ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
বিশ্বজুড়ে এখন বড় আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশেও প্রতিদিনই বেড়ে চলছে আক্রান্তের সংখ্যা। মনে বেজে চলেছে অজানা শঙ্কা। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঘরবন্দি, অজানা ভবিষ্যতের দিন গুনছে। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা হয় যে অচিরেই তা স্বাভাবিক হচ্ছে না।
অর্থনীতি বাঁচাতে এরই মধ্যে কিছু বিধি-নিষেধ শিথিল করা হলেও এখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খোলার ইঙ্গিত দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাস মহামারির বিস্তার কমার পরই কেবল সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাববে।’ এমন অবস্থায় মার্চের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি বন্ধ থাকে, তাহলে লেখাপড়ার কী অবস্থা হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই বিষয়টি অনুধাবন করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি ।
এই মুহূর্তে দেশব্যাপী ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয়তাও আমরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তার ফসল ডিজিটাল বাংলাদেশ। এ সুযোগ ব্যবহার করে এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ডিজিটাল শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এই দুর্যোগ মুহূর্তে অনলাইন প্ল্যাটফর্মই হতে পারে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং বা ডিস্ট্যান্স লার্নিং এখন বেশ প্রয়োজনীয় বটে। ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও অনেক দেশেই এখন এটি জনপ্রিয় মাধ্যম।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এখন অনলাইনে শিক্ষাকে আরো ‘কমিউনিকেটিভ’ করা যাচ্ছে। ফলে একজন শিক্ষার্থী নিজের গতিতে শিখতে পারবে, যা তার জন্য অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ৫০-৬০ জনের ক্লাসে প্রতিটি ছাত্র ধরে ধরে শিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর মেশিন লার্নিং শিক্ষার্থীভেদে যথোপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটগুলোও এখন অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রি প্রদান করছে। বাংলাদেশ থেকেও অংশ নিয়ে অনেকেই দক্ষতানির্ভর সনদ অর্জন করছেন। করোনা সংকটে আমাদের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যুক্ত রাখতে এবং তাদের মানসিক সাপোর্টের জন্য অনলাইন ক্লাসই হতে পারে একটা কার্যকর পদ্ধতি।
সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখতে পারে। আর সেই মাধ্যম হতে পারে ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার। পৃথিবীব্যাপী শিক্ষায় প্রযুক্তি বা এডুটেকের প্রসার ঘটে চলেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় উদ্ঘাটিত হচ্ছে অভূতপূর্ব কিছু ধারণা, তৈরি হচ্ছে নতুন কৌশল, যা জ্ঞানের ভাণ্ডার তথা বিশ্বকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আমি ভার্চুয়ালি সভা করছি। কথা বলেছি আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গেও। অনলাইনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তারা জানিয়েছে ভার্চুয়ালি ক্লাস করার অভিজ্ঞতার কথা। তারা আতঙ্কিত কিংবা হতাশ না হয়ে বরং নিজেদের পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। তাদের সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, অবকাঠামোসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় একটা মাইলফলক গড়ে তোলার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। চীনের উই চ্যাট বা কিউকিউয়ের মাধ্যমে এসব ক্লাসে যুক্ত হয় শিক্ষার্থীরা। প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূর থেকেও এসব ক্লাসে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থীও।করোনাকালে আমাদের দেশেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া শুরু করেছে। গুগল ক্লাসরুম কিংবা অন্য অনেক কোলাবরেশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে শিক্ষকরা একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ইন্টার্যাকটিভ ক্লাস নিচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ দিচ্ছেন। এ ছাড়া বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করেছে। গত ৭ মে বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালানোসংক্রান্ত একটি নীতিমালা তৈরিরও উদ্যোগ নিয়েছে ইউজিসি, যা যুগোপযোগী উদ্যোগ বলেই মনে করি। এটা হলে সব কিছুই একটা কাঠামোতে চলে আসবে।
সম্প্রতি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপাচার্যদের প্রতি আহ্বান জানান, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে তারা কোনো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি পড়েছে কি না তা অবহিত করতে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, তাদের ইন্টারনেট ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস বা স্মার্টফোন না থাকার কথা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় এখনো কাক্সিক্ষত ইন্টারনেট স্পিড পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না। এ বিষয়ে কাজ করা যেতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৬৩.০৮ শতাংশ। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে দেশে এখন ১৫ থেকে ৩৫ বছরের যুব শ্রেণির সংখ্যা ৮০ মিলিয়ন (৮ কোটি)। এই জনগোষ্ঠী আগামী দুই দশক ধরে কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে পারবে। করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে এসেছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রেও তাদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বলা হয়, আমাদের দেশে প্রায় ২৬ লাখ শিক্ষিত বেকার রয়েছে, যারা দক্ষতার অভাবে কাজ পাচ্ছে না। এ বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে হবে। কেননা উদ্ভাবনীমূলক ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা থাকলে ভবিষ্যতের যেকোনো নতুন পেশা বা কাজে নিজেদের সহজে সম্পৃক্ত করা যায়। এ ব্যাপারে সবার সচেতনতা ও মনমানসিকতাও তৈরি করতে হবে।
ডিজিটাল দুনিয়ায় শেষ সীমা বলে কিছু নেই। এখানে সর্বদা নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন ও সম্পাদনচক্র চলমান থাকে। প্রয়োজনে যেকোনো সময়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা যায়। অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম দ্বারাই আমাদের মতো চিরাচরিত সমাজকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষণযোগ্য যুবগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা এবং অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি মাথায় রেখে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন, অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ-সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত দেশবাসী। তবু হাল ছাড়েনি বাঙালি। স্বপ্ন বুনছে আবার প্রকৃতি শান্ত হবে, আঁধার চলে যাবে। জেগে উঠবে অর্থনীতি। আবারও হাসবে সবাই।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর