সারা বিশ্বের মতই করোনার লকডাউনে ধুকছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ। কলকারখানা-দোকানপাট বন্ধ। বন্ধ চুল কাটার সেলুন থেকে শুরু করে মাল্টি গ্রুপ অব কোম্পানি। আর এমন অবস্থায় অনেকেই রয়েছেন অর্থের অভাবে। নিম্নবিত্তের কিছু মানুষ সাধারণ ডাল-ভাত যোগাড় করতে পারছেন না। সেখানে চিকিৎসা খাতের কাজ ঠিকমত পরিচালনা হয়ে যাচ্ছে আরো কষ্টসাধ্য। আর সে কারণেই দেশের গতানুগতিক চিকিৎসা খাতের পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যেই প্রান্তিক অঞ্চলে পৌঁছচ্ছে সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেখানেও ভ্রাম্যমান মেডিকেল ক্যাম্প নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী।
বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনাকে ধারণ করে পথচলা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। অমিত দৃঢ়তায় তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘আমরা সৈনিক, আমরা সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’ মাঠে থাকা সেনা সদস্যদের মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৬ দফা কার্যকর নির্দেশনা প্রদান করেছেন সেনাবাহিনীর প্রধান। নিজের বহুমাত্রিক মেধার বিকিরণে, বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ও পেশাদারিত্বের আভায় নিজ বাহিনীর সদস্যদের এসব নির্দেশনা বাহিনীর সদস্যদের সাহস ও মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি করোনা সঙ্কুল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে আক্ষরিক অর্থেই ‘টনিক’ হিসেবে কাজ করছে। নিজের নির্দেশনায় সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘জনগণের প্রকৃত বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মানবিক হৃদয় নিয়েই ধৈর্য, সহনশীলতা ও সৎ সাহসের পরিচয় দিয়ে জনগণের পাশে থেকে তাদের আস্থা অর্জনেও গুরুত্বারোপ করেছেন। জাতির সংকটময় মুহূর্তে নিজেদের পেশাদারিত্ব, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের আপামর মানুষের পাশে থেকে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। আর সে কারণেই তার এই নির্দেশনার বাস্তব প্রতিফল ঘটাচ্ছে সকল সেনা সদস্য। মাঠ পর্যায়ে নিজেদের রেশন থেকে ত্রাণ সহায়তা প্রদান, মানুষকে সচেতন করতে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে টহল দেয়া এবং সেই সঙ্গে দুস্থ ও অসুস্থদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে বর্তমানে ভরসার অন্যতম নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি প্রান্তিক অঞ্চলে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সেনা সদস্যরা। দেশপ্রেম আর মানবিকবোধ থেকেই মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নিজেরা বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে তাদের এ সামাজিক কার্যক্রম ‘সিমিক’র সুনাম রয়েছে। নিজেদের চিরায়ত সেই ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটছে এবার দেশের প্রতিটি এলাকায়। এতে করে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত প্রতিটি মানুষের আস্থা আর ভালোবাসার অপর নাম হয়ে উঠেছেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা। সবাই একবাক্যে সেনা চিকিৎসকদের আন্তরিকতায় নিজেদের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রায় প্রতিদিনই দেশের প্রতিটি এলাকায় জ্বর, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিচ্ছেন সেনা চিকিৎসকরা।
শুধু তাই নয়, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সীমিত যান চলাচলের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাইকমান্ড নিজেদের আর্মি এভিয়েশন গ্রুপকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে। দুর্যোগকালীন সময়ে সড়কপথ ব্যবহার না করে প্রতিটি জেলার সেনাবাহিনীর টিমের জন্য প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জামাদি পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে এভিয়েশন গ্রুপের একাধিক হেলিকপ্টার ও কাসা বিমান। দিন দিন আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যের ওপর নির্ভরতাও কমিয়ে আনছে সেনাবাহিনী। উদ্ভূত পরিস্থিতির আশঙ্কা থেকেই দেশের প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টের সামরিক হাসপাতালসমূহকেও (সিএমএইচ) প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এদিকে ঘরবন্দি জীবনে কর্মহীন, শ্রমজীবী, দরিদ্র ও দুস্থদের টান পড়েছে পেটে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর সামান্য আয় রোজগারেরও জো নেই। সংকটময় এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে, আঁধার কাটাতে অতি দরিদ্র এসব মানুষের পাশে থাকার সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। এগিয়ে আসছে সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও। চরম অভাবের জীবনে নিম্নবিত্তের কাছে কাঙ্ক্ষিত ত্রাণই যেন আবির্ভূত হচ্ছে ত্রাতারূপে। অবশ্য এই ত্রাণ নিয়ে বিশৃঙ্খলা বা লঙ্কাকাণ্ডের বেশ কিছু বাজে উদাহরণও দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু স্থানে স্থানে ত্রাণ বিতরণ হলেই পরোয়া করা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্বের।
কঠিন এমন বাস্তবতায় কেবলমাত্র সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি সরকারের নির্দেশে দেশজুড়ে মাঠে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কোন জনসমাগম নয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গৃহবন্দী জীবন যাপনের শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়াটাই এখন তাদের ‘রুটিন ওয়ার্ক’। মানবিকতাবোধে জাগ্রত হয়ে দেশের ৬২ টি জেলাতেই কর্মহীন গরিব ও দুস্থদের বাঁচিয়ে রাখতে নিত্যপণ্য বিতরণের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছেন। হুড়োহুড়ি বা শোডাউন প্রবণতার বাইরে গিয়ে তারা গরিব ও দুস্থদের ত্রাণের প্যাকেট পৌঁছে দিচ্ছেন বাড়ি বাড়ি। আর এসব খরচাপাতি হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিজস্ব উদ্যোগে; নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত রেশন থেকে।
করোনা পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্বে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জোর দিয়েছেন কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখার ওপর। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করোনা যুদ্ধের ‘অগ্রসৈনিক’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশজুড়ে সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে কঠিন এক সংগ্রামে নিজেদের সামিল করেছেন রাত-দিন; ক্লান্তিহীন।
একই সঙ্গে বিশেষ এই পরিস্থিতিতে দেশের কৃষি অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতেও তারা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। কৃষির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নানা জাতের উন্নত সবজির বীজ। করোনায় পুরো দেশ স্থবির হয়ে পড়লেও কৃষি যেন থমকে না দাঁড়ায় সেজন্য ফসলের মাঠের ‘আসল নায়ক’ কৃষকদের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে মনোবল সুদৃঢ় করে তাদের জন্য নিজেদের খরচায় প্রয়োজনীয় উপকরণও সরবরাহ করছেন। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এমন কর্ম প্রয়াসকে ইতিবাচক, বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী বলেই মন্তব্য করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরাও।
জানা যায়, প্রাণঘাতী করোনার ভয়াল কাণ্ডে ভবিষ্যৎ খাদ্য সংকট মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাবের মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে, এমন সতর্কতা সরকার প্রধানের। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী কোনো জমি অনাবাদী না রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা ইতোমধ্যেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ৫ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে পোল্ট্রি, কৃষি খামার, ফলমূল, মসলাজাতীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী চাষিরা এখান থেকে ঋণ নিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে সামগ্রিক উৎপাদনের ওপরও বিশেষ নজর দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। সামনের দিনের খাদ্য সংকট ও মন্দা কাটাতেই কৃষি অর্থনীতিকে আরও মজবুত করতে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের নিজেদের সাধ্যমতো সহায়তারও ‘বিশেষ বার্তা’ দিয়েছেন নিজ বাহিনীর দায়িত্বশীলদের। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর নিজেদের ‘রুটিন’ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কৃষিজ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে অনেক জেলাতেই বাড়ি বাড়ি কৃষকদের উৎসাহী করছেন সেনা সদস্যরা। এমনকি যারা মৌসুমি কৃষক তাদেরকেও কৃষি উৎপাদনে আগ্রহী করতে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ সকল উদ্যোগ সাধারণ মানুষের প্রশংসা কুড়চ্ছে। আর সে কারণেই চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভরসার অন্যতম নাম হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।