কবিগুরু ও বাংলা সাহিত্য

0
303
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আবুল খায়ের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭ মে, ১৮৬১ সাল) জন্মগ্রহণ করেন। তাকে বলা হয় বিশ্বকবি, যিনি বাংলা ভাষাকে নিয়ে গেছেন অনেক উঁচুমাত্রায়। এই উপমহাদেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলা সাহিত্য আজ এক সমৃদ্ধ এবং সগৌরবে দন্ডায়মান সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য আজকে যে দাপটের সঙ্গে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে কিছু সাহিত্যিকের নিরলস সৃষ্টিকর্মের বদৌলত।

আর বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে যারা অবদান রেখেছেন, তন্মধ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞও বটে। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার অবিচল পদচারণা তাকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

জমিদার বংশে জন্ম নিয়েও তিনি জমিদারদের বিরুদ্ধে কলম ধরার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন। যেটা বিশ্বের যে কোনো সাহিত্য ইতিহাসে বিরল ঘটনা। জমিদার বা মহাজনদের সুদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন, ‘যা ছিল মোর বিঘে তিন ভাই, তার সবি গেছে ঋণে।’

জমিদার পরিবারের সদস্য হিসেবে তার চলাফেরায় ছিল কড়াকড়ি ও নানা বিধিনিষেধ। তাই তিনি ইচ্ছে করলেই যেখানে-সেখানে যেতে পারতেন না। তবে একটা সুন্দর সুযোগ আসে বাংলাদেশ ভ্রমণের, যেটা তার সৃষ্টিতে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে আছে।

তার সাহিত্য জীবনের এক সোনালি সময় কেটেছে সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর ও শিলাইদহে। বাংলাদেশে অবস্থান করার কারণে জীবনের গতি-প্রকৃতি ও বাস্তব জীবনকে যেভাবে উপলব্ধি করেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে, তাই তার লেখনীর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়।

তিনি তার ‘ছিন্নপত্রে’ লিখেছেন- তিনি তার আত্মীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশে যদি না আসতে পারতেন, তবে হয়তো তার ‘গীতাঞ্জলি’র মতো মহা মূল্যবান কাব্য রচনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। যা পরবর্তীকালে তাকে সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে বড় স্বীকৃতিস্বরূপ ‘নোবেল পুরস্কার’ অর্জনের গৌরব এনে দেয়।

তিনি ১৩টি উপন্যাস রচনা করেছেন। তন্মধ্যে চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ, শেষের কবিতা এবং চার অধ্যায় বেশ প্রসিদ্ধ। উপন্যাসে জাতীয়তাবাদের উত্থান, ধর্ম-দর্শন ইত্যাদি উপজীব্য ছিল।

প্রসিদ্ধ চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রায়নের মাধ্যমে বাংলা উপন্যাসকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার প্রয়াস কাজে লাগিয়েছেন। এ ছাড়াও ‘চোখের বালি’ এবং ‘চতুরঙ্গ’- তার বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরিকৃত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রেমীদের হৃদয়ে এক বড় স্থান দখল করে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তার একটা নিজস্ব ধারা তৈরি করেছিলেন। প্রথমদিকে তিনি সাধু ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। তবে পরবর্তীকালে কবিতার ভাষা হিসেবে চলিত বাংলার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

কবিতায় তিনি একপর্যায়ে আধুনিকতাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন; কিন্তু এক সময় আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যান। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছেন, যে কবিতায় ছন্দ ও লয় থাকবে না সেটা কবিতা হিসেবে পাঠক নন্দিত নাও হতে পারে।

আর রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি পরিচিত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি। যা তাকে প্রথম বাঙালি হিসেবে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। গীতাঞ্জলি, সোনার তরী, কল্পনা, বলাকা, চিত্রা, চৈতালি, মহুয়া, সেঁজুতি, পুনশ্চ, পূরবী, ভগ্ন হৃদয় ইত্যাদি তার প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ। তার কাব্যে যেমন রোমান্টিকতা ছিল, তেমনি ছিল জীবনবোধ ও বাস্তবতার স্বাক্ষর।

বিন্দুর মাঝে সিন্দু খুঁজে বেড়ানোতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যা কিছু তার কবি মনকে আলোড়িত করেছে, তাই তিনি তার ছোট গল্প রচনার মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে।

চুরাশিটি ছোট গল্প নিয়ে ‘গল্পগুচ্ছ’ নামক গল্প সংকলনের মাধ্যমে তিনি নিজেকে পাঠক মনে দোলা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন আপন মনে। ভারতীয় উপমহাদেশের দরিদ্র জনগণের জীবনের প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে ভেঙে সামাজিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর প্রতি তার ছিল নিরলস প্রচেষ্টা।

তাইতো তার গল্পগুলো বাংলাদেশে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি সমান জনপ্রিয় ভারতেও। তার প্রায় সব গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে নাটক ও চলচ্চিত্র। ছোট গল্পে তিনি কখনও কখনও আঘাত করেছেন হিন্দু বিবাহ নিয়ে বিভিন্ন রকমের কুসংস্কার ও প্রথার বিরুদ্ধে এবং ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভন্ডামিকেও তুলে ধরেছেন নিখুঁতভাবে। তার ছোট গল্পের অনেক সংলাপ এখনও বাংলা ভাষায় প্রবাদপ্রতিম। যেমন- কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।

সাধারণ শ্রেণীর লোকদের ধনী শ্রেণীর লোকেরা শোষণ করার জন্য কীভাবে বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূল কারণগুলো অনুসন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ তার ছোট গল্পের মাধ্যমে। যা বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ।

নাটক, নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্য লেখায় ছিল তার সমান পারদর্শিতা। চন্ডালিকা, তাসের দেশ, চিত্রাঙ্গদা, প্রায়শ্চিত্ত, নটীর পূজা, মায়ার খেলা ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য নাটক।

প্রবন্ধ রচনায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যের এক বড় স্থান দখল করে আছে। নবযুগ, নারী, হিন্দু-মুসলমান, চরকা, শূদ্রধর্ম, বৃহত্তর ভারত, সভ্যতার সংকট, কনগ্রেস, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম ইত্যাদি তার প্রসিদ্ধ প্রবন্ধ। তন্মধ্যে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ বর্তমানে প্রসিদ্ধ বাংলা প্রবাদও বটে। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে রাশিয়ার চিঠি, জাপান যাত্রী, পারস্য ইত্যাদি অন্যতম। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখতেও পিছপা হননি তিনি। ‘জীবন স্মৃতি’ ও ‘চরিত্রপূজা’ তারই স্বাক্ষর। ‘ছিন্নপত্র’ একটা আলোচিত পত্র সাহিত্য।

তিনি একজন নামজাদা সঙ্গীতজ্ঞ। তার রচিত হাজার হাজার গান এখনও বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ। যেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে বেশ জনপ্রিয়। পৃথিবীতে একটি বিরল ঘটনা, আর সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের রচিত গান বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

পরিশেষে, বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবিচ্ছেদ্য অংশ। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে কখনও বাংলা সাহিত্য কল্পনাও করা যায় না। রবীন্দ্রচর্চার প্রতি আরও বেশি বেশি মনোনিবেশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধিশালী করতে ভূমিকা রাখবে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও শুদ্ধ সাহিত্যচর্চার মাধ্যমেই কেবল অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে ভরে উঠুক সাহিত্যের শুদ্ধতায়। জাতীয় জীবনে বয়ে আসুক সমৃদ্ধিশালী সমাজ কাঠামো। মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটুক, সে প্রত্যাশায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here