প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান
পূর্ববাংলার একটি বিখ্যাত জেলা কুমিল্লা। এক সময় এ অঞ্চল ত্রিপুরার মহারাজার রাজ্যভূক্ত ছিল। এ জেলার একটি প্রসিদ্ধ মহাকুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া এখন একটি জেলা। সনাতন হিন্দু ধর্ম বর্ণাশ্রিতা চতুবর্ণের উচ্চতম সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ। এ অঞ্চলে এ উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের আধিক্য ও প্রভাবের কারণে মহাকুমাটির এভাবে নামকরণ। উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এখানে অনেক অভিজাত মুসলমানেরও বসবাস। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে দূরে মেঘনা নদীর অনতিদূরে একটি গ্রাম বাহাদুর। সুজলা-সুফলা, সবুজ-শ্যামল এ গ্রামের একটি বর্ধিষ্ণু পরিবার হচ্ছে ‘সরকার পরিবার’। এ অঞ্চলে সরকার পরিবারের প্রেক্ষাপট হলো- এটি শিক্ষিত ও শাসকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ পরিবারের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেলন সৈয়দ আবদুর রশিদ সরকার। তিনি যেমন ছিলেন শিক্ষিত, তেমনি ছিলেন আর্থিক দিক দিয়ে সঙ্গতি সম্পন্ন। তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন, এজন্য ব্যবসাকে জীবিকা অর্জনের পথ হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি গ্রামেই বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী নাম বেগম জোবেদা খাতুন। তিনি বাহাদুরপুরের একজন ধনী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মমিন উল্ল্যাহ বেপারীর মেয়ে। এই দম্পতির ঘরে ১৯৪৯ সনের ১৪ ডিসেম্বর; ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৩৫৬ বাংলা, রোজ বুধবার সকাল ১০টায় এক সুন্দর শিশু জন্মগ্রহণ করেন। এ নবজাতকের নামকরণ করা হয়- ‘মাহ্বুব-এ-খোদা’। নাম রাখেন- সেই সময়ের একজন খ্যাতিমান আলেম ও বুজুর্গ ফখরে বাংলা মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব। তাঁর বংশের ঐতিহাসিক পটভূমি ও তাঁর জন্মের সাথে যুক্ত বিস্ময়কর কাহিনী তাঁর জীবনীতে বিবৃত হয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই মাহ্বুব-এ-খোদার মধ্যে ব্যতিক্রমী গুণাবলি দেখা যায়। তাঁর মধ্যে শিশু সুলভ চাঞ্চল্য কম, স্থিরতা বেশি। তিনি পড়াশুনায় যেমন মনোযোগী, তেমনি ধর্ম-কর্মেও আগ্রহী। পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি নিজের মসজিদে পবিত্র কুরআন শরিফ পাঠ করা শেখেন। পরবর্তীতে নিজ গ্রামের পাঠশালা, পাশ্ববর্তী সোহাগপুর প্রাইমারি স্কুল ও শেষে তালশহর সিনিয়র মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন।
শিশুকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর থেকে মাহ্বুব-এ-খোদার মধ্যে অন্যায় ও অসত্যের প্রতি বিরাগভাব জাগ্রত হতে থাকে। অন্যায় ও অবিচার প্রতিরোধ না করতে পারলে তিনি শান্তি পেতেন না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর মধ্যে সাংগঠনিক যোগ্যতার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। এসব গুণের জন্য তিনি তাঁর সহকারী ও সতীর্থদের মধ্যে সব সময়ই নেতৃত্ব লাভ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তালশহর মাদ্রসার ছাত্র সংসদের ভিপি পদ লাভ করেন। সময়ের প্রবাহে ১৯৭১ সন আসে। স্বীয় চারিত্রিক গুণাবলির কারণে তিনি মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও একপর্যায়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আঞ্চলিক সভাপতি হন এবং ২৫ মার্চ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রাখেন। সূফী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ হতে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর জীবন গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
আমার এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় হলো এরূপ একজন সাহসী সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের আধ্যাত্মিক অভিযাত্রা স্মরণ করে কিছু কথা বলা। আগেই উল্লেখ করেছি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহ্বুব-এ-খোদা তালশহর মাদ্রাসা হতে প্রচলিত পাঠক্রমে শিক্ষিত একজন আলেম। তাঁর জীবনী অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, তাঁর মধ্যে অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন গুণ, বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতি সমন্বিত হয়েছে। যেমন, মাদ্রাসা শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ থেকে অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই মুক্তিযুদ্ধ সশস্ত্রভাবে অংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তা দিয়েছেন, এমন কী মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছে, এমন অনেকে আছে, কিন্তু নিজে করাতে যেয়ে রীতিমত ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এমন মাদ্রাসা শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বেশী নয়। এ সম্বন্ধে মেজর জেনারেল (অব.) এম আজিজুর রহমান (বীর উত্তম) বলেন- “আমার জানা মতে হয়তো তিনিই একমাত্র আলেম বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।”
এমন একজন সাহসী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর মানুষের মরমী (সুফি) মনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া, সেই পথে অগ্রসর হওয়া, বিশেষ লক্ষ্যে উপনীত হওয়া, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। আরও বিস্মিত হতে হয় অতি অল্প সময়ে তাঁর সুফি সাধনায় সিদ্ধি লাভ দেখে এবং তার অনুশীলনকৃত পথে বিপুল সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হওয়ায়। তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীর ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করে একপর্যায়ে জয়দেবপুরে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় থেকে কতগুলো রহস্যময় ঘটনা থেকে তিনি ধীরে ধীরে মরমী পথ পরিভ্রমণ শুরু করেন। এ পর্যায়ে মরমী পথে তাঁর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও এখন পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয় মরমী বীজ তাঁর হৃদয়মূলে অনেক আগেই উপ্ত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ্ (বীর উত্তম)-এর কথা উল্লেখ করতে হয়। তিনি বলেন, “তাঁর কার্যক্রম প্রথমে আমার নজরে আসে ধর্মগড় অপারেশনে। সেই অপারেশনে তাঁর বীরত্বের কারণে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে তিনি শুধু যুদ্ধই করেননি, তিনি আমার সেক্টরের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাকে ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন। নামাজের সময় তাঁর বয়ান এতই শ্রুতিমধুর ছিল যে, তা শুনতে ইচ্ছা করত। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে আমার হেড কোয়ার্টার হেজামারাতে রোজার ঈদের (ঈদুল ফিতর) নামাজের খুৎবা এবং মুনাজাত এমনই প্রাণবন্ত ছিল যে, সেদিন সেই জামায়াতে এমন কোনো লোক ছিল না, যে কাঁদে নাই। সেদিন হুজুর সবারই মন কেড়ে নিয়েছিলেন এবং দোয়া করেছিলেন যে, “আল্লাহ্ আমরা যেন ঈদুল আযহার নামাজ রেসকোর্স ময়দানে পড়তে পারি।” হয়েছিলও তাই। আমরা ঈদুল আযহার নামাজ রেস কোর্স ময়দানেই পড়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহসী অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহাম্মদ চৌধুরী লিখেছেন- “মা-বাবার দোয়ায় সিক্ত জনাব মাহ্বুব প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম সম্মুখ সমরে সফল হয়ে ফিরে এসে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মাধবপুর, মনতলা, সিলেট মহাসড়কে অ্যাম্বুস, বাগসইর গ্রামে অ্যাম্বুস, তেলিয়াপাড়ায় অ্যাম্বুস করা থেকে শুরু করে শত্রুর সরাসরি আক্রমণ প্রতিহত করে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয়ী বেশে দেশে প্রবেশ করে।”
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম- (বীর প্রতীক) মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টর হেড কোয়ার্টারে দায়িত্ব পালনকালে আমার পরিচয় হয়েছিল তৎকালীন তরুণ মাওলানা (মুক্তিযোদ্ধা) মাহ্বুব-এ-খোদার সাথে। তিনি তখন ২০/২২ বছরের যুবক। আমার বয়সও তখন ২৫ পার হয়নি। এক সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে তাঁর মাঝে যে অসাধারণ দেশপ্রেম ও সাহস প্রত্যক্ষ করেছি, তা সত্যিই উজ্জ্বল। তিনি একাধারে হোল্ডিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাটাস্টেশন প্যারেড করাতেন, তাদের উদ্দেশে ধর্মীয় বক্তৃতা দিয়ে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতেন, আবার রণাঙ্গনেও প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিতেন।” একই ধরনের কথা পাই মেজর (অব.) কামরুল হাসান ভূইয়ার লেখায়। তিনি হেজামারার ঈদের জামাতের কথা স্মরণ করেন এভাবে- “ইমামতি করেন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব অত্যন্ত আবেগময় এক মোনাজাত করেন। নামাজিরা কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে মাটিতে গড়াতে থাকেন।” বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা মাহ্বুব-এ-খোদা সম্মুখ সমর ও অ্যাম্বুস অবস্থায় তাঁর আবেগ অব্যাহত রাখেন। তাঁর হাতে অনেক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। এ কথা স্মরণ করতে যেয়ে তিনি বলেন- “সৃষ্টির মাঝে যেমন আনন্দ আছে, ধ্বংসের মাঝেও তেমনি আনন্দ আছে।” পাক বাহিনী ধ্বংসের ক্ষেত্রে তিনি কখনও গুলি চালনা করেছেন, কখনও মাইন পুতে রেখেছেন, কখনও তাদের প্রতি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছেন। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন। তিনি তাঁর এসব সাহসী ও কার্যকর অভিজ্ঞতার কথা নিজেই বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই- এমন একজন সাহসী সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধার ‘সুফি পথ’ অবলম্বনে এবং সেই পথে অগ্রসর হয়ে নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছান- কোনো সহজ কথা নয়। তিনি এখন একা নন। তাঁর অসখ্য ভক্ত মুরিদ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের আশেকে রাসুল বলা হয়। আর তারা তাঁকে ভক্তি ভরে ভালোবাসার গভীর উচ্চারণে ‘সূফী সম্রাট’ লকবে স্মরণ করে।
[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
আলহামদুলিল্লাহ
সন্মানীত বীর মুক্তিযোদ্ধা হযরত দেওয়ানবাগী হুজরের বীরত্বগাধা ইতিহাস এবং পরে সেই সাহসী সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধার সূফী স্রমাট হয়ে উঠা সহজ কথা নয়। তিনি যে প্রকৃত পক্ষে একজন সত্যি কারের যোদ্ধা তাতে কোন সন্দেহ নাই। আগে যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য আর এখন যুদ্ধ করছেন মানুষকে আশেকে রাসুল বানানোর। স্যালুট এই বীর যোদ্ধাকে……………..
জয় হোক সদা সত্যতের জয় হোক মোহাম্মদী ইসলামের, বিশ্বময় ফুটে উঠুক যুগের ঈমামের প্রচারিত মোহাম্মদী ইসলাম
সুন্দর
অসাধারণ 😍
আলহামদুলিল্লাহ
ঠিক
আলহামদুলিল্লাহ