পবিত্র কুরআনের বাংলা পদ্যানুবাদ ও নজরুল

0
804
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

মুহাম্মদ জহিরুল আলম

প্রভুকে পাওয়ার বাসনা মানুষের চিরন্তন। প্রতিটি ধর্মের মর্মবাণী হতে আমরা এ শিক্ষাই পাই। যুগে যুগে মহামানবগণ প্রভুর প্রেরিত ঐশী বাণী প্রচারের মাধ্যমে তাঁকে পাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দেন। সমকালীন যুগের মানুষের ধর্মই ছিল সে শিক্ষাকে গ্রহণ করা। মহান আল্লাহ্, দয়াল রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। মানবজাতির মুক্তির সনদ এ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, “আল্লাহ্ আসমান ও জমিনের নুর। তাঁর নুরের উপমা এমন-একটি তাক বা প্রদীপদানি, যাতে আছে একটি প্রদীপ। যে প্রদীপটি একটি স্বচ্ছ কাঁচের (হৃদয়ের) মধ্যে অবস্থিত।” (সুরা আল নূর ২৪ : আয়াত ৩৫)। দয়াময় আল্লাহ্ নিজেকে প্রকাশের জন্য কতইনা সুন্দর উপমা ব্যবহার করেছেন। ভাষার সুন্দর প্রয়োগে তা আরো হৃদয়াঙ্গম হয়ে উঠৈছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন বুঝতে না পারার কারণে তা অধরাই থেকে যায়, তাই প্রয়োজন মাতৃভাষায় কুরআন শিক্ষা। এ বিষয়টি কবি নজরুল-কে ব্যাপকভাবে তাড়িত করেছিল।

নজরুলের সাহিত্য ও সঙ্গীতের সর্বত্র প্রভুর প্রেমের আকুতি ফুঁটে উঠে। যা তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন-
‘আমি ছিনু পথ-ভিখারিনী, তুমি কেন পথ ভুলাইলে,
মুসাফির-খানা ভুলায়ে আনিলে কোন্ এই মঞ্জিলে?
মঞ্জিলে এনে দেখাইলে কার অপরূপ তস্বীর,
‘তসবি’তে জপি যত তার নাম তত ঝরে আঁখি-নীর!
‘তশবীহি’ রূপ এই যদি তার ‘তন্জিহি’ কিবা হয়,
নামে যাঁর এত মধু ঝরে, তাঁর রূপ কত মধুময়।
কোটি তারকার কীলক রুদ্ধ অম্বর-দ্বার খুলে
মনে হয় তার স্বর্ণ-জ্যোতি দুলে উঠে কৗতূহলে।
ঘুম-নাহি-আসা নিঝ্ঝুম নিশি-পবনের নিশ্বাসে
ফিরদৌস-আলা হ’তে যেন লালা ফুলের সুরভি আসে।
চামেলী যুঁই-এর পাখায় কে যেন শিয়রে বাতাস করে,
শ্রান্তি ভুলাতে কী যেন পিয়ায় চম্পা-পেয়ালা ভরে।’

তিনি মানুষের মাঝে সে প্রেমই সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তারই বহিপ্রকাশ ‘কাব্য আমপারা’। কুরআন শরীফের অনুবাদ করতে গিয়ে কবি আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি কোনো কোনো সূরার অর্থ অবিকৃত রেখে সম্প্রসারণ করেছেন। তবে যথার্থ অর্থ সবখানেই ঠিক রেখেছেন। তিনি ‘শানে নজুলে’ সূরার আয়াত, শব্দ ও অক্ষর সংখ্যা তুলে ধরেছেন। আজ আমরা আরো কয়েকটি সূরার পদ্যানুবাদ দেখব।

সূরা ইখ্লাস
(৪টি আয়াত ও ১টি রুকূ, মক্কী)

শুরু করিলাম পূত নামেতে আল্লাহ্র,
শেষ নাই সীমা নাই যাঁর করুণার!
১. বল, আল্লাহ্ এক! প্রভু ইচ্ছাময়,
২. নিষ্কাম নিরপেক্ষ, অন্য কেহ নয়।
৩. করেন না কাহারেও তিনি যে জনন,
৪. কাহারও ঔরস জাত তিনি নন।
৫. সমতুল তাঁর
৬. নাই কেহ আর।
এ সূরা মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়েছে। এতে ৪টি আয়াত, ১৭টি শব্দ, ৪৯টি অক্ষর ও ১টি রুকু আছে। নজরুল সূরার প্রথম চরণে ‘প্রভু ইচ্ছাময়’ শব্দ দুটি সংযোজন করেছেন। দ্বিতীয় চরণে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হবার প্রসঙ্গটি বর্জন করে ‘নিষ্কাম, নিরপেক্ষ, অন্য কেহ নয়’ করেছেন। কবি শানে নজুলে বলেন, মক্কার অধিবাসী কিছু কাফের, হযরত রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিল, আল্লাহ্ কি উপাদানে গঠিত? তিনি কি আহার করেন? তাঁর জনক কে? ইত্যাদি। তদুত্তরে এই সূরা নাজিল হয়। নজরুল এখানে উল্লেখ করেন, ‘সামাদ’ অর্থ যিনি পান-আহার করেন না। তিনি এই শব্দের অন্যান্য অর্থের কথাও বলেছেন- অভাব রহিত, শ্রেষ্ঠতম, অনাদি, নিষ্কাম, অনন্ত ইত্যাদি। এখানে আরো উল্লেখ হয়েছে, অল্লাহ্ কারো মুখাপেক্ষী বা সাহায্যপ্রার্থী নন, সকলেই তাঁর সাহায্যপ্রার্থী। তিনি বে-নেয়াজ। এ সূরায় অংশীবাদী ও পৌত্তলিকদের মতবাদকে খন্ডন করা হয়েছে। কবীর, কাশ্শাফ ও বায়জাবীর মতামতকে তিনি গ্রহণ করেছেন।

সূরা লাহাব
(৫টি আয়াত ও ১টি রুকূ, মক্কী)

শুরু করি নামে সেই আল্লাহর,
করুণা- নিধন যিনি কৃপার পাথার
১. ধ্বংস হোক আবু লাহাবের বাহুদ্বয়
২. হইবে বিধস্ত তাহা হইবে নিশ্চয়।
৩. করেছে অর্জন ধন সম্পদ সে যাহা
৪. কিছু নয় কাজে তার লাগিবে না তাহা।
৫. শিখাময় অনলে সে পশিবে ত্বরায়
৬. সাথে তার সে অনল-কুন্ডে যাবে হায়
৭. জায়া তার-অপবাদ-ইন্ধনবাহিনী,
৮. তাহার গলায় দড়ি বহিবে আপনি।

সূরা লাহাব মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ, ৮১টি অক্ষর রয়েছে। পদ্যানুবাদে নজরুল অর্থ ঠিক রেখে আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন।
“ধ্বংস হউক, আবু লাহাবের দুই হস্ত
এবং ধ্বংস হউক সে নিজেও।”
অনুবাদ করতে গিয়ে নজরুল লিখেন,
“ধ্বংস হোক্ আবু লাহাবের বাহুদ্বয়,
হইবে বিধ্বস্ত তাহা হইবে নিশ্চয়।”

অনুবাদের সার্থকতার কারণে তিনি বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। শানে নজুলে কবি বলেন, আল্লাহ্ তায়ালা হযরত রাসুল (সা.) এর আত্মীয়-স্বজনদের সম্বন্ধে শাস্তির ভীতি প্রদর্শন সংক্রান্ত আয়াত অবতীর্ণ করলে হযরত রাসুল (সা.) সাফা পর্বতের উপর আরোহণ করে আরবের তৎকালীন নিয়মানুসারে উচ্চস্বরে ‘সাবধান’ ‘সাবধান’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। তাতে কোরাইশ বংশের অনেক লোক সেখানে উপস্থিত হয়ে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? হযরত রাসুল (সা.) তাদের সকলকে সম্বোধন করে বলেন, যদি আমি বলি যে, একদল শত্রু তেমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য পর্বতের অপর পার্শ্বে উপস্থিত হয়েছে, তবে তোমরা আমার এ কাজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে কী? উত্তরে তারা বলল নিশ্চই বিশ্বাস স্থাপন করব। আমরা বেশ পরীক্ষা করেছি আপনি কখনও মিথ্যা কথা বলেন না । তখন রাসুল (সা.) বললেন, হে কোরাইশগণ! তোমাদের সামনে জলন্ত দোজখের মহাশাস্তি রয়েছে; যদি তোমরা আমার ও খোদার বাণীর উপর আস্থা স্থাপন না করো, তবে তোমাদেরকে ঐ শাস্তি ভোগ করতে হবে। তোমরা স্ব স্ব আত্মাকে ঐ শাস্তি হতে রক্ষা কর। তা শুনে আবু লাহাব (রাসুলের পিতার বৈমাত্রিক ভাই), তার স্ত্রী আবু সুফিয়ানের বোন উম্মে জামিলা রাগান্বিত হয়ে বলল ‘তাব্বান লাকা’ – তারা রাসুলের ধ্বংস কামনা করে। এ ঘটনার পর সূরাটি অবতীর্ণ হয়। (বোখারী শরীফ)।

সূরা নাসর
(৩টি আয়াত ও ১টি রুকূ, মাদানী)

শুরু করিলাম শুভ নামে আল্লার,
নাই আদি অন্ত যাঁর করুণা কৃপার

১. আসিছে আল্লার শুভ সাহায্য বিজয়!
২. দেখিবে-আল্লার ধর্মে এ জগৎময়
৩. যত লোক দলে দলে করিছে প্রবেশ,
৪. এবে নিজ পালক সে প্রভুর অশেষ
৫. প্রচার হে প্রশংসা কৃতজ্ঞ অন্তরে,
৬. কর ক্ষমা-প্রার্থনা তাঁহার গোচরে।
৭. করেন গ্রহণ তিনি সবার অধিক
৮. ক্ষমা আর অনুতাপ-যাঞ্ছা সঠিক।
সুরা নাসর মদীনা শরীফে অবতীর্ণ হয়। এতে ৩টি আয়াত, ১৯টি শব্দ ও ৮১টি অক্ষর রযেছে। নজরুল অনুবাদটিতে কয়েকটি বিশেষণ যুক্ত করেছেন। প্রথম চরণে শুধু সাহায্য ও বিজয় নয়- তা হয়েছে ‘শুভ সাহায্য বিজয়’। প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার স্থানে তিনি শুধু ‘প্রশংসা’র কথা বলেছেন। কবি ‘কৃতজ্ঞ অন্তরে’ শব্দ দুটি যুক্ত করে প্রভুর প্রতি আনুগত্যকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। শানে নজুলে কবি বলেন, হিজরী ৬ষ্ঠ সালে হযরত রাসুল (সা.) সাহাবাগণসহ ‘ওমরা’ সম্পন্ন করার জন্য হোদায়বিয়া নামক স্থানে উপস্থিত হলে কোরাইশগণ তাঁদের মক্কা শরীফে প্রবেশে বাধা প্রদান করে। তখন কোরাইশদের সাথে আল্লাহ্র রাসুলের এই মর্মে সন্ধি হয় যে, এক দল অপর দলের প্রতি কোনো প্রকার অত্যাচার করতে পারবে না। কোরাইশগণ সন্ধি ভঙ্গ করে আক্রমণকারী হয়। ১০ম হিজরীতে দশ হাজার সাহাবাসহ হযরত রাসুল (সা.) মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সূরা মক্কায় বিদায় হজের সময় অবতীর্ণ হয়। এখানে আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ, হযরত আব্বাস (রা.)-এর প্রার্থনায় তার মুক্তি, বহু সৈন্যের ভীতি, মক্কা বিজয়, অধিবাসীগণকে ক্ষমা, ১৫ দিন তথায় অবস্থান ইত্যাদির আভাষ প্রদান করা হয়েছে।

সূরা কাফিরূন
(৬টি আয়াত ও ১টি রুকূ, মক্কী)

আরম্ভ করি লয়ে নাম আল্লার,
আকর যে সব দয়া কৃপা করুণার

১. বল, হে বিধর্মিগণ, তোমরা যাহার
২. পূজা কর, – আমি পূজা করি না তাহার।
৩. তোমরা পূজ না তাঁরে আমি পূজি যাঁরে,
৪. তোমরা যাহারে পূজ – আমিও তাহারে
৫. পূজিতে সম্মত নই। তোমরাও নহ
৬. প্রস্তুত পূজিতে, যাঁরে পূজি অহরহ।
৭. তোমাদের ধর্ম যাহা তোমাদের তরে,
৮. আমার যে ধর্ম র’বে আমারি উপরে।

সূরা কাফিরূন মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়। এখানে ৬টি আয়াত, ২৭টি শব্দ, ৯৯টি অক্ষর রয়েছে। কবি নজরুল ‘কাফের’ এবং ‘ইবাদতের’ স্থানে যথাক্রমে ‘বিধর্মি’ ও ‘পূজা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি অর্থ ঠিক রেখে অত্যন্ত সার্থকভাবে অনুবাদ করেছেন-

তোমাদের দীন তোমাদের আমার দীন আমার,
নজরুল অনুবাদ করে লিখেন-
তোমাদের ধর্ম যাহা তোমাদের তরে,
আমার যে ধর্ম র’বে আমারি উপরে।
শানে নজুলে কবি লিখেন, ওমাইয়া, হারেছ, আ’স, অলিদ প্রমুখ কোরাইশগণ হযরত রাসুল (সা.)-কে বলে যে, হযরত রাসুল (সা.) যদি তাদের ধর্মমতের অনুসরণ করেন তবে তারাও রাসুলের ধর্মমতের অনুসরণ করবে। জবাবে হযরত রাসুল (সা.) বলেন, আমি আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আমি কখনও তাঁর অংশীদার স্থাপন করতে পারব না। তারা বশ্যতা স্বীকার করে না অথচ রাসুল (সা.)-এর সাথে মিলিত হতে চায়। তখনই এ সূরা নাজিল হয়।

সূরা কাওছার
(৩টি আয়াত ও ১টি রুকূ, মক্কী)

শুরু করিলাম পূত নামেতে খোদার
কৃপা করুণার যিনি অসীম পাথার

১. অনন্ত কল্যাণ তোমা’ দিয়াছি নিশ্চয়
২. অতএব তব প্রতিপালক যে হয়
৩. নামাজ পড় ও দাও কোরবানী তাঁরেই,
৪. বিদ্বেষ তোমারে যে, অপুত্রক সে-ই।

সূরা কাওছার মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হয়। এখানে ৩টি আয়াত, ১০টি শব্দ ও ৩৭টি অক্ষর আছে। নজরুল ‘কাওছার’ শব্দটির বাংলা অর্থ ব্যবহার করেছেন। শানে নজুলে কবি উল্লেখ করেন, এ সূরাটি আবু জাহেল, আবু লাহাব, আ’স ও আকাবার সম্বন্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। কথিত আছে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-এর পুত্র হযরত তাহের (রা.) ওফাত লাভের পর, আ’স নামের জনৈক ধর্মদ্রোহী রাসুল (সা.)-কে নির্বংশ বলে উপহাস করেছিল । এসব কথা শুনার পর হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুঃখ পেলেন, তখন তাঁকে সান্ত্বনার জন্য দয়াময় আল্লাহ্ এ সূরা অবতীর্ণ করেন।

কবি নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সার্থকভাবে পবিত্র কুরআনের পদ্যানুবাদ করেছেন। তাঁর সাহিত্যের কেন্দ্রে ছিল ‘মানুষ’। মানব জীবনের সংকট এবং সেই সংকট বিমোচনের আগ্রহ তাঁকে উদ্বেলিত করেছিল। তাই তিনি চেয়েছেন পবিত্র কুরানের মণিরত্ন অহরণের মাধ্যমে মানুষের অন্তরের অন্ধকার দূর হয়ে যাক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here