মর্তুজা হাসান সৈকত: গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বকে রীতিমতো ওলটপালট করে দিচ্ছে করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ যে এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে আছে, সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। বিশেষত ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সংক্রমণের সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড শয্যাগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোথাও কোথাও এখন মেঝেতেও রোগী রাখতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে যশোরে দেখলাম হাসপাতালের ভেতরের মেঝে কিংবা বারান্দাতেও শয্যা না পেয়ে রোগীর শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে গাছতলায়?
দিন যতই যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশে জীবন ও জীবিকা উভয়ের সুরক্ষার জন্যই টিকা কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন। কারণ ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার কার্যকরী উপায় একটাই- টিকা নেওয়া। টিকা আবিষ্কারের পর থেকে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, এই টিকা নিয়ে ভূ-রাজনীতির খেলা হবে, ধনী দেশগুলো আগে টিকা পাবে। হয়েছেও তাই। কারণ হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি দেশ টিকা উৎপাদন করছে। টিকা উৎপাদনের পেটেন্ট তারা কুক্ষিগত করে রেখেছে। ফলে বাকি দেশগুলোর টিকাদান কর্মসূচি নির্ভর করছে এই গুটিসংখ্যক দেশের ওপর। আর এ কারণে সৃষ্ট ভারসাম্যহীন নির্ভরশীলতার কারণে টিকার চাহিদা ও সরবরাহে দেখা দিয়েছে অসামঞ্জস্যতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে কোভ্যাক্স নামে আন্তর্জাতিক টিকাব্যাংক গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত নাটকীয় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি। তবে ভয়াবহ পরিস্থিতি অনেকটাই এড়ানো গেছে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলো এই টিকাব্যাংকের সুফল দেরিতে হলেও এখন পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে টিকাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেওয়া মাত্রই বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী ভারতের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করে দেশের মধ্যে ও বাইরে সব পক্ষের প্রশংসা কুড়ায়। ওই সময় চুক্তি অনুসারে টিকার বেশ কয়েকটি চালানও আসে। তবে এর কিছুদিন পর দেশটিতে ভাইরাসের সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয় দেশটি। ফলে গণটিকাদান কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হয়। তবে জোড়াতালি দিয়ে হলেও এর মধ্যেও করোনা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেছে সরকার। চেষ্টা করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের, যার সুফল এখন দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। সরকারের হাতে বর্তমানে ১ কোটি ডোজের বেশি টিকা মজুদ রয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, আগামী মাসের মধ্যেই আরও ২ কোটি ডোজ টিকা দেশে চলে আসবে। সবমিলিয়ে আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে ২১ কোটি ডোজ টিকা দেশে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ৭ কোটি এক ডোজের জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা।
করোনা মহামারি আগে শহরকেন্দ্রিক বেশি থাকলেও এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে গ্রামগঞ্জের মানুষ যেভাবে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে তাতে করে দ্রুততম সময়ে এসব মানুষকে টিকার আওতায় না আনা গেলে কোনোভাবেই মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এই মানুষদের ভেতরে সচেতনতা অনেক কম। তারা আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যেতেও দেরি করে। তদুপরি উপজেলা পর্যায়ে নেই করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে আগামী ৭ আগস্ট থেকে দিনে সাড়ে ৮ লাখ করে প্রতি সপ্তাহে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এজন্য দেশে বিদ্যমান সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কার্যকর করা হবে কোভিড টিকার ক্ষেত্রেও।
টিকা নিয়ে শুরুতে অনেকের মধ্যেই সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, তবে দিন যত যাচ্ছে তা অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঈদুল আজহার পর থেকে জনগণের মধ্যে টিকা নেওয়ার উৎসাহ বেড়েছে। সবচেয়ে অবিশ্বাসী মানুষটিও এখন বুঝতে পেরেছে টিকা নেওয়ার বিকল্প নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ২৯ জুলাই টিকা নিতে নিবন্ধনের জন্য বয়সসীমা ২৫ বছরে নামিয়ে এনেছে সরকার। পরবর্তীতে এখন ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। ভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনার এটাই এখন একমাত্র রাস্তা। সহজে না হলেও অনেক দৌড়ঝাঁপ, প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক তদারকিতে শেষ পর্যন্ত টিকা কর্মসূচিতে বেশ সফলভাবেই ফিরে এসেছে সরকার। এবার ভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে দেশের সাফল্য দেখার অপেক্ষা। সরকার বিশাল জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে যত দ্রুত টিকার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবে, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রক্রিয়া ততই ত্বরান্বিত হবে।