দেওয়ানবাগ ডেস্ক: বাঙালির মননের প্রতীক, শিক্ষাবিদ, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আর নেই। গত ১৪ মে, বৃহস্পতিবার রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। কীর্তিমান এ মানুষটির মৃত্যুতে দেশে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
তিনি নেই কিন্তু তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন। জীবিতকালে অমরত্ব লাভ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার সারাজীবনের কাজ দিয়ে জীবিতকালেই অমরতা লাভ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতেই তা নিঃশেষ হয়ে যাবে না, যেতে পারে না।
একটি জাতি, রাষ্ট্র কিছু কিছু মানুষের পথনির্দেশনায় গড়ে ওঠে। সেইসব ক্ষণজন্মা পুরুষ তাদের সারাজীবনের অর্জিত জ্ঞান দেশের জন্য নিয়োজিত করেন। তাদের সৃজনীশক্তি, মননশীলতা ও জ্ঞানের ওপরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জাতির মনন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার চিন্তা ও কর্ম দিয়ে বাঙালি সমাজকে আধুনিক মূল্যবোধ ও স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি তাঁর চলায়, বলায় অশিক্ষা, ক‚পমুন্ডকতা দূর করে মানুষের মনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাতি জ্বালাতেন। মৌলবাদ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ক্লান্তিহীনভাবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। আমাদের ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে, গদ্যবিকাশের পর্বে, ব্যাকরণ ও প্রকাশ পদ্ধতির ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য গবেষণা আমাদের দিক নির্দেশক হয়ে উঠেছে। বাঙালির গৌরব, বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম অহংকার যে মুক্তিযুদ্ধ, সেখানেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি।
ড. আনিসুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই ফুসফুসে সংক্রমণসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভূগছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ছেলে আনন্দ জামান জানান, গত বুধবার সকাল থেকেই তার পিতার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। দুপুরে তিনি বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। সিএমএইচের চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সিত্যেও তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং একমাত্র ছেলে আনন্দ জামানসহ অংসখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা তাকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও প্রধানমন্ত্রীকে বক্তৃতার মধ্যে তাকে ‘চাচা’ সম্বোধনে ডাকতে দেখা গেছে।
তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শোক বার্তায় শিক্ষা ক্ষেত্রসহ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, ‘তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে হারালো। মহান মুক্তিযদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতি তার অবদান চিরদিন স্মরণ রাখবে। তার মৃত্যু জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী ও সম্মাননা
আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী কলকাতার পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। তিনি প্রত্যক্ষভাবে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিযে তাঁর গবেষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অংশ ছিলেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।
তাঁর বাবার নাম এ টি এম মোয়াজ্জেম। তিনি ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন, গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। আনিসুজ্জামানরা ছিলেন পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। বলা যায়, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ছিল তাঁদের পরিবার।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রিধারী এই শিক্ষাবিদ গবেষণা করেছেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়েও। গবেষণা গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কাজের জন্য ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮৫ সালে একুশে পদক পান এই মুক্তিযোদ্ধা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে। এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।
জাতি হারালো এক জ্ঞানী গুণিকে
ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাহি রাজিউন!!
মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনাসহ শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি!