নরওয়ের রূপকথা

0
589

দেবতাদের বহুমূল্য রত্ন
থরের স্ত্রী ছিল সুন্দরী সিফ। থর সিফকে খুব ভালোবাসত। ভালোবাসত তার নীল চোখ আর হাসি, ভালোবাসত সিফের গ্রীষ্মের শেষে যবের রঙ্গের মতো লম্বা লম্বা সোনালী চুল। থর ঘুম থেকে জেগে উঠল আর ঘুমন্ত সিফের দিকে তাকাল। সে তার দাড়ি চুলকে কি যেন ভাবল। তারপর তার বৃহৎ হাত তুলে তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিল।
“তোমার কী হয়েছে?” সে জিজ্ঞেস করল। সিফ তার গ্রীষ্মের আকাশের মতো সুনীল চোখ মেলে তাকাল।
“কী বলছ তুমি?” সিফ বলল, সে তার মাথা নাড়াল আর তাকে হতবিহ্বল দেখাল। তার হাত তার মাথার গোলাপী ত্বকে গিয়ে ঠেকল, স্পর্শ করল আর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াল। সিফ থরের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল।
“আমার চুল”, তার গলায় আর কোনো কথা ফুটলনা। থর মাথা ঝাকাল, “নেই। সে তোমাকে ন্যাড়া বানিয়ে দিয়েছে।”
“সে?” সিফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। থর কিছুই বলল না, সে কোমর বন্ধনি মেজিওনর্ড পরে নিল, যেটি পরলে তার শক্তিমত্তা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
“লোকি” সে বলল, “এটা লোকির কাজ”।
“কেন তুমি ভাবছ এটা লোকির কাজ?” সিফ তার ন্যাড়া মাথায় বুলাতে বুলাতে বলল, যেন তার হাতের স্পর্শ মাথার চুল ফেরত আসবে। “কারণ”, থর বলল, “যখন উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে, আমি প্রথমেই ধরে নিই সেটি লোকির দোষ, এতে প্রচুর সময় বাঁচে।”
থর দেখল লোকির ঘরের দরজা লাগানো। তাই সে এক ধাক্কায় দরজা চূর্ণবিচূর্ণ করে ঘরের ভিতর ঢুকল।
সে লোকিকে শূন্যে তুলে ফেলল আর বলল, “কেন?”
“কি কেন?”, লোকির চেহারা দেখে মনে হলো, সে কিছুই জানে না।
সিফের চুল, আমার স্ত্রীর সোনালী চুল, সেগুলো খুব সুন্দর ছিল। কেন তুমি চুলগুলো কেটে দিলে?
লোকির চেহারায় হাজারো অভিব্যক্তি খেলে গেল। চাতুরি আর ধুর্ততা, নিষ্ঠুরতা আর বিহ্বলতা। থর লোকিকে জোরছে ঝাকাল। লোকি চোখ নামিয়ে নিল আর নিজেকে লজ্জিত দেখানোর ভান করল।
মজা করে করে ফেলেছি আর আমি তখন মাতাল অবস্থায় ছিলাম।
থরের ভ্রুর কুচকানি কিছুটা কমল, সিফের চুল ছিল তার গৌরব। লোকজন ভাববে শাস্তি হিসেবে তার চুল কামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
“হ্যাঁ, সেটা ঠিক, লোকজন হয়ত সেরকমই ভাববে। কিন্ত আমি যে সিফের চুল গোড়া থেকে তুলে ফেলেছি। সিফকে বাকী জীবন ন্যাড়া হয়েই থাকতে হবে।”
না, সেটা হবার নয়, থর লোকিকে মাথার উপর ঝুলিয়ে বজ্রের মতো মুখ করে তাকাল ।
“আমি দুঃখিত তাকে চুল ছাড়াই থাকতে হবে, স্কার্ফ বা টুপি লাগিয়ে..”
“সে আজীবন ন্যাড়া থাকতে পারে না” বলল থর, কারণ, লাউফির ছেলে লোকি, তুমি যদি তার চুল এখনই ফেরত না দাও, আমি তোমার শরীরের হাড় একটা একটা করে ভাঙ্গব আর যদি তার চুল ভালোভাবে না গজায়, আমি আবার ফিরে আসব আর তোমার শরীরের সব হাড় আবার ভাঙ্গবো, বারবার ভাঙ্গবো, প্রতিদিন যদি আমি এটা করি, আমি দিনদিন আরো ভালোভাবে এটা করতে পারব, থর উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলে চলল।
না, লোকি বলে উঠল, আমি সিফের চুল ফিরিয়ে দিতে পারব না, এটা সম্ভবপর নয়।
আজ যদি তোমার শরীরের সব হাড় আমি ভাঙ্গি, ঘন্টাখানেক লাগতে পারে, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, প্রতিদিনের প্র্যাকটিস এটা আমি ১৫ মিনিটে নামিয়ে আনতে পারব, বিষয়টা খুবই মজাদার হবে আশা করি, থর লোকির হাড় ভাঙ্গার প্রস্তুতি নিল।
বামনরা পারবে, লোকি তীব্র চিৎকারের সাথে জানাল। কী?
বামনরা, তারা সবকিছু বানাতে পারে। তারা সিফের সোনালী চুল বানাতে পারবে। সেটা তার খুলির সাথে লেগে যাবে আর স্বাভাবিক ভাবে বাড়বে। তারা পারবে, কসম করে বলছি, তারা পারবে।
তাহলে, জবাব দিল থর, তুমি যাও আর তাদের সাথে কথা বলো। সে লোকিকে মাথার উপর থেকে মাটিতে ফেলে দিলো। লোকি কোনোক্রমে তার দুপায়ের উপর খাড়া হলো আর থর তার দু-চারটা হাড় ভাঙ্গার পূর্বেই দ্রুত পালাল।
সে তার জুতা পরে নিল, যেটা তাকে আকাশে ভ্রমন করাতে পারে। সে সোজা সারটালহাইমে গেল, যেখানে বামনদের কারখানা অবস্থিত। ইভালদির ছেলেরা, তিন ভাই, সবচেয়ে সুদক্ষ বামন, মনে মনে ভবল লোকি।
লোকি তাদের ভূগর্ভস্থ কামারশালায় গেল।
“হ্যালো, ইভালদির পুত্ররা। আমি আশেপাশের সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বলল যে, ব্রুক তার ভাই এইত্রি নাকি সবচেয়ে সুদক্ষ বামন কারিগর”।
“না”, ইভালদির ভাইয়েদের একজন বলল, “আমরা ভাইয়েরাই সবচেয়ে সুদক্ষ কারিগর”।
“আমি নিশ্চিত, ব্রুক আর এইত্রি তোমাদের মতই নিখুত রত্ন তৈরী করতে পারে”।
“মিথ্যা কথা” সবচেয়ে লম্বা ভাই জবাব দিল, “হাত কাপাঁ নিস্কর্মার দল, আমি তাদের দিয়ে একটা ঘোড়ার নাল লাগাতেও রাজি নই”। সবচেয়ে খাটো আর বুন্ধিমান ভাই মাথা ঝাকাল আর বলল, “তারা যেটা বানাবে আমরা তাদের চেয়ে ভাল কিছু বানাব”।
“আমি শুনেছি তারা তোমাদের চ্যালেঞ্জ করেছে” লোকি বলল। “তিনটি রত্ন, দেবতারা বিচার করবেন কে সবচেয়ে ভাল বানাল। ভাল কথা, এর মধ্যে একটি রত্ন হতে হবে চুল , সর্বদা বাড়ন্ত, নিখুত, সোনালী চুল।”
“আমরা সেটা বাাতে পারব”, এক ইভালদি ভাই জবাব দিল।
লোকি পাহাড়ের অপরপাশে আরেক বমন ব্রুকের কারখানায় গেল সেখানে ব্রুক আর এইত্রি দুই ভাই কাজ করে।
ইভালদি ভাইয়েরা এসগার্ডের দেবতাদের উপহার দেয়ার জন্য তিনটি রত্ন তৈরী করছে। দেবতারা রত্নগুলো বিচার করবেন। ইভালদি ভাইয়েরা তোমাকে বলতে বলেছে যে তাদের মত রত্ন তোমরা কিছুতেই বানাতে পারবে না। তারা তোমাদের হাত কাপা নিস্কর্মার দল বলে গালি দিয়েছে।
ব্রুক বোকা ছিল না। “বিষয়টা আমর কাছে খুবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে”, সে বলল, “তুমি নিশ্চিত এই ঘটনা তোমার বানানো নয়? আমাদের আর ইভালদির ভাইদের মধ্যে ঝামালো লাগানোটা মনে হচ্ছে তোমার মত লোকেরই কাজ”।
লোকি একান্ত নিরীহ ভাব ধরল,“আমি কিছুই করিনি। আমি শুধু ভাবলাম বিষয়টা তোমার জানা দরকার ”।
“এবং এতো তোমার কোন স্বার্থ জড়িত নেই”? ব্রুক জিজ্ঞেস করল।
“একেবারেই না”
ব্রুক সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল আর লোকির দিকে তাকাল । ব্রুকের ভাই এইত্রি ছিল সুদক্ষ কারিগর , কিন্তু ব্রুক ছিল বুদ্ধিমান আর দৃঢ়চিত্ত। “ঠিক আছে, দেবতাদের বিচারে ইভালদির ভাইদের সাথে দক্ষতার পরীক্ষয় যেতে আমরা খুশিমনে রাজি, আমার কোন সন্দেহ নেই যে, ইভালদির ভাইদের চেয়ে ভাল রত্ন এইত্রি বানাতে পারবে। কিন্তু চল আমরা বিষয়টি ব্যক্তিগত ভাবে বিবেচনা করি।” “তোমার মনে কি আছে, বলে ফেল”, বলল লোকি।
“তোমার মাথা” বলল ব্রুক, ”যদি আমরা পরীক্ষায় জিতি, আমরা তোমার মাথা চাই। তোমার মাথায় অনেক কিছু ঘুরছে। আমি নিশ্চিত, এইত্রি তোমার মাথাটা দিয়ে চমৎকার একটা যন্ত্র বানিয়ে ফেলতে পারবে। একটা ভাবনা চিন্তা করতে পারা মেশিন অথবা একটা সুন্দর কালির দোয়াত”।
লোকি হাসল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভড়কে গেল।
দিনটা ভাল ভাবেই শুরু হয়েছে। তাকে শুধু নিশ্চিত করতে হবে পরীক্ষায় এইত্রি আর ব্রুক যাতে হেরে যায়। দেবতারা বামনদের কাছ থেকে ছয়টি চমৎকার রত্ন পাবে । সীফ তার সোনালী চুল ফেরত পাবে । হ্যাঁ, সে কাজটা করতে পারবে, সে লোকি।
“অবশ্যই , সে বলল” আমার মাথা, আমার মাথাই তোমরা পাবে।”
পাহাঢ়ের অন্য পাশে ইভালদির ছেলেরা তাদের রত্ন তৈরী করছিল। তাদের নিয়ে লোকির কোন দুশ্চিন্তা ছিল না । তাকে নিশ্চিত করতে হবে , ব্রুক আর এইত্রি যাতে কিছুতেই জিততে না পারে। (চলবে)
নীল গেইম্যানের ‘নর্স মিথলজী’ থেকে অনূদিত।
অনুবাদ: সালাহ উদ্দিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here