অনলাইন ডেস্ক : মহামারি যুদ্ধের সমতুল্য। সঠিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত পুনরুদ্ধার সম্ভব, তবে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য সহায়তার প্রয়োজন হবে। কোমায় চলে গেছে বিশ্বের বেশির ভাগ অর্থনীতি। স্বাভাবিকভাবেই এটি ভাবা সহজ যে কোভিড-১৯ সংকট স্থায়ীভাবেই অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। যদিও বিগত ইতিহাসের আলোকে আমরা জানি, যদি নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয় বা মানুষেরা অসুখটি থেকে বাঁচার জন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি খুঁজে পায়, সেক্ষেত্রে কার্যকর অর্থনৈতিক জননীতি ও স্বাস্থ্যনীতির মাধ্যমে বিশ্বের সামনে থাকবে আগের স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার সমূহ সম্ভাবনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন ও ফান্স যে গতিতে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম সম্পাদন করেছিল, তা মূলত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাজার অর্থনীতি যে এর আগের অবস্থায় ফিরে আসে, সে প্রবণতার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। বিমানে করে বোমাবর্ষণের ফলে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ ৬৬টি শহর প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় আর মৃত্যুবরণ করে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নাগরিক। শহরগুলোকে সম্পূর্ণভাবে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সময় লাগে প্রায় ১৫ বছর। ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতা যত বেশি, পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ততই দ্রুত হয়। জার্মানির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের প্রত্যাবর্তন কিন্তু শুধুই উন্নত অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যেমন দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক বোমাবর্ষণ ঘটনার শিকার হয়েছিল, এর সঙ্গে তীব্র মানবিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলোও যুক্ত। তবে ২০০০ সাল পর্যন্ত তাদের বোমার আঘাতে বিপর্যস্ত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে বেঁচে যাওয়া অঞ্চলগুলোর দারিদ্র্য পরিস্থিতি, অবকাঠামো কিংবা প্রাকৃতিক ও মানব পুঁজিতে কোনো পার্থক্য ছিল না।
অর্থনীতিবিদদের কাছে এ ধরনের দ্রুত আঞ্চলিক রূপান্তর পুঁজিবাদের পক্ষে যুক্তির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। একটি অঞ্চলকে আকর্ষণীয় করে তোলার মৌলিক গুণাবলি এখানে বিদ্যমান: নদী, কেন্দ্রীয় অবস্থান, দীর্ঘ ইতিহাস আর একটি জুতসই শিক্ষা ব্যবস্থা। ব্যবসায়ীরা এখানে বিনিয়োগ করতে চাইবেন, মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে এবং শহরটির ধ্বংসের মাত্রা যত তীব্র হবে, তত দ্রুতগতিতে এর পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে।
মহামারি অনেকটা যুদ্ধের সময় বোমাবর্ষণের মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, এক্ষেত্রে অর্থনীতির সমতাসাধন মূলত বাহ্যিক শক্তি দ্বারা ঘটে। তাই করোনা-পরবর্তী এমনটা ঘটার বিষয়টি আমরা আশা করতেই পারি (অবশ্য নিকট ভবিষ্যতে যদি ভ্যাকসিন কিংবা চিকিৎসার কোনো উপায় আবিষ্কার না হয়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল আকার ধারণ করবে, পরিচালনা কার্যক্রম ঘিরে প্রতিটি ব্যবসাকে পুনরায় চিন্তা করতে হবে)। মনে রাখা দরকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক রূপান্তর কিন্তু সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব হয়নি। ইউরোপে মার্শাল প্ল্যান প্রয়োজনীয় পরিমাণে আমেরিকান অর্থায়ন এনে দেয়। যুদ্ধোত্তর চূড়ান্ত কেন্দ্রায়িত অর্থনীতির কারণে ভিয়েতনামের পক্ষে যখন যে খাতে প্রয়োজন হয়েছে, সেখানে সরাসরি অর্থায়ন সম্ভব হয়েছে। অন্য বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে, সংঘাত-পরবর্তী কোনো দেশে যদি শক্তিশালী সরকার ক্ষমতায় আসে, তবে তারা একটি শোভন মাত্রায় ন্যায্যতা উপভোগ করে (যদিও বেশ আলাদা রাজনৈতিক ব্যবস্থাসহ)।
প্রাসঙ্গিক ও চূড়ান্তভাবে বেশির ভাগ দেশেই বৈষম্যের মাত্রা ছিল স্বল্প, যা অবশ্যই যৌথ উদ্যোগ ধারণাকে উসকে দিতে অবদান রেখেছে। সম্ভবত এটি কোনো দুর্ঘটনা নয় যে যুদ্ধকালীন অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, সোমালিয়া কিংবা আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিপরীতে রাষ্ট্রগুলো আরো বেশি বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়েছে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদটা হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটের সংমিশ্রণ। জনস্বাস্থ্য সংকটের ফলে অনেক প্রাণহানি ঘটে এবং লকডাউন থেকে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক সংকট রাষ্ট্রের বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করবে এবং আগে থেকে বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বা অধিকতর খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে। আর এ থেকে ন্যূনতম সামাজিক ভারসাম্যজনক অবস্থায় ফিরে আসাটা খুব কঠিন হতে পারে।
তাছাড়া যে রাষ্ট্রগুলোয় সামাজিক সুস্থিতির অবস্থা আগে থেকেই নাজুক, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি, যেমন বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ। যাই হোক, ইতালি, ফ্রান্স আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বৈষম্য যেখানে অবক্ষয় ডেকে এনেছে এবং তিক্ততা রাজনীতির একটি বৃহৎ অংশকে গ্রাস করেছে-এ অবস্থায় তারাও সামাজিক অস্থিতিশীলতা থেকে খুব একটা দূরে নেই।
এক্ষেত্রে ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে ন্যায্যতা ধরে রাখতে আদর্শের পুননির্মাণ করতে হবে। ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি জটিল, তবে কোভিড-১৯ সংকটের জন্য অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো পরিচালনাসহ কমপক্ষে একটি উপযুক্ত নীতি-প্রতিক্রিয়া সংগঠিত করা জরুরি।
রাষ্ট্রগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে কী করতে হবে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এক ধরনের অমসৃণ ধারণা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যা করতে হবে তা হলো-প্রথমত, মহামারিটির শীর্ষ সময়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বিপর্যয় এড়ানো; দ্বিতীয়ত, অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শর্তহীন ও সর্বজনীন নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সাহায্য করা, যাতে তারা লকডাউন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে; তৃতীয়ত, কখন কোথায় ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে, তা আগে থেকে চিহ্নিত করার জন্য নিয়মিত ভিত্তিতে পর্যাপ্তসংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করা।
সন্দেহ নেই যে এটি ব্যয়সাপেক্ষ কাজ। ধনী দেশগুলোয় এক্ষেত্রে কোনো সমস্যাই হওয়া উচিত নয়। তারা যদি এটি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি হবে ইচ্ছাকৃত জখম। আর্থিক সক্ষমতাকে প্রভাবিত না করেই খুব কম খরচে তারা অর্থ ধার নিতে পারে। আমরা আশা করছি, আমেরিকা ও ইউরোপের সরকারগুলো ২০০৮ সালের শিক্ষাটা মনে রেখেছে এবং খুব শিগগিরই তারা আর্থিক ‘শৃঙ্খলা’ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাবে না।
আর্থিকভাবে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হলে দরিদ্র দেশগুলো তাদের ক্রেডিট রেটিং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। এমনকি ভারতের মতো বৃহৎ মধ্যম আয়ের অর্থনীতিও সামষ্টিক অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার পরিণতির শঙ্কায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোকে ঋণ মওকুফ ও আর্থিক সাহায্য না করা হলে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম। তাছাড়া ওষুধ ও সম্ভাব্য ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য তাদের তহবিলের প্রয়োজন হবে।
সুতরাং এ দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে অপারগ। এ মুহূর্তে বিশ্বের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি ‘কোভিড-১৯ মার্শাল প্ল্যান’ তৈরি। একমাত্র এ পথে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমেই আমাদের সামনে অন্তত করোনা-উত্তর পুনরুদ্ধার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ থাকবে এবং বহু আগে সংগঠিত শেষ ভয়ংকর মহামারি, ঐতিহাসিক মহামন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ‘ত্রিশটি গৌরবময় বছর’ (১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫; প্রবৃদ্ধির বছর) অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্তার দুফলো: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও এমআইটির অধ্যাপক
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে নেওয়া, ভাষান্তর রুহিনা ফেরদৌস
হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে এই মহামারী থেকে উদ্ধার কর আমিন
ভালো পরিকল্পনাই নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।