দেওয়ানবাগ ডেস্ক: এক নতুন পৃথিবীর মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরা। করোনাকাল আমাদের যে পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে তা পুরো বিশ্বের মানুষকে নতুন পৃথিবীর দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। সমাজবিদরা বলছেন, হয়তো করোনাকালের আগে যে বিশ্বকে আমরা রেখে এসেছি করোনাকালের পর থেকে সেই বিশ্ব আর আমাদের সামনে আসবে না। আমরা পরিবর্তিত নতুন পৃথিবীর বাস্তবতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠব। নতুন পৃথিবীতে নতুন জীবনাচরণ নিয়ে আমরা আবর্তিত হব।
এরই মধ্যে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি বদলে যেতে শুরু করেছে। মানুষ অনেক বেশি পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। করোনাকালের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতায় বহির্মুখী জীবন হয়েছে ঘরমুখী। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের ঘরের কাজে, অফিসের কাজে আমরা অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে শুরু করেছি। আগে ঘরের কাজে গৃহকর্মীর যে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছিল করোনাকালে সেটা অনেকটাই কেটে গেছে। নারী-পুরুষ সবাই মিলে ঘরের কাজে অংশ নিচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যবহার বেড়েছে ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের। তবে, বিপ্লব ঘটে গেছে স্কুল-কলেজ, অফিস, আদালতে।
প্রয়োজনই যে সব কিছু পরিবর্তনের, নতুন কিছু সৃষ্টির মূলে সেটা এই করোনাকাল এসে আরো একবার প্রমাণ করে দিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের আক্রমণে যখন পুরো বিশ্ব দিশেহারা, ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালেন টুরিং জার্মানদের আক্রমণ নির্দেশক কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ‘অ্যানিগমা’ ডিকোড করতে গিয়ে নতুন প্রযুক্তির মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিন আবিষ্কারের ফলে জার্মানদের আক্রমণ কোথায় হবে, তাদের পরিকল্পনা জানতে শুরু করে ইংল্যান্ড ও রাশিয়া। এ আবিষ্কারের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছিল। আর যুদ্ধ শেষ হতেও ২ থেকে ৪ বছর কম সময় লেগেছিল। এই মেশিনকেই আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। এখন আমরা যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজের কথা বলি তার জনকও এই অ্যালিন টুরিং। অ্যালেন টুরিংয়ের এই আবিষ্কার বদলে দিয়েছিল পৃথিবী। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যালেন টুরিংয়ের হাত ধরে প্রযুক্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই যাত্রা করোনাকালের কারণে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কি নতুন পৃথিবীর জন্ম দেবে? প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, চতুর্থ কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মধ্য দিয়েই চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বেগবান হবে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পালটে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের এই তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। এটিকে এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। ডব্লিউইএফের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি।’
ডিজিটাল বিপ্লব সম্পর্কে বহুজাতিক মোবাইল অপারেটর ডিজিসেলের চেয়ারম্যান ডেনিস ও ব্রায়েন ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছিলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে ডিজিটালাইজেশন আমাদের কাজের সব ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তবে এ পরিবর্তনকে আমি দেখি সূচনা হিসেবে। আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আমরা এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যা এর আগে ৫০ বছরে সম্ভব হয়নি।’
তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা ধারণা করছিলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ সেই পরিবর্তনের ফলাফল আমাদের সামনে চলে আসবে। করোনাকাল চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সেই সময়টাকেই যেন ১০ বছর আগে নিয়ে এসেছে।
ছোট্ট কয়েকটা তথ্য দিলেই আমাদের সন্দেহ নিরসন হতে পারে। বিজনেস অফ অ্যাপসের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, কমিউনিকেশন্স অ্যাপ জুমের ২০১৩ সালে ব্যবহারকারী ছিলেন ১ কোটি। ২০১৫ সালের শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ কোটিতে। গত বছরের ডিসেম্বরে জুম ব্যবহার করে বিডিও সভা হয়েছে প্রতিদিন ১ কোটি। মার্চ মাসে এসে জুম ব্যবহারকারী দাঁড়ায় ২০ কোটি। আর এপ্রিলে ৩০ কোটি। এপ্রিলে এই ব্যবহারীদের মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, ৯০ হাজার স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আর পাশাপাশি ২০টি দেশ নতুন করে এই জুম অ্যাপ ব্যবহার করা শুরু করে এই করোনাকালে। শুধু জুম অ্যাপেই এ অবস্থা। এছাড়াও রয়েছে ইউটিউব লাইভ, ফেসবুক লাইভ, গুগল ক্লাসরুম, মাইক্রোসফট টিম, কোসেরা প্রভৃতি। আরো রয়েছে হোয়াটস আপ, ভাইবার প্রভৃতি।
এসব অ্যাপের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া মানেই হচ্ছে মানুষ ঘরে বসে অনেক কাজ সেরে ফেলতে পারছে। গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, স্কুলের ক্লাস, অফিসের দাপ্তরিক জরুরি কাজ সবই করা যাচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। একটি স্মার্ট মোবাইল ফোনের ব্যবহার মানুষের প্রতিদিনের অনেক জটিল কাজের সহজ সমাধান হয়ে উঠেছে। ফলে, দেখা যাচ্ছে, অনেক বড় অফিস নিয়ে যে কাজ হতো এখন যে যার সুবিধামতো অবস্থানে থেকেই তা সেরে ফেলতে পারছেন। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকাংশ কর্মচারীকে বাসায় বসেই কাজ করার অনুমতি দেওয়ায় অফিস রাখার মতো ব্যয়বহুল খরচ সাশ্রয় হতে শুরু করেছে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘হোম অফিস’ ধারণাটি পুরোনো হলেও করোনাকালে বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এতো গেল অফিসের কথা। বাসাতেও প্রযুক্তি ব্যবহার আগের চেয়ে তুলনামূলক বেড়েছে। বেড়েছে ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ব্যবহার। করোনাকালে অধিকাংশ মার্কেট বন্ধ থাকলেও জুন মাসেই শুধু ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহার ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্টেডিয়াম মার্কেটের বিভিন্ন দোকানিরা। তবে, সময়ের এই চাহিদা মেটাতে হলে ব্যতিক্রমী পণ্যসেবার পাশাপাশি নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা পূরণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
শিল্প বিপ্লব হবে কিনা সেটা বলতে না পারলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় মানুষ এখন আগের চাইতে অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল হতে শিখেছে । যা আমাদের সকলের জন্যে ভালো একটা লক্ষন ।