অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) ছিলেন এক বড়ো মাপের পন্ডিত ব্যক্তি, জ্ঞানের ভুবনে এক অনন্যসাধারণ দিকপাল। যিনি সত্যিকার অর্থে জ্ঞানানুরাগী (দার্শনিক), তিনি কোনো কিছুর বিনিময়েই জ্ঞানানুশীল ও সত্যানুসন্ধান থেকে বিচ্যুত হন না, হতে পারে না। সমাজ সংস্কার রাষ্ট্র ধর্ম প্রভৃতি কোনো কিছুই তাঁকে অন্ধভাবে পরিচালিত কিংবা প্রভাবিত করতে পারে না। দার্শনিক মাত্রই মুক্তবুদ্ধি ও আপষহীন চিন্তার অধিকারী। এহেন স্বাধীন সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে আজীবন জ্ঞান ও সত্যের সন্ধানে, মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ও অনুশীলনে নিয়োজিত ছিলেন বলেই গ্রিক মনীষী পিথাগোরাস ও সক্রেটিস বিশ্বময় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দার্শনিক হিসেবে। শুধু সেকালের পিথাগোরাস ও সক্রেটিসই নয়, একালের বার্ট্রান্ড রাসেল ও জ্যাঁ-পলসার্ত্র-সহ পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের কাছেই জ্ঞান ও সত্যের সাধনা, ন্যায় ও সুনীতির অনুশীলন অন্য যে কোনো জিনিসের চেয়ে বেশি মূল্যবান।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রকৃতই ছিলেন একজন জ্ঞানানুরাগী ব্যক্তি, বিদ্বৎসমাজে পরিচিতও ছিলেন জ্ঞানতাপস হিসেবে। দার্শনিক সক্রেটিস সম্পর্কে একটি মজার গল্প প্রচলিত আছে। আর সেটি হলো এই যে, একবার ডেলফির দেবতা (Oracle of Delphi) তাঁকে গ্রিসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি বলে ঘোষণা করেন। অথচ সক্রেটিস সব সময় বলতেন ‘‘আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র। একটি জিনিসই আমি জানি, আর সেটি হলো এই যে, আমি কিছুই জানিনা।’’ কিন্তু দেবতার কথা তো আর মিথ্যা হবার নয়। তাই সক্রেটিস একে একে এথেন্সের প্রায় সব লোকের জ্ঞান পরীক্ষা করে দেখলেন। তার ফল হলো এই যে, এথেনীয়রা প্রকৃতই ছিল অজ্ঞ; তবে তাদের সঙ্গে সক্রেটিসের পার্থক্য ছিল এখানে যে, সাধারণ এথেনীয়রা জানতনা যে তারা অজ্ঞ; কিন্তু সক্রেটিস জানতেন বিশ্বের অপার রহস্যের তুলনায় তাঁর জ্ঞান ছিল নিতান্তই অকিঞ্চিৎ কর, অজ্ঞতারই সামিল। আপন জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এই যে চেতনা, এই যে বিনয়, এটাই ছিল সক্রেটিসের অনন্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণ।
এখানে জ্ঞানগুরু সক্রেটিসের সঙ্গে ড. শহীদুল্লাহর বেশ একটা মিল লক্ষণীয়। এত বড়ো জ্ঞান তাপস হয়েও তিনি কখনও জ্ঞানের বড়াই করেননি; কিন্তু জ্ঞানানুরাগের কথা বলতেন অকপটে। যেমন, নিজের এই জ্ঞানানুরাগের প্রতি ইংগিত করেই তিনি একদা বলেন, ‘‘সাধারণত অবিবাহিত ব্যক্তিরাই ঘর সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে জ্ঞানানন্দ স্বামী, দয়ানন্দ স্বামী প্রভৃতি অভিধা গ্রহণ করে থাকেন। আমি তাঁদের মতো সন্ন্যাসী নই। আমার স্ত্রী আছে, ঘর-সংসার আছে; কিন্তু তবু আমি তাঁদের মতোই একজন স্বামী। আমার নাম জ্ঞানানন্দ স্বামী। জ্ঞানচর্চাই আমার আনন্দ। এখনও তাই নতুন নতুন জ্ঞান লাভে আনন্দ অব্যাহত রেখেছি।’’ তিনি আবার মজা করে বলতেন: ‘‘আমি জীবনে দুইটি বিষয়ে কার্পণ্য করিনাই, প্রথম পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে ও দ্বিতীয় অধ্যয়নে।’’
কথায় বলে, Knowledge has no geography জ্ঞানের জাত নেই, ধর্ম নেই, দেশ-কালের সীমবদ্ধতা নেই; কোনো বিশেষ ভাষার মধ্যেও তা সীমিত হয়ে থাকে না। আবহমানকালের এই জ্ঞানমন্ত্রের সার্থক প্রতিফলন দেখা যায় ড. শহীদুল্লাহর জীবন ও কর্মে। তদানীন্তন মুসলিম সমাজের একমাত্র সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত এই মনীষীর পৃথিবীর বেশ কয়েকটি ভাষায় ছিল স্বাচ্ছন্দ অধিকার। ভাষা ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতি বহু বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। মৌমাছি যেমন দিনের পর দিন নানান ফুল থেকে পরাগ আহরণে মৌচাক বোঝাই করে মধু সৃষ্টি করে, ড. শহীদুল্লাহও তেমনি সারা জীবন ইংরেজি, ফারসি, জার্মান, সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, আরবি, উর্দু, তিব্বতি, সিংহলি, হিন্দি, মৈথিলি, আসামি, উড়িয়া, বাংলা প্রভৃতি দেশ-বিদেশের ভাষা থেকে সম্পদ আহরণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। তাঁর পান্ডিত্য ছিল এতই ব্যাপক ও সুগভীর যে, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁকে যথার্থই অভিহিত করেছেন প্রাচ্য বিদ্যার এক চলিষ্ণু বিশ্বকোষ (A walking encylopaedia of oriental lore) হিসেবে এবং বলেছেন জ্ঞান-রাজ্যে মানুষ যে অসাধ্য সাধন করতে পারে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার একটি জীবন্ত উদাহরণ। শুধু জ্ঞানই নয়, তিনি ছিলেন অনেক গুণের সমবায়ে গঠিত এক মধুর ব্যক্তিত্ব, এক অখন্ড চরিত্রের অধিকারী। বস্তুত, এ মনীষীর “চরিত্রে বিদ্যা দিয়েছে অদ্ভুত বিনয়, জ্ঞান দিয়েছে উদার প্রজ্ঞা, কর্ম দিয়েছে অনাবিল কর্তব্য নিষ্ঠা এবং ধর্ম দিয়েছে মনুষ্যত্বের বহুমুখী বিকাশ।’’
দর্শন চর্চা থেকে আপনি কী শিক্ষা পেয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে মহামতি এরিষ্টটল বলেছিলেন : “অন্যেরা যা করে স্রেফ আইনের ভয়ে, তা-ই সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় করার শিক্ষা আমি পেয়েছি দর্শন থেকে।’’ এরিষ্টটলের এই উক্তিতে দার্শনিকের চিন্তা ও চরিত্রের মূল নির্যাস খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ, প্রকৃত দার্শনিক কেবল একজন তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তিই নন, বরং পুরোদস্তুর বিবেকবান ও স্বাধীন চেতা মানুষ। আর তাই কোনো বহিশক্তির আদেশ-নির্দেশে নয়, মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার বশবর্তী হয়েই তিনি প্রবৃত্ত হন জ্ঞান ও সত্যের সাধনায় এবং কোনো প্রলোভন-প্ররোচনার তোয়াক্কা না করে সদসর্বদা আত্মনিবেদিত থাকেন এ মহান ব্রতে। দার্শনিক চরিতমানসের এই অতি প্রয়োজনীয় লক্ষণটিও আমরা লক্ষ করি ড. শহীদুল্লাহর চাল-চলন, ধ্যান-ধারণা তথা সামগ্রিক জীবনাচরণে। যুক্তিপ্রসূত এবং মানবিক মূল্যবোধপুষ্ট জীবনদর্শনের প্রতি তাঁর এই নিষ্ঠা ও একাগ্রতা ছিল সর্বজনবিদিত। প্রায়শই দেখা যায় যে, পরিস্থিতি ও পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকের চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণের পরিবর্তন ঘটে, সময়ের সঙ্গে সুর মিলাতে, যুগের প্রবল প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে তাঁরা এতটুকু দ্বিধান্বিত হন না। এ ক্ষেত্রে ড. শহীদুল্লাহর অবস্থান অন্যত্র, সত্যসন্ধ নীতিবান দার্শনিকের কাতারে।
একথা ঠিক যে, দৈহিক গঠন, বেশ ভূষা, বচন-বাচন ও আচার-আচরণে তিনি ছিলেন একজন খুবই সাদাসিধা প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু আদর্শনিষ্ঠা ও সংকল্পে তিনি ছিলেন পূর্বাপর স্থির ও অবিচল। নিজের মত, পথ ও আদর্শে তাঁর আস্থা ও অংগীকার ছিল প্রগাঢ়; কিন্তু এ বিশ্বাস অন্ধবিশ্বাস নয়; যুক্তিপ্রসূত অনাবিল বিশ্বাস, যার লক্ষ্য সুনীতি ও সৎকর্ম। কথিত আছে যে, বিদেশের কোনো এক সম্মেলনে একজন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন : মুসলমানরা দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়ে কেন? উত্তরে মনীষী শহীদুল্লাহ একজন যুক্তিবাদী দার্শনিকের মতোই বলেন, ‘‘দেহের ক্ষুধা মেটাবার জন্য আমরা দিনে চারবার খাই, আর পাঁচবার নামাজ পড়ে আমরা দেখতে চাই যে, দেহের ক্ষুধার চেয়ে মানুষের আত্মার ক্ষুধা বড়ো।’’এটি অবশ্য একটি সংক্ষিপ্ত উক্তি; কিন্তু এতেই পাওয়া যায় ড. শহীদুল্লাহর মুক্তমন ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট ইংগিত। কি ভাষা, কি সাহিত্য, কি সমাজ ভাবনা, কি ধর্ম চিন্তা সর্বক্ষেত্রেই তিনি আজীবন সমান বলিষ্ঠতা, স্পষ্টবাদিতা ও সত্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন; আর এই মহৎ চরিত্র গুণই তাঁকে সর্বস্তরে মানুষের অন্তরে অভিষিক্ত করেছে একজন মহৎপ্রাণ মানুষ ও ঋষিতুল্য দার্শনিকের আসনে। আপন দেশ এবং সেই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের যথার্থ মর্যাদার দাবিতে অটল এই মনীষীর মতে, ‘‘দেশ স্বাধীন হলেই মানুষ স্বাধীন হয় না; দেশ স্বাধীন, কিন্তু তবু অনেকের মন থেকে যায় পরাধীন।’’ ‘‘আমি তাকেই স্বাধীন মন বলি, যা সবরকমের কুসংস্কার বর্জিত, যা সকল দীনতা হীনতা থেকে মুক্ত, যা দেশের মঙ্গল চিন্তায় সদা ব্যাপৃত, যা দেশের ভাইবোনদের সেবায় উল্লাসিত। ছেলেদের এই স্বাধীন মন সৃষ্টি করতে হবে, সর্বাগ্রে শিক্ষকদের নিজ মনকে স্বাধীন করতে হবে।’’
মুক্ত চিন্তা ও যুক্তিবাদিতার পাশাপাশি দর্শনের যে একটি জীবনমুখী ও কল্যাণমূলক মানবিক দিক রয়েছে ড. শহীদুল্লাহর ওপরের উক্তিটিতে তার সুস্পষ্ট নিদর্শন লক্ষ করা যায়। আমরা আগেই বলেছি যথার্থ দর্শন কেবল জ্ঞানের খাতিরে জ্ঞানানুশীলন কিংবা তত্ত্বের খাতিরে তত্ত্বানুসন্ধান নয়, সেই জ্ঞান ও তত্ত্বকে জীবনে ও সমাজে প্রয়োগের এবং মানুষের ব্যাপক কল্যাণ সাধনের ঐকান্তিক চেষ্টাও বটে। দর্শনের এই জীবনমুখী ও কল্যাণধর্মী ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতেই সক্রেটিস তাঁর বন্ধু ক্রিটোকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি যদি সত্যিই মনে করো দর্শন মানুষের অকল্যাণের হেতু, তাহলে এখনই দর্শনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেল। আর আমার মতো তুমিও যদি মনে প্রাণে বিশ্বাস কর যে দর্শনের মূল লক্ষ্য মানব কল্যাণ, তাহলে অযৌক্তিক কুসংস্কার ছেড়ে দর্শনানুরাগী হও, আমরণ দর্শনের সেবা কর।’’ জীবনের সঙ্গে দর্শনের এই যে নিকট নিবিড় সম্বন্ধ, তার ওপর জোর দিতে গিয়েই বলা হয় প্রকৃত দর্শন মাত্রই জীবনদর্শন। ড. শহীদুল্লাহ আজীবন এই কর্মকেন্দ্রিক জীবন দর্শনের প্রবক্তা ও অনুসারী ছিলেন। তাঁর মতে, কর্মচঞ্চল জীবনই সার্থক জীবন। অকর্মণ্য জীবন শুধু নিরর্থক নয়, ‘জীবন’-আখ্যা প্রাপ্তির অযোগ্য জীবন। তাঁর জন্য এটা কেবল একটা কথার কথাই ছিল না, নিজের কর্ম ও আচরণ দিয়ে তিনি এ উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। তাই দেখা যায় গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিয়োজিত থাকার অজুহাতে তিনি কখনও জীবনের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেননি, পূর্বাপর জড়িত ছিলেন বহু সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, গবেষণা ও অধ্যাপনার পাশাপাশি নিযুক্ত ছিলেন বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে। এভাবে শিক্ষাদান ও শিক্ষা-প্রশাসনে নিয়োজিত থেকেই তিনি নিজেকে অনেকটা দার্শনিক সক্রেটিসের মতোই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিদ্যার্থীদের বন্ধু, দার্শনিক ও দিশারী (friend, philosopher and guide) হিসেবে।
(চলবে)