করোনা ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

0
303

অনলাইন ডেস্ক: দেশের তরুণ অণুজীব বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহার পথ ধরে করোনা ভাইরাসের আরো প্রায় ৪০টি জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে দেশে। এর মধ্যে ১০টি হয়েছে সেঁজুতি সাহার বাবা দেশের আরেক চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. সমীর সাহার প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণাগারে। বাকিগুলো হয়েছে দেশের অন্যান্য আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে। ইতিমধ্যেই বিজ্ঞান ও গবেষণা পরিষদের পক্ষ থেকেও ৩২টি জিনোম সিকোয়েন্সের কথা জানানো হয়েছে। এর বাইরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. বিজন শীলের নেতৃত্বে একটি গবেষকদল করোনা ভাইরাস পরীক্ষায় এন্টিবডি, এন্টিজেন ও আইজিজি উদ্ভাবনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

এর বাইরে দেশে করোনা ভাইরাস নিয়ে কিংবা এর জীবনকাল বা গতি-প্রকৃতি নিয়ে কোনো রকমের গবেষণায় যেতে পারেনি কোনো প্রতিষ্ঠান। কেবল চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশের যে তথ্য-উপাত্ত কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য-উপাত্তর ওপর ভর করেই চলছে দেশের মানুষের জীবন প্রণালী ঠিক করার কাজ। যদিও কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলে আসছেন চীন ও ইউরোপ-আমেরিকার আবহাওয়া কিংবা পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে অথবা ওই সব দেশের মানুষের শারীরিক রসায়ন বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষের শারীরিক রসায়নের মিল না-ও থাকতে পারে। অথচ এসব নিয়ে কেন গবেষণা হচ্ছে না-এর তেমন কোনো জুতসই জবাব দিতে পারছেনা দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরের বাইরে কোথায় কত সময় ধরে সক্রিয় থাকে সেটি নিয়েও এখন পর্যন্ত দেশে কোনো গবেষণা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশের তাপমাত্রার সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর তাপমাত্রাগত পার্থক্যের কী প্রভাব আছে করোনা সংক্রমণে, তা নিয়েও হয়নি গবেষণা। মানুষের পোশাকে, ঘর্মাক্ত শরীরে, চুলে, গাড়ির হাতলে, খাদ্যদ্রব্যে, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা সামগ্রীতে কোন মাত্রার কতটুকু ভাইরাস থাকে না থাকে তা নিয়েও স্থানীয়ভাবে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত কাজ করেছে বলে জানা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে চলতি মৌসুমি ফলের সময়ে বিভিন্ন ধরনের ফলের সঙ্গে কিংবা সরবরাহকৃত পানিতে অথবা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে কিভাবে এ দেশে ভাইরাস ছড়াতে পারে বা না পারে তা নিয়েও গবেষণার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন প্রায় একই সুরে বলেন, এগুলো হয়তো করা দরকার। কিন্তু করা হয়ে উঠছে না বিভিন্ন কারণে।

এ মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘আমরা এ মুহূর্তে দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কোন এলাকায় কিংবা কোন কমিউনিটিতে কতটা বিস্তার ঘটেছে, তা নিয়ে কাজ করছি। সেই সঙ্গে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব চিকিৎসাকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা মারা যাচ্ছেন সেগুলোর কারণ খুঁজে দেখা হচ্ছে। এর সঙ্গে আরো একাধিক বিষয়ে সার্ভিলেন্স চলছে।’

বাংলাদেশের পরিবেশে করোনা ভাইরাসের অবস্থানগত কিংবা গতি-প্রকৃতি নিয়ে কোনো গবেষণা আইইডিসিআর করছে কি না জানতে চাইলে ওই বিজ্ঞানী বলেন, ‘এখনো আমরা এসব নিয়ে গবেষণা করছি না। অন্যান্য দেশও এসব ক্ষেত্রে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কারণ করোনা ভাইরাস এমন একটি ভাইরাস যার এখনো চূড়ান্ত কোনো রূপ কোথাও পাওয়া যায়নি।’

যদিও ড. আলমগীর বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে এটা নিশ্চিত হয়েছি যে মৃতদেহ সাবান দিয়ে গোসল করানোর পরে শরীরের বাইরে কোনোভাবেই করোনা ভাইরাস থাকতে পারে না। তবে গোসল না করানো অবস্থায় আমরা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাস পেয়েছি।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. বিজন শীল বলেন, ‘সঠিক গবেষণা না করলেও কিছু কাজের মাধ্যমে আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের দেশের আর্দ্রতায় করোনা ভাইরাস ইউরোপ-আমেরিকার মতো বিস্তার ঘটা সম্ভব নয়; বরং অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। এ ছাড়া আমি পরীক্ষা করে এটি নিশ্চিত হতে পেরেছি, যেসব মানুষ একবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তাদের শরীরে দ্বিতীয়বার সংক্রমণ ঘটে না বললেই চলে। খুব সামান্য কিছু ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার কিছু উপসর্গ দেখা দিলেও হয়তো ওই ব্যক্তির জিহ্বায় কিংবা নাকে কিছু মাত্রায় ভাইরাস থেকে যেতে পারে। কিন্তু তার কোনো কার্যকারিতা থাকে না। অর্থাৎ কারো মধ্যে একবার করোনা ভাইরাসের এন্টিবডি তৈরি হলে পরবর্তী সময়ে তাকে আর করোনা আক্রান্ত করে কিছু করতে পারে না। এ জন্যই আমরা এন্টিবডি টেস্টের উপরে জোর দিচ্ছি, যার মাধ্যমে দেশের মানুষের কতটা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে সেটিও দেখা যাবে।’

দেশে মানুষের শরীরের বাইরে কোন বস্তুতে ভাইরাসটি কত সময় থাকে না থাকে, সেটি নিয়ে কোনো গবেষণা করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি ‘না’সূচক জবাব দেন।

দেশের আরেক আলোচিত বিজ্ঞানী ড. সমীর সাহা বলেন, ‘আমরা বড়ো ধরনের কিছু গবেষণা কাজ করছি দিন-রাত আমাদের গবেষণাগারে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা এগুলো সবাইকে জানাতে পারব। এ ছাড়া আমরা আরো ৮-১০টি জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছি। তবে আমাদের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই জিনোম সিকোয়েন্সিং করে কী লাভ আমরা পাব, সেটি বের করা-এদিকেও আমাদের এখন নজর আছে।’ মানুষের চুলে, পোশাকে কিংবা কোন বস্তুতে অথবা খাদ্যদ্রব্যে ভাইরাসটি কতটা থাকে না থাকে সেই বিষয়ে গবেষণার প্রশ্নে তিনিও ‘না’ সূচক জবাব দেন। যদিও ড. সমীর বলেন, ‘কোন বস্তু বা খাদ্যদ্রব্যের ওপর ভরসা করার দরকার নেই। যে জিনিসই হোক তা নিরাপদ করার পরেই স্পর্শ করা শ্রেয়।’

একই প্রশ্নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা এগুলো নিয়ে কিছু করিনি। কারণ মানুষের নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে যে প্রটোকল অনুসরণ করতে হয় অন্য যেকোনো বস্তু কিংবা ফল সবজির থেকে নমুনা সংগ্রহ করতেও একই প্রটোকল অনুসরণ করতে হবে, যা জটিল একটি বিষয়। তার চেয়ে বরং আমরা মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথাই বলতে চাই।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here