী ইসলামের আদর্শ-চরিত্র ও প্রেম বিলিয়ে দেওয়ার জন্য সূফী সম্রাট হযরত সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা (রহ.) হুজুর কেবলাজান প্রেরিত হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “যে রাসুলকে ভালোবাসে এবং তাঁকে অনুসরণ করে, সেই আশেকে রাসুল।” তিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের আহ্বান করে বলেছেন, “হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করলে এবং ভালোবাসলেই আমরা সফলকাম হতে পারব।” সূফী সম্রাট জোরালোভাবে ঘোষণা করেন- “ইসলামের প্রকৃত স্বাদ সেই পায় যার নিকট মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা সবার ঊর্ধ্বে।” তাঁর এ প্রেমের বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়েই সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ এখন আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রেমে মগ্ন হয়ে মোরাকাবা করে সফল হচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রেম যেখানে অনুপস্থিত সেখানে আল্লাহ্, রাসুল ও মোর্শেদ অনুপস্থিত। হৃদয় প্রেমের কুঞ্জবনেই আল্লাহ্, রাসুল ও মোর্শেদ বাসা বাঁধেন। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকুল, নবি-রাসুলগণ এবং অলী-আল্লাহগণকে ভালোবাসেন। আমাদেরও তেমনই উচিত আল্লাহ্, রাসুল ও মহামানবগণের প্রেমে মগ্ন হয়ে তাঁদের নির্দেশিত পথে চলা এবং তাঁদের অনুসরণ করা।

আল কুরআনের নির্দেশনা ছাড়াও হযরত রাসুল (সা.) যে সব নির্দেশনা দিয়েছেন, সেগুলোও পালন করা আমাদের জন্য আবশ্যক। কেননা হযরত রাসুল (সা.) আল্লাহর নির্দেশনার বাইরে কিছুই বলতেন না বা করতেন না। মনে রাখতে হবে যে, আল কুরআনে বর্ণিত বিধিনিষেধ ছাড়াও ইবাদত সম্পর্কে হযরত রাসুল (সা.) যা করেছেন, করতে আদেশ দিয়েছেন এবং নিজে বাস্তবে পরিণত করে দেখিয়েছেন তার সবই আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশে ওহির মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছেন। সেজন্য এটা অনস্বীকার্য যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ ব্যতীত ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ সঠিকভাবে পালন, আল কুরআনের বিধিনিষেধ মানা এবং জীবনাদর্শের পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। হযরত রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করা উম্মতের জন্য আবশ্যিক দায়িত্ব। এ ব্যপারে সবারই সচেতন হওয়া দরকার।

সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান বলেছেন ইসলাম চর্চার মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সফলকাম হতে হলে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়া এবং তাঁকে অনুসরণ করার বিকল্প নেই। সবার প্রতি বিশ্বনবির যে আহ্বান, সে আহ্বানে সাড়া দিতে পারলেই আমাদের জীবনে সফলতা আসবে।

মহান সংস্কারক সূফী সম্রাট হযরত দেওয়ানবাগী (রহ.) হুজুর কেবলাজান এভাবে মানুষের মাঝে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রচারিত ধর্মের নির্দেশনাগুলো অনুশীলনের পন্থা শিক্ষা দিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-কে সত্যিকারভাবে অনুসরণ করার তাগিদ দিয়ে গেছেন। তিনি বলতেন- “যে কাজের প্রতি হযরত রাসুল (সা.)-এর সমর্থন আছে সেটাই ইসলাম এবং সেটা অনুসরণ করে চলাই মুক্তির একমাত্র পথ।” তাঁর মতে মোহাম্মদী ইসলামের নির্দেশনা হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশনা যারা পালন করে, তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করা সম্ভব। মোহাম্মদী ইসলাম রাসুল (সা.)-এর মহানুভবতাপূর্ণ নির্দেশনার শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র যেখানে মানুষ পেতে পারে শান্তি। মহান আল্লাহ্ আমাদের রাসুল (সা.)-কে পুর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর সেই মোহাম্মদী ইসলাম চর্চা করে সফলকাম হওয়ার সুযোগ করে দিন। আমিন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *