সালাহ উদ্দিন: করোনা ভাইরাস পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের কর্মপরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হলো কৃষি খাতের উৎপাদন অব্যাহত রাখা। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে কৃষি খাত। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছে কৃষি খাতের কথা।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে মানবসম্পদ খাত (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট খাত)-এর সর্বোচ্চ ২২.৮ শতাংশ বরাদ্দের পরই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সার্বিক কৃষি খাতে। সার্বিক কৃষি খাতে (কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানিসম্পদ ও সংশ্লিষ্ট খাতে) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২.০ শতাংশ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৬৯ হাজার ৫৫৩ কেটি টাকা।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ২০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। কৃষকের উৎপাদিত ধান-চালের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি ও বাজারের চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ধান-চালের সরকারী সংগ্রহ ও বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ২ লক্ষ টন বাড়ানো হয়েছে। কৃষকের ঋণ প্রাপ্তি সহজ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি রিফাইনান্স স্কিম গঠন করা হচ্ছে। তাছাড়া নিম্নআয়ের পেশাজীবি কৃষক/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কীম ঘোষণা করা হয়েছে।
কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইত্যাদি খাতে গ্রামের দরিদ্র কৃষক, বিদেশ ফেরত প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত তরুন ও বেকার যুবকদের গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থাণ ব্যাংক ও পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রত্যেকের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা করে মোট ২০০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হবে।
অর্থমন্ত্রী আরো জানান, কৃষি হচ্ছে সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাত। অধিক খাদ্য উৎপাদানের লক্ষ্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসনে জোর প্রদান ও সারের উপর ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখা হবে। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাসহ কৃষি খাতের সাথে জড়িত কৃষক, কৃষি শ্রমিক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করাই বর্তমানে কৃষি বান্ধব সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে কৃষিতে উচ্চমাত্রায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাসহ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূণর্তা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। করোনার প্রভাব মোকাবেলায় বিগত বছরগুলোর ন্যায় কৃষি খাতে ভর্তুকি, সার বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন ও স্বল্পসুদে কৃষি ঋণ প্রদান অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিগত বছরগুলোর মত আমদানী খরচ যাই হোক না কেন আগামী অর্থ বছরে রাসায়নিক সারের বিক্রয় মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হবে। আগামী অর্থবছরে প্রায়োগিক গবেষণা জোরদারকরণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে সহনশীল বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। শষ্যের বহুমুখীকরণ ও ফসলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমানো কার্যক্রম সম্প্রসারণ ও খামার যান্ত্রিকীকরণ জোরদার করা হবে। মানসম্পন্ন পাট বীজ উৎপাদন ও বহুমুখী পাট পণ্য উদ্ভাবনের গবেষণা কার্যক্রম চলমান থাকবে।
বাংলাদেশ মৎস্য ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে মিঠা পানির মাছের নতুন জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে নতুন নতুন উন্নয়নের বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে সরকার। আগামী অর্থবছরে প্রাণীসম্পদ খাতের উন্নয়নে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, হস্তান্তর, বিভিন্ন বিষয়ে ৪০টি গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। গবাদিপশুর জাত উন্নয়নে সিমেন উৎপাদন, কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ, প্রাণী খাদ্য সংরক্ষণে ডোল পদ্ধতি সম্প্রসারণ এবং দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদানে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে খাদ্য শস্য উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি সরবরাহ পরিস্থিতির উপর ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারী পর্যায়ে খাদ্য মজুদ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার আমন ফসল হতে ৭.৯৮ লক্ষ মে. টন সংগ্রহ করেছে। চলতি বোরো মৌসুমে ৮ লক্ষ মে. টন ধান ও ১১.৫০ লক্ষ মে. টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দুই গুণ।
অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থ বছরের জন্য কৃষি, মৎস্য, প্রাণী সম্পদ ও খাদ্য নিরাপত্তা খাতে ২২ হাজার ৪৮৯ কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব করেন যা বিগত অর্থবছরের চেয়ে ১০০০ কোটি টাকার বেশি।