ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)
করোনার এই বৈশ্বয়িক মহামারিতে সারা পৃথিবী বিপর্যস্ত। আমাদের দেশেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এবং এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এরই মাঝে কিন্তু ডেঙ্গির মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এই করোনাকালীন সময়ে আমরা হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মানা, হাত ধোয়া, মাস্ক পরা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। এর পাশাপাশি এখন কিন্তু ডেঙ্গি নিয়েও আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
ডেঙ্গি কী?
ডেঙ্গি একটি মশাবাহিত রোগ, যা ডেঙ্গি ভাইরাস দ্বারা হয়ে থাকে। এই ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ (serotype) রয়েছে। যথা: DEN-1, DEN-2, DEN-3, DEN-4. প্রতিটি সেরোটাইপ দিয়ে একটি মানুষের জীবনে একবারই ডেঙ্গি রোগ হয়। অর্থাৎ কারো যদি একবার এই DEN-1 সেরোটাইপ দিয়ে ডেঙ্গি জ্বর হয়, তাহলে পরবর্তীতে এই DEN-1 বাহী কোনো মশা একজন মানুষকে কামড়ালে তার আর ডেঙ্গি হবে না। সুতরাং, সেই হিসেবে বলা যায় যে একটি মানুষের জীবনে সর্বোচ্চ চারবার ডেঙ্গি হতে পারে। আমাদের দেশে সাধারণত জুন-জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গির সংক্রমণ শুরু হয় এবং তা অক্টোবর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
ডেঙ্গির বাহক:
এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গি ছড়ায়। এডিস মশার দুটি প্রজাতি Aedes aegypti এবং Aedes albopictus মূলত এই ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক। মশাগুলোর আকৃতি কিছুটা ছোটো। এই মশাগুলো সাধারণত দিনের বেলায় বিচরণ করে। ডেঙ্গি মশা কোথাও জমে থাকা পরিস্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এই ডিমগুলো থেকে সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই লার্ভা বের হয়ে আসে। এই ডিমগুলো শুকনো পরিবেশেও প্রায় একবছর পর্যন্ত জীবন্ত থাকতে পারে। পরবর্তীতে বর্ষার সময় এই ডিমগুলো কখনও যদি আবার পানির সংস্পর্শে আসে তখন ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম থেকে লার্ভা বের হয়। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা যে ডিমগুলো পারে সেখান থেকে জন্ম নেওয়া মশায় জন্মগতভাবেই এই ডেঙ্গি ভাইরাসের বাহক হয়।
ইনকিউবেশন পিরিয়ড:
ডেঙ্গি এবং কোভিড-১৯ উভয় রোগের ইনকিউবেশন পিরিয়ড হলো গড়ে ৩-১৪ দিন। অর্থাৎ, একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে এই ভাইরাস ঢোকার ৩-১৪ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ৩-১৪ দিনের ইনকিউবেশন পিরিয়ডের বা সময়সীমার বিশেষ গুরুত্ব আছে। কোভিড-১৯ রোগের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ৩-১৪ দিন বলেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আশা অপর ব্যক্তিকেও ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকার কথা বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি সেই ব্যক্তির রোগের উপসর্গ প্রকাশ না পায় তাহলে ধরে নিতে হবে যে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও তার শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করেনি।
একই ভাবে কোনো ব্যক্তি এমন কোনো শহর বা দেশে বাস করে যেখানে ডেঙ্গি নেই। এমতাবস্থায় সে হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হলো। যদি দেখা যায় যে সে এমন কোনো শহর বা দেশে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে বেড়াতে গিয়েছিলো যেখানে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব বেশি তাহলে সেক্ষেত্রে ডেঙ্গির বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।
ডেঙ্গির উপসর্গ:
হঠাৎ করে জ্বর দিয়ে এই ডেঙ্গি রোগের উপসর্গ শুরু হয়। জ্বর সাধারণত প্রথম দিন থেকেই ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। অর্থাৎ, এই রোগে জ্বর সাধারণত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় না। জ্বর সাধারণত দুই থেকে সাত দিন থাকে। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ খেলেও তাপমাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে নামে না। জ্বরের সাথে তীব্র মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা থাকে। শতকরা ৪০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে চোখের পিছনে ব্যথা থাকে। অর্থাৎ রোগী চোখ ডানে-বায়ে নাড়ালে চোখে ব্যাথা করে। শরীর ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে এতটাই তীব্র হয় যে শরীর স্পর্শ করলেও রোগী ব্যথা অনুভব করে। চার থেকে পাঁচ দিন পর শরীরে র্যাস দেখা দেয়। এর পাশাপাশি বমি, খাবারে অরুচি, দুর্বলতা, পেটে ব্যথা এসব উপসর্গও থাকতে পারে।
- ডেঙ্গি ও কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গের মধ্যে পার্থক্য:
- সাধারণত কোভিড-১৯ রোগে জ্বর ধীরে ধীড়ে বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ প্রথম দিন থেকেই তীব্র জ্বর থাকে না। কিন্তু ডেঙ্গি রোগে জ্বর প্রথম দিন থেকেই বেশ তীব্র হয়।
- ডেঙ্গি রোগে জ্বর সাধারণত ৭ দিন থাকলেও কোভিড-১৯ রোগে জ্বর দুই সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
- ডেঙ্গি রোগে সাধারণত প্রথম থেকেই প্রচণ্ড শরীর ব্যাথাসহ বেশ দুর্বলতা থাকে। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগে শরীর ব্যথা, দুর্বলতা থাকলেও তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
- কোভিড-১৯ রোগে জ্বরের সাথে কাশি, গলা ব্যাথা থাকে। কিন্তু ডেঙ্গি রোগে সাধারণত সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি থাকে না। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গি রোগেও মাঝে মাঝে জ্বরের সাথে কাশি থাকতে পারে।
ডেঙ্গির ‘ক্রিটিক্যাল ফেজ’ কী?
অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ৩-৪ দিনের মাথায় জ্বর কমে যায় তখন কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এই সময়কে বলে ‘ক্রিটিক্যাল ফেজ’ (Critical phase). এইসময় দেখা যায় রক্তের প্লেটলেটের সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে, রক্তনালীর মধ্যে রক্তের তরল অংশ বের হয়ে যায়, ফলে রক্ত ঘন হতে থাকে, যা রক্তের haematocrit পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়। রক্তের তরল অংশ বের হয়ে যাবার কারণে রক্তচাপ কমে যায়, এমনকি রোগী শকে চলে যেতে পারে।
সুতরাং, কোনো ডেঙ্গি রোগীর যখনই জ্বর কমতে থাকবে তার পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় জটিলতাগুলোর বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যদি দেখা যায় যে কোনো ব্যক্তির জ্বর কমে গেছে বা জ্বর ভালো হয়ে গেছে কিন্তু এরপর যদি তার দুর্বলতা আরও বেড়ে যায়, সাথে রক্তচাপ কমে যায়, বারবার বমি হয়, পেট ব্যথা থাকে তাহলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে শিরা পথে স্যালাইন দিতে হবে অন্যথায় রোগীর শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে এমনকি জীবনহানিও ঘটতে পারে।
চিকিৎসা:
জটিলতা দেখা না দিলে ডেঙ্গির চিকিৎসা বাড়িতে বসেই নেওয়া সম্ভব। এই সময় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন ন্যূনতম ৬ গ্লাস পানি পান করা উচিৎ। পানি ছাড়াও তরল হিসেবে ফলের রস, ডাবের পানি, দুধ, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি পান করা যেতে পারে। জ্বর এবং শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ঔষধ খাওয়া যাবে না। জ্বরের জন্য ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পরপর ১-২টি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যাবে। এর পাশাপাশি মাথায় পানি দেওয়া যাবে, কপালে জলপট্টি দেওয়া যাবে বা শরীর স্পঞ্জ করে দিতে হবে।
- প্রতিরোধ:
- বাড়ির আশপাশে, বারান্দায়, ছাদে অথবা ঘরের ভিতরে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গি মশা যেখানে জন্মায় সে তার আশপাশে সাধারণত এক কিলোমিটারের মধ্যে বিচরণ করে। সুতরাং, আমরা প্রত্যেকেই যদি এই কোথাও পানি জমতে না দেবার বিষয়ে সচেতন থাকি তাহলে এই ডেঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
- অনেক বাড়িতে সার্ভেন্ট টয়লেট থাকে যা অনেক সময় অব্যবহৃত থাকে। সেই কমোডে জমে থাকা পানিতেও ডেঙ্গি মশা ডিম পারতে পারে। সেজন্য এরকম অব্যাবহৃত কোনো টয়লেট থাকলে তা সময়ে সময়ে একবার করে ফ্ল্যাশ করা উচিৎ।
- বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় আগাছা এসব পরিষ্কার করতে হবে।
- ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
- মশা যেন কামড়াতে না পারে সেজন্য ফুলস্লিভ জামা পরিধান করা যেতে পারে।
- [লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য) শিশু নেফ্রোলজি বিভাগ, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, ঢাকা।]