নরওয়ের রূপকথা

0
439

দেবতাদের বহুমূল্য রত্ন-৩
এসগার্ডে, তিনজন দেবতা সিংহাসনে আসীন। একচক্ষু দেবতা বিশ^পিতা ওডিন, বজ্রের দেবতা লাল দাড়িওয়ালা থর, গ্রীষ্মের ফসলের দেবতা সুদর্শন ফ্রে। তারা তিনজন আজ বিচারকের ভূমিকায়।
তিন জমজ আর একই রকম দেখতে ইভালদির পুত্রদের পাশে লোকি দাঁড়িয়ে।
কালো দাড়িওয়ালা, কি নিয়ে যেন চিন্তামগ্ন, ব্রুুক, একপাশে একা দাঁড়িয়ে ছিল। তার আনা রত্নগুলো রেশমি চাদরে ঢাকা।

“তাহলে, আমরা কি বিচার করছি আজ?” ওডিন বলল।
“রত্ন”, বলল লোকি, “ইভালদিরি পুত্ররা মহামান্য ওডিন, থর আর ফ্রের জন্য উপহার এনেছে। এইত্রি আর ব্রুকও উপহার এনেছে। আপনাদের সিন্ধান্ত নিতে হবে এই ছয়টি জিনিসের মধ্যে কোনটি সবচেয়ে চমৎকার রত্ন। আমি নিজে ইভালদির ছেলেদের বানানো উপহার আপনাদের নিকট পেশ করব।”
সে ওডিনকে ‘গাংনির’ নামক বর্শা উপহার দিল। বর্শাটির ঢেউ খেলানো হাতলে সুন্দর ডিজাইন করা ছিল ।
এটি সবকিছুকে ভেদ করতে পারে, আর আপনি যদি এটা নিক্ষেপ করেন, এটি সবসময়ই নিশানায় পৌছাবে, বলল লোকি।

একচোখ থাকার কারণে ওডিনের অস্ত্রের নিশানা সর্বদা নিখুঁত হতো না।
ওডিন, বর্শাটি নেড়েচেড়ে দেখে, “এটি খুবই চমৎকার”, ওডিন এতটুকুই শুধু বলল।
এবার, লোকি গর্বের সাথে বলল, এক মাথা সোনালি চুল যা আসল স্বর্ণের তৈরী। এটা যার প্রয়োজন, তার মাথায় এই চুল আটকে যাবে আর আসল চুলের মতো দেখাবে আর বড়ো হবে, এক লক্ষ স্বর্ণের চুল।
“আমি এটা পরীক্ষা করব”, বললো থর, “সীফ এদিকে এসো”।
সীফ তার আসন থেকে উঠে এলো। তার মাথা স্কার্ফে ঢাকা দেওয়া ছিল। সে তার মাথার স্কার্ফ সরাল। দেবতারা সীফের ন্যাড়া মাথা দেখে আঁতকে উঠল। সীফ সাবধানে বামনের তৈরী চুলের গোছা তার মাথায় লাগাল আর চুল ঝাড়ল। সবাই দেখল সোনালি চুলের উইগটি সীফের মাথার খুলির সাথে লেগে গেল। সীফ উঠে দাঁড়াল আর তাকে আগের চেয়ে আরো বেশি উজ্জ্বল আর সুন্দর দেখাচ্ছিল।
“খুবই চমৎকার”, বলল থর, “খুব ভাল কাজ হয়েছে”।

সীফ তার সোনালি চুল ঝাড়ল আর সূর্যের আলোতে বেরিয়ে গেল, তার বন্ধুদের নিজের নতুন চুল দেখাতে।
শেষ অসাধারণ উপহারটি ছিল ছোটো আর কাপড়ের মত ভাজ করা। কাপড়টি লোকি ফ্রের সামনে রাখল।
“এটা কি? এটাতো একটা সিল্কের স্কার্ফ বলে মনে হচ্ছে” বলল ফ্রে, তাকে মোটেই সন্তুষ্ট দেখাল না।
“এটাকে স্কার্ফের মতো দেখায় ঠিকই”, বলল লোকি, “কিন্তু তুমি যদি এটাকে খোল তুমি দেখবে এটা আসলে একটা জাহাজ, এর নাম “স্কিডব্লাডনির। এটা সব সময় ভাল বাতাস পাবে, যেখানেই থাকুক না কেন। যদিও এটা অনেক বড়ো, সবচেয়ে বড়ো জাহাজ, যদি তুমি এটাকে ভাজ করে রাখ, দেখতেই পাচ্ছ, এটাকে তোমার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে পারবে।”

ফ্রেকে সন্তুষ্ট দেখাল, আর লোকি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, তিনটা উপহারই অসাধারণ ছিল।
এবার ব্রুকের পালা। তার চোখের পাতা লাল আর ফোঁলা আর তার ঘাড়ের পাশে বড়ো একটা পোকার কামড়ের চিহ্ন। লোকি মনে মনে ভাবল, ইভালদির ছেলেদের দেওয়া অসাধারণ রত্ন দেখানোর পর ব্রুকের আত্মবিশ^াসের মাত্রা একটু অতিরিক্তই মনে হচ্ছে।

ব্রুক স্বর্ণের বাহুবন্ধনীটি তুলে নিল আর ওডিনের উচু সিংহাসনের সামনে রাখল।
“এই বাহুরবন্ধনীটির নাম ড্রপনির”, বলল ব্রুক, “কারণ প্রতি নবম রাতে এই রিং থেকে একই রকম আটটি রিং খসে পড়বে। আপনি সেগুলো লোকজনকে উপহার দিতে পারবেন অথবা আপনার সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।”
ওডিন বাহুবন্ধনীটি হতে নিয়ে ভালো করে দেখল, সেটিকে তার হাতের বাহুতে পরে নিল। বাহুবন্ধনীটি ওডিনের হাতে চমকাতে লাগল। “এটা খুবই চমৎকার”, বলল সে।
লোকি স্মরণ করল বর্শার ব্যাপারেও ওডিন একই কথা বলেছিল।
ব্রুক ফ্রের কাছে গেল। সে কাপড় তুলল আর একটি সোনালি লোমযুক্ত বৃহৎ বরাহ বের করল।
“এই বরাহকে আমার ভাই আপনার রথ টানার জন্য বানিয়েছে,” বলল ব্রুক, “এটি আকাশে আর সমুদ্রে ছুটতে পারে দ্রুততম ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগতিতে। গভীর অন্ধকার রাতেও এর সোনালি পশম আলো ছড়াবে আর আপনি সবকিছু চমৎকার দেখতে পাবেন। এটি কখনো ক্লান্ত হবে না এবং আপনাকে হতাশ করবে না। এ নাম গুলেনবাস্টি, স্বর্ণের লোমযুক্ত পশু।”

ফ্রেকে চমৎকৃত দেখাল। কিন্তু লোকি ভাবল, ভাজ করে রাখা কাপড়ের জাহাজ দেখে যতটা খুশি হয়েছিল, অন্ধকারে আলো দেওয়া দ্রুতগামী স্বর্ণের বরাহ দেখে হয়ত ততটা খুশি সে হয়নি। লোকির মাথা অনেকটাই নিরাপদ এবং ব্রুক শেষের যে উপহারটা এনেছে, সেটাকে সে নষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছে।
কাপড়ের নিচ থেকে ব্রুক একটা হাতুড়ি বের করল, আর থরের সামনে রাখল। থর হাতুড়ির দিকে তাকাল আর নাক সিটকালো।

“এটার হাতল অনেক ছোট”, বলল সে।
ব্রুক সম্মতি সূচক মাথা নাড়াল, হ্যা বলল সে। “এটা আমারই দোষ আমি হাঁপর চালাচ্ছিলাম। কিন্তু এটাকে বাতিল করার আগে এই হাতুড়ির অনন্য গুণ সম্পর্কে বলতে দিন। “এর নাম ‘মিওলনির’ , বজ্র সৃষ্টিকারী। প্রথমত এটি ভাঙ্গা অসম্ভব , আপনি যত জোরেই এটাকে আঘাত করুন না কেন এটির কোনো ক্ষতি হবে না”।
থরকে আগ্রহী মনে হলো, সে ইতোমধ্যে অনেক অস্ত্রই ভেঙ্গেছে, অন্য অস্ত্রের উপর আঘাত করে ।
“আপনি যদি হাতুড়িটি নিক্ষেপ করেন এটা কখনোই তার নিশানা কে মিস করবে না।”
অনেক বছর ধরেই থর প্রচুর উৎকৃষ্টমানের অস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, বিরক্তির সাথে লক্ষ্য করেছে সেগুলোর অনেকগুলো নিশানা মিস করেছে। কিছু তো অনেক দূরে উড়ে যেতে দেখেছে, যেগুলো আর ফেরত পাওয়া যায়নি।

“ আপনি যত জোরেই নিক্ষেপ করুন অথবা যত দূরেই পাঠান এটা সর্বদা আপনার হাতে ফেরত আসবে।”
থরকে এবারে মুচকি হাসতে দেখা গেল আর বজ্রদেবতা থর কদাচিৎই হাসেন।
“আপনি হাতুড়িটির আকার ও পরিবর্তন করতে পারবেন। এটা অনেক বড়ো হবে, আবার এত ছোটও হবে যে, এটাকে আপনার পোশাকের ভিতর ঢুকিয়ে রাখতে পারবেন।”
থর আনন্দিত হয়ে তালি বাজাল আর সমগ্র এসগার্ড বজ্রের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হল।
“কিন্তু তবুও যেমন দেখছেন”, ব্রুক বিষন্ন মুখে বলল, “হাতুড়ির হাতল খুবই ছোটো হয়ে গেছে। আমারই দোষ, আমি হাঁপর ঠিকমত চালিয়ে যেতে পারিনি যখন আমার ভাই এইত্রি এটা বানাচ্ছিল।
“হাতল ছোটো হয়ে যাওয়া খুবই একটি নগন্য সমস্যা”, বলল থর, “এই হাতুড়ি আমাদের তুষার দানবদের হাত থেকে রক্ষা করবে । আমার দেখা এটাই সবচেয়ে চমৎকার উপহার।”
“এটা এসগার্ডকে সুরক্ষা দেবে, এটা আমাদের সাবাইকে রক্ষা করবে”, সম্মতি জানিয়ে ওডিন বলল।
“আমি যদি তুষার দানব হতাম , এই হাতুড়ি হাতে থরকে আমি খুবই ভয় পেতাম”, ফ্রে বলল।
“হ্যাঁ, এটি একটি উৎকৃষ্ট হাতুড়ি। কিন্তু সেই সোনালি চুলগুলো? সীফের নতুন সুন্দর সোনালি চুল?” লোকি কিছুটা নিরুপায়ের মত জানাতে চাইল।
“কি? ও হ্যা, আমার স্ত্রীর চুলগুলো খুব সুন্দর হয়েছে”, বলল থর। “ব্রুক, এখন আমাকে দেখাও, হাতুড়টি কিভাবে বড়ো ছোটো করা যায়”।

“আমার চমৎকার বর্ষা ও সুন্দর বাহুবান্ধনীর চেয়েও থরের হাতুড়ি উৎকৃষ্ট হয়েছে”, ওডিন সম্মতি জানাল।
“থরের হাতুড়ি আমার জাহাজ আর বরাহের চেয়েও চমৎকার আর উৎকৃষ্ট হয়েছে”, স্বীকার করল ফ্র্রে “এটা এসগার্ডের দেবতাদের নিরাপদ রাখবে”।
দেবতারা ব্রুকের পিঠ চাপড়ে প্রশংসা করল আর জানাল সে আর এইত্রি সবচেয়ে চমৎকার উপহারটি তৈরী করেছে আর সেটি দেবতাদের উপহার দেওয়ায় তারা খুব খুশি হয়েছে।
“জেনে খুব আনন্দিত হলাম”, বলল ব্রুক, সে লোকির দিকে ফিরল।
তাহলে বলল ব্রুক, “আমি এখন তোমার মাথা কাটব, লাউফির পুত্র এবং সেটা সাথে করে নিয়ে যাব, এইত্রি খুবই খুশি হবে। মাথাটা দিয়ে আমরা একটা প্রয়োজনীয় জিনিস বানতে পরব।
“আমি আমার মাথার ক্ষতিপূরণ দেব”, বলল লোকি, “আমি তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব”।
“আমার আর এইত্রির ধনরত্ন অনেক আছে, আমরা রত্ন বানাই”, বলল ব্রুক, “না লোকি, আমি তোমার মাথাই চাই”।

লোকি এক মূহুর্ত ভাবল. তারপর বলল, “তাহলে তুমি আমার মাথাটা পাবে, যদি আমাকে ধরতে পার”।
লোকি শুন্যে সবার মাথার অনেক উপরে লাফিয়ে উঠল আর মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেল।
ব্রুক থরের দিকে তাকাল, “তুমি কি তাকে ধরে আনতে পারবে?”
থর মাথা ঝাকাল, “আমার এটা করা উচিত হবে না”, সে বলল, “কিন্তু আমি আমার হাতুড়িটাও যে চাই।”
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই থর লোকিকে শক্ত করে পাকড়াও করে ফিরে এল, লোকি নিস্ফল রাগে ফুঁসছিল।
বামন ব্রুক তার ছুরি বের করল, “এখানে এসো লোকি,” সে বলল, “আমি তোমার মাথাটা এখন কাটব।”
অবশ্যই, বলল লোকি, “তুমি অবশ্যই আমার মাথা কাটতে পার, কিন্তু আমি মহামান্য ওডিনের কাছে প্রার্থনা করব …, যদি তুমি আমার গলা কাট, তুমি আমাদের মধ্যে হওয়া চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করবে, যেটায় বলা আছে তুমি আমার মাথা কাটবে, শুধু মাথা আর অন্য কিছু না।
ওডিন মাথা ঝাঁকাল, “লোকি ঠিক বলেছে, তার গলা কাটার কোনো অধিকার তোমার নেই”।
ব্রুক বিরক্ত হলো, “কিন্ত গলা না কেটে আমি তার মাথা কীভাবে কাটব ?” সে বলল।
লোকিকে খুশি দেখাল। দেখ, বলল সে, “লোকজন যদি জানত কিভাবে কথা বলতে হয় , তারা লোকির সাথে কখনো লাগতে আসত না। সবচেয়ে জ্ঞানী লোকি, বুদ্ধিমান, চালাক, সুদর্শন লোকি…”
ব্রুক ওডিনের কানে ফিসফিস করে কি যেন বলল এটা ন্যায্য কথা একমত হল ওডিন।
ব্রুক এক টুকরো চামড়া আর একটা ছুরি বের করল । সে চামড়াটা লোকির মুুখের চারপাশে জড়াল। ব্রুক ছুরি দিয়ে চামড়াটা ফুটা করার চেষ্টা করল।

“এটা কাজ করছে না” , ব্রুক বলল, “আমার ছুরি তোমাকে কাটতে পারছে না”।
“আমি হয়ত ছুরি থেকে বাঁচার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি”, লোকি নিরীহভাবে বলল, “মাথা-কাটা-যাবে,গলা-কাটা-যাবে-না, প্লানটি যদি কাজ না করে, সেজন্য আগেই সাবধান ছিলাম, আমি দুঃখিত যে, কোনো ছুরিই আমাকে কাটতে পারবে না”।

ব্রুক রাগে গজরালো আর একটা জুতা সেলাইয়ে বাঁকা সুঁই বের করল। সুঁইটি সে চামড়া আর লোকির ঠোঁটসহ ফুঁড়ে দিল। তারপর সে একটি শক্ত সুতো বের করল আর সেটি দিয়ে লোকির ঠোঁট দুটো সেলাই করে দিল।
অভিযোগ করতে অক্ষম, ঠোট শক্ত করে সেলাই করা লোকিকে পিছনে ফেলে ব্রুক ফিরে গেল।
চামড়া দিয়ে সেলাই করা ঠোটের ব্যথার চেয়েও কথা না বলতে পারার যন্ত্রণা অনেক বেশি মনে হচ্ছিল লোকির কাছে।

সুতরাং এখন তোমরা জান, কিভাবে দেবতারা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নগুলো লাভ করেছিল। এটা ছিল লোকির দোষ। এমনকি থরের হাতুড়িও লোকির দোষে পাওয়া। এটাই হলো লোকির কাহিনী। যখন তুমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাক, তখনও তাকে ঘৃনা করো আর যখন তুমি তাকে ঘৃণা করো, তখনও তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাক।
(চলবে)

নীল গেইম্যানের ‘নর্স মিথলজী’ থেকে অনূদিত
অনুবাদক: সালাহ উদ্দিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here