ড. এ কে এম মাহমুদুল হক
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রই আজ বিপর্যস্ত। অর্থনীতিবিদরা বিশ্বজুড়ে কোভিড-উত্তর মহামন্দার যে আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশ তা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয়। আসন্ন সেই মহামন্দা বাংলাদেশ কতটা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে, তা দক্ষ ও কার্যকর কূটনীতি এবং সরকারের সুশাসনের ওপর নির্ভর করছে।
পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, করোনার ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। তার সঙ্গে দেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে এবং হতদরিদ্রের (যাদের দৈনিক আয় ১৬০ টাকার কম) সংখ্যা আরো ৬০ শতাংশ বেড়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ-পরিবহন শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত দেশের প্রায় পাঁচ কোটি শ্রমিক, যা মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ, তারা আজ করোনার কারণে কাজ হারিয়ে সবচেয়ে বিপর্যস্ত। বিশ্ববাজারে শত শত কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল কিংবা স্থগিত হওয়ায় পোশাক খাতে নিয়োজিত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবিকা নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রচুর প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে আসছে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরেই বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ২২ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রায়োগিক ও বাস্তবভিত্তিক সমাধান খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
বৈদেশিক শ্রমশক্তি ও পোশাকশিল্প আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। করোনা-পরবর্তী বিশ্ববাজার আরো প্রতিযোগিতামূলক হবে, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেখানে দক্ষ ও যোগ্যরাই টিকে থাকবে। তাই বিশ্ববাজারে এই দুটি খাতকেই শক্ত অবস্থানে রাখতে হবে। এ জন্য শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জোরদার এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে মনোনিবেশ করা উচিত। তা ছাড়া পোশাকশিল্পে শ্রমিক ছাঁটাই রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখা দরকার, পোশাক শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির মূল জোগানদাতা। যেভাবেই হোক জাতীয় স্বার্থে তাদের টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও জনশক্তি রপ্তানির নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি এবং চাহিদাভিত্তিক দক্ষ শ্রমিক প্রেরণের কর্মকৌশল তৈরি করা উচিত। ২০২০ সালের বিশ্ব নার্সিং রিপোর্ট অনুযায়ী, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশ্বব্যাপী আরো ছয় মিলিয়নের বেশি প্রশিক্ষিত নার্স প্রয়োজন। তা ছাড়া করোনা-পরবর্তী আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ কর্মীদের চাহিদা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে আরো গতিশীল ও সক্ষম করার লক্ষ্যে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এটি সত্য যে কোভিড-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনে আমাদের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈদেশিক সাহায্য ও কোভিড-১৯ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিকভাবে গঠিত বিভিন্ন তহবিলের ওপর নির্ভর করতে হবে। সেই তহবিল থেকে জনসংখ্যা অনুপাতে আমাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করতেও প্রয়োজন কার্যকর ও শক্তিশালী কূটনীতি। তা ছাড়া বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন ও ব্যবহার নিশ্চিত করাও জরুরি। করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশে সৃষ্ট বেকারত্বে দেশে নৈরাজ্য, বৈষম্য ও সামাজিক অপরাধ চরম আকার ধারণ করতে পারে, যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ অবস্থার উত্তরণে প্রয়োজন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, যার জন্য সরকারকে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন খাত সৃষ্টি করে প্রয়োজনে কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনা সুদে ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা বাড়াতে হবে।
তা ছাড়া হতদরিদ্র ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমজীবীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানো উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সেবাগুলো সর্বস্তরের জনগণের কাছে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের জন্য স্থানীয় সরকারের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে এবং জবাবদিহি সুনিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিবিড়ভাবে নজরদারিতে রাখতে হবে। ত্রাণের বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বর্তমানে কেন্দ্রীয়ভাবে জেলা ও সিটি করপোরেশনের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুপাতে ত্রাণের বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে অনগ্রসর অঞ্চলের অনেকেই বঞ্চিত হয়। তাই ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা ও প্রকৃত প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে জাতীয় খানা জরিপ প্রকল্পের যে উদ্যোগ ২০১৩ সালে নেওয়া হয়েছিল, তার আশু বাস্তবায়ন জরুরি।
করোনা মহামারিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে। কারণ বাড়তি আয়ের সন্ধানে পরিবারগুলো সন্তানদের কাজে লাগাবে। তাই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি ও প্রণোদনা বাড়ানো উচিত। কোভিড-পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজনে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি কমিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি যথাসম্ভব পুষিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অনলাইন শিক্ষার সম্ভাবনার দ্বার যেভাবে উন্মোচন করেছে, সরকারের শিগগিরই এর মজবুতকরণে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। যদিও সরকার এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, তবু গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে শিক্ষা প্রশাসনের একটি বাস্তবসম্মত ও প্রায়োগিক নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
করোনা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ভগ্নদশাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে শক্তিশালী করতে আশু পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়, অবকাঠামোগত সুবিধাদি বৃদ্ধি ও পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করে স্বাস্থ্য খাতকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করা সম্ভব। করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যখন মানুষ দারিদ্র্যে দিনাতিপাত করে তখন তারা গণতন্ত্রের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ গণতন্ত্রায়ণের পূর্বশর্ত হচ্ছে দারিদ্র্য নির্মূল। তাই আসন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত একেবারেই কাম্য নয়।
করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের মূল কাজ হবে অর্থনীতিকেই গুরুত্ব দেওয়া। কারণ এই অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই সুশাসন ও উন্নয়নের অন্য সূচকগুলো আবর্তিত হয়। তাই করোনার ভয়াবহ প্রভাব থেকে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে শিগগিরই একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। এই লক্ষ্যে সরকারকে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে বাস্তবসম্মত ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কাঠামোকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হবে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত সব সেক্টরের প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির সদস্য, উন্নয়ন সহযোগী, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ অংশগ্রহণ থাকবে। সঠিক সময়ের মধ্যে এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং সেই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে কার্যকর পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশে কভিড-পরবর্তী সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি অর্থনীতির গতি সঞ্চারিত হবে। তাই আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে একযোগে কাজ করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়