স্বরোচিষ সরকার
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ পালিত হয় খ্রিষ্টীয় হিসেবে দুই তারিখে এক গণনা পদ্ধতি অনুসারে সাধারণত ১৫ই এপ্রিলে, অন্য গণনা পদ্ধতি অনুসারে সব সময়ে ১৪ই এপ্রিলে। সমস্যাটা গণনা-পদ্ধতিগত। সনাতনী যে পদ্ধতিতে বঙ্গাব্দের তারিখ নির্ণয় করা হয়ে থাকে, তা অনেকটা চাঁদ দেখার মতো করে নক্ষত্রের অবস্থান দেখে নির্ণীত হয়। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের মানুষ এই পদ্ধতিতে পঞ্জিকা তৈরি করে আসছে। এই পদ্ধতির বড় সমস্যা হলো, এতে মাস ও বছরের দৈর্ঘ্য আগে থেকে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। এ পদ্ধতিতে একাধিক মাসের দৈর্ঘ্য কখনো ২৯ দিনের হয়, আবার কখনো তা হয় ৩০ দিনের। কোনো কোনো মাস কোনো কোনো বছরে ৩২ দিনেরও হয়ে থাকে। বছরের দৈর্ঘ্যও সুনিয়মিত নয়। চার বছর পরেও অধিবর্ষ হতে পারে, আবার পাঁচ বছর পরেও হতে পারে। অন্যদিকে স¤প্রতি বাংলাদেশের সরকারি বঙ্গাব্দের তারিখ নির্ণয়ের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তাতে মাসগুলোর দৈর্ঘ্য সুনির্দিষ্ট, বছরগুলোর বৃদ্ধি অর্থাৎ অধিবর্ষও সুনিয়মিত। এ পদ্ধতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে দিকটি চোখে পড়ার মতো তা হলো, এতে বঙ্গাব্দের তারিখের সঙ্গে খ্রিষ্টাব্দের একটি স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে প্রতিটি বাংলা তারিখের আনুষঙ্গিক। খ্রিষ্টীয় তারিখ প্রতি বছরই অভিন্ন হবে। বৈশিষ্ট্যটির কথা বিবেচনায় রাখলে বলতে হয়, যে যুক্তিতে ১৫৮২ সালে ক্রিস্টোফার ক্লেভিয়াসকে দিয়ে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগোরি (১৫৭২-১৫৮৭) খ্রিষ্টাব্দের সংস্কার করিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জি এক অর্থে সেই পদ্ধতিকেই স্বীকরণ করে নিয়েছে। গ্রেগোরীয় পদ্ধতির এই স্বীকরণকে বলা যেতে পারে বঙ্গাব্দের গ্রোগোরীয়করণ। এভাবে গণনা পদ্ধতি অনুযায়ী বঙ্গাব্দ দুটোর নাম হতে পারে যথাক্রমে নাক্ষত্রিক বঙ্গাব্দ এবং গ্রেগোরীয় বঙ্গাব্দ। এর মধ্যে গ্রেগোরীয় বঙ্গাব্দ হলো সংস্কার করা বঙ্গাব্দ। কোনো কিছু সংস্কারের উদ্যোগ গৃহীত হলে, তা সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কমবেশি বিভ্রান্তি থেকে যায়। তাই গ্রেগোরীয় বঙ্গাব্দ সর্বস্তরে চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত পয়লা বৈশাখের এই বিভ্রান্তি থেকে যায়। তাই গ্রেগোরীয় বঙ্গাব্দ সর্বস্তরে চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত পয়লা বৈশাখের এই বিভ্রান্তি চিরতরে দূর হবে না।
বিভ্রান্তিহীনভাবে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের বিষয়টি সকলেই কাম্য। সেক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে কীভাবে বঙ্গাব্দের সংস্কার করা হয়েছিল, সে ইতিহাস অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তার ফলে সা¤প্রতিক সৃষ্টি হওয়া পয়লা বৈশাখ বিতর্কেরও স্থায়ী অবসান ঘটা সম্ভব।
বঙ্গাব্দ সংস্কারের উদ্যোগ
১৮৬২ সালের ১০ই জুন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর (১৮৯৮-১৯৭৪) সভাপতিত্বে বাংলা একাডেমির তৃতীয় বার্ষিক সাধারণ সভায় নাটোরের গজেন্দ্রনাথ কর্মকার কাব্যরত্ন সাহিত্যতীর্থ প্রস্তাব করেছিলেন, ‘বাংলা সালের বিভিন্ন মাসের তারিখ নির্ধারণ করা হউক।’ কয়েক দিন পর নাটোরের গুরুদাসপুর থানার অধ্যাপক এম. এ. হামিদও বাংলা একাডেমির নিকট প্রায় অভিন্ন একটি প্রস্তাব পাঠিয়ে বাংলা মাসের তারিখ নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক। ১৯৬৩ সালের ১০ই জুন তিনি এ সম্পর্কিত প্রথম যে সভা করেন, তাতে তিনি ছাড়া আবুল কাশেম এবং তারপদ ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি নিস্পত্তি করার লক্ষ্যে সেই সভায় তারা ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপসংঘ গঠন করেন, তাতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি, তারাপদ ভট্টাচার্যকে আহ্বায়ক এবং সৈয়দ আলী আহসান, আবুল কাশেম, সতীশচন্দ্র শিরোমণি, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাটার্য, অনাথবন্ধু ভট্টাচার্য প্রমুখকে সদস্য মনোনীত করা হয়। তিন দিন পরে (১৩ই জুন ১৯৬৩) এই উপসংঘের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে অনাথবন্ধু ভট্টাচার্য ছাড়া বাকি সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ: “… বৈঠকে দীর্ঘ সময় আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে পর্যালোচনা করা হয় এবং প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যাইতে পারে ভারতে নবপ্রবর্তিত তারিখের পরিবর্তন সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং উপস্থিত মনীষীবৃন্দের সুচিন্তিত মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১. বর্তমানে বাংলা মাসের তারিখ নির্ধারণ ও গণনা অত্যন্ত দুষ্কর বিধায় আগামী ১৩৭১ সালের বৈশাখ হইতে প্রতিবৎসর ভাদ্র পর্যন্ত ৩১ দিন এবং আশ্বিন হইতে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিন গণনা করা হউক। ২. যেহেতু ১৩৬৯ সনে অধিবর্ষ (লিপইয়ার) গণনা করা হইয়াছে এজন্য ঐ বর্ষ হইতে প্রতি চতুর্থ বৎসরে একদিন বৃদ্ধি পাইয়া চৈত্র মাস ৩১ দিন গণনা করা হউক।”
গ্রেগোরীর বঙ্গাব্দের এই সূচনা সভায় দুইটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একদিকে তাঁরা সমকালীন ভারতের তারিখ পরিবর্তনের প্রস্তাবকে বিবেচনায় রেখেছিলেন এবং অন্যদিকে তাঁরা তাঁদের গৃহীত সিদ্ধান্তে গ্রেগোরীর পদ্ধতিকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, ১৯৫৫ সালের দিকে সর্বভারতীয়ভাবে একটি অভিন্ন বর্ষপঞ্জি চালু করার জন্য তৎকালীন ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে (১৮৯৩-১৯৫৬) সভাপতি করে একটি শক্তিশালী জাতীয় কমিশন গঠন করে। ঐ কমিশন যে সুপারিশ প্রদান করে, তাতে অব্দসংখ্যা গণনার ক্ষেত্রে গ্রেগোরীয় পদ্ধতিকে হুবহু মেনে নেয়া হয়। গ্রেগোরীয় সৌর বছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫.২৪২১৯৯ দিন। সাহা কমিশন বছরের এই দৈর্ঘ্যকেই গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছিলেন। এই নিয়মে প্রতি চার বছরে একদিন অধিবর্ষ করলে প্রতি চারশো বছরে ৩.১২ দিন অতিরিক্ত গণনা করা হয়, গ্রেগোরীয় বিধান অনুযায়ী তার ফলে যেসব শতাব্দী ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য, শুধু সেইগুলোকেই অধিবর্ষ করার বিধান রাখা হয়েছে। সাহা কমিশনের প্রস্তাবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল। কিন্তু বাংলা একাডেমির প্রথম প্রস্তাবে অধিবর্ষ সম্পর্কিত প্রস্তাব থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাতে কিছু দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। তবে প্রস্তাব দুটোর মধ্যে যে গ্রেগোরীয় পদ্ধেিক স্বীকরণ করার চেষ্টা হয়েছে, তাতে কোনো অস্পষ্টতা নেই।
এরপর ১৯৬৫ সালের ২৩শে এপ্রিল প্রস্তাবিত সংস্কারের পক্ষে বাংলা একাডেমিকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রদান করতে হয়। তাতে বলা হয়েছিল, বর্ষপঞ্জির এ সংস্কার ধর্ম স¤প্রদায় সমূহের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না, কারণ সেসব অনুষ্ঠানাদি প্রাচীন পদ্ধতি অনুযায়ী হয়ে থাকে, যা ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ কথা বলার অর্থ সম্ভবত এটাই যে, প্রস্তাবগণ চাননি যে, বর্ষপঞ্জির এ জাতীয় সংস্কার কারো ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করুক। হিন্দু পর্বের মধ্যে চৈত্রসংক্রান্তি, অম্বুবাচী, মনসাপূজা, জন্মাষ্টমী, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, দোলযাত্রা, বা হোলি, বারুণী, বাসন্তী পূজা, রামনবমী, অক্ষয় তৃতীয়া, জামাই ষষ্ঠী, রথযাত্রা, ঝুলন যাত্রা, রাখি পূর্ণিমা, মহালয়া, দীপাবলি, জগদ্ধাত্রী পূজা প্রভৃতি পর্বের সঙ্গে সৌর মাসের যতটা যোগ, তার চেয়ে চান্দ্র মাসের যোগ অনেক বেশি। একইভাবে বৌদ্ধদের প্রায় সব অনুষ্ঠান চান্দ্র মাসের সঙ্গে সংযুক্ত-অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং তিথির হিসাবই সেখানে প্রধান; হিন্দু পর্বগুলোর মতো সেগুলোর সঙ্গে সৌর মাসের সম্পর্ক থাকলেও তা অনেকটা গৌণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঐসব অনুষ্ঠান প্রতি বছর একই সৌর মাসে নাও হতে পারে। দুর্গা পূজা সাধারণত আশ্বিন মাসে হয়ে থাকে, কিন্তু কখনো তা কার্তিক মাসেও হয়; স্বরস্বতী পূজা কখনো মাঘ মাসে আবার কখনো ফাল্গুন মাসে হয়ে থাকে। অভিন্ন রীতিতে বৌদ্ধ পর্ব বৈশাখী পূর্ণিমাও তাই কখনো বৈশাখ মাসে আবার কখনো জ্যৈষ্ঠ মাসে হতে দেখা যায়। এই হিসাবে হিন্দুদের দুর্গা পূজার বিজয়া দশমী, স্বরস্বতী পূজার শুক্লা পঞ্চমী, মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীর বারুণী স্নান অথবা বৌদ্ধদের বৈশাখী পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমার সঙ্গে বঙ্গাব্দ তারিখের যেসম্পর্ক, তা গ্রেগোরীয় বঙ্গাব্দ মেনেও পালন করা সম্ভব। অন্যদিকে মুসলিম পর্বগুলো সম্পূর্ণ চান্দ্রমাস ভিত্তিক, তাই এই সংস্কার প্রস্তাব তার ওপরে কোনো রকম প্রভাব ফেলে না। বাংলা একাডেমির উক্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তাই যতটা উদারতা প্রকাশ পায়, বাস্তবে তার অপরিহার্যতা ততটা ছিল না।
ভারতে সাহা কমিশনের রিপোর্ট যথাসময়ে প্রকাশিত হলেও সর্বভারতে তা চালু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বাংলা একাডেমির উদ্যোগক্তাগণ তাতে হতাশ না হয়ে বরং বঙ্গাব্দ সংস্কারের প্রস্তাবটি আরো নানাভাবে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তখন অন্য অনেক প্রস্তাবের সঙ্গে খ্রিষ্টাব্দের মাসগুলোকে বাংলা নামে চালু করার সুপারিশ করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল এপ্রিলের নাম রাখা হোক বৈশাখ, মে মাসের নাম জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি এবং সেইভাবে মাসের দৈর্ঘ্যও অভিন্ন হোক। ১৮৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি সেসব প্রস্তাব বিবেচনার জন্য উপসংঘের যে সভা হয় তাতে এ জাতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। তাছাড়া সভার সিদ্ধান্ত দেখে বোঝা যায় উপসংঘের সদস্যগণ বঙ্গাব্দের গ্রেগোরীয়করণে সম্মত থাকলেও তারা বাংলা তারিখের স্থানান্তর স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। সুস্পষ্টভাবে যুক্তি তুলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেনÑ “সেহেতু রাশি, নক্ষত্র এবং ঋতুর সঙ্গে বাংলা মাসের পর্যায়ক্রম নির্ণয় করা হয়, সেজন্য বৈশাখ মাস ১লা এপ্রিল হইতে গণনা করা সম্ভবপর নহে।” বঙ্গাব্দের সন সংখ্যা পরিবর্তন না করার ব্যাপারেও তারা দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “মোগল আমলে সম্রাট আকবরের সময় যে বঙ্গাব্দ প্রচলিত করা হইয়াছিল তাহা হইতেই বৎসর গণনা করিতে হইবে এবং সেই হিসাব আগামী ১লা বৈশাখ হইবে ১৩৭৩ বাংলা সাল।” এসব সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয় সমকালীন পূর্ববঙ্গের ইসলামি প্রবণতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে ব্যবচ্ছেদ করে শিকড়ছেঁড়া সংস্কৃতির উদ্ভাবন করতে উদ্যোক্তাগণ রাজি হননি। ১৯৬৬ সালেই বাংলা একাডেমির প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বপ্রথম বাংলা ১৩৭৩ বঙ্গাব্দের দেয়ালপঞ্জি প্রকাশ করা হয়। পরের বছর ১৩৭৪ সনে একবার এবং ১৩৭৭ সনে আরো একবার বাংলা একাডেমি এই নতুন নিয়ম অনুযায়ী দেয়ালপঞ্জি প্রকাশ করে। দেখাদেখি তৎকালীন পাকিস্তানের একাধিক বেসরকারি সংগঠনও তখন প্রস্তাবিত পদ্ধতির ক্যালেন্ডার প্রকাশ করতে থাকে। বাংলা একাডেমির তৎকালীন সহ-সংকলন-অধ্যক্ষ তারাপদ ভট্টাচার্য ঐসব প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার দেয়ালপঞ্জি প্রণয়ন করে দিয়েছিলেন।
বঙ্গাব্দের সংস্কার
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেড় দশকেরও বেশিসময় পর্যন্ত বাংলা একাডেমির বর্ষপঞ্জি সংস্কার নিয়ে বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। এ সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এবং ঢাকা থেকে প্রায়-পুনমুদ্রিত পঞ্জিকাগুলোর বাংলা তারিখই সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এরপর ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৮৩৬-১৯৮৯) সরকারি নির্দেশে বর্ষপঞ্জিকাটিকে পুনরায় চালু করার জন্য মন্ত্রি পরিষদে একটি সুপারিশপত্র প্রেরণ করেন। ১৯৮৮ সালের ১৯শে জুন তারিখে মন্ত্রিপরিষদ এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কমিটির সুপারিশকৃত বর্ষপঞ্জিটিকে ‘সুষ্ঠু ও সম্পূর্ণরূপে’ চালু করা হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তটি ১৯৮৯ সালের ১৩ই এপ্রিল তারিখের গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে শহীদুল্লাহ্ কমিটির নামে সুপারিশ করা হলেও এ সময়ে বাংলা একাডেমির প্রস্তাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ১৯৬৩ সালের প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ১৩৬৯ সনকে লিপইয়ার ধরে, তারপর থেকে প্রতি চতুর্থ বছরকে অধিবর্ষরূপে গণ্য করা হবে। কিস্তু ১৯৮৮ সালের বাংলা একাডেমির সুপারিশে লেখা হয়, “৪ দ্বারা বিভাজ্য সাল অধিবর্ষ হিসাবে পরিগণিত হইবে।” অধিবর্ষ সংক্রান্ত এ পরিমার্জনের ফলে ১৩৬৯ থেকে অধিবর্ষের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকেনি। যেমন ১৯৮৮ সালের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৩৬৬ সনকে অধিবর্ষ করা হয়, যদিও শহীদুল্লাহ কমিটির মূল প্রস্তাব মানলে ১৩৯৭ সনকে অধিবর্ষ করতে হতো। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেননি বা তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বরং ১৯৮৮ সালের সুপারিশ অনুযায়ীই বাংলা একাডেমি একাধিক দেয়ালপঞ্জি এবং ডায়েরি প্রকাশ করেছে। প্রথম সমস্যা দেখা দেয় ১৪০০ সন অধিবর্ষ হবে কিনা তা নিয়ে। লিখিতভাবে কোথাও উল্লেখ করা না হলেও সকলেই ধরে নিয়েছিলেন যে, বঙ্গাব্দকে পুরোপুরি গ্রেগোরীয় করণ করা হয়েছে। সেই সূত্রে ১৪০০ সন যেহেতু ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য নয়, সেহেতু তা অধিবর্ষ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। একই যুক্তিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি তারিখের সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, ১৪০০ সনকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে না এবং সেহেতু ঐ সনের চৈত্র মাসকে ৩০ দিন গণনাকরা হবে।
১৪০০ সন অধিবর্ষ হবে কিনাÑ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে যথেষ্ট তর্কবিতর্ক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একই সময়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংস্কারকৃত বঙ্গাব্দ নিয়ে সম্ভাব্য যাবতীয় সমস্যা সমাধান করার জন্য প্রাসঙ্গিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’ নামে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত বিশেষজ্ঞ ছিলেন জামিল চৌধুরী, আ.ম.ম. শহীদুল্লা, এন. এ চৌধুরী, মহাজাতক, শমশের আলী, অজয় রায়, আলী আসগর, জামাল নজরুল ইসলাম, মুহম্মদ তকীয়ুল্লাহ, জি. এম. আনিসুর রহমান প্রমুখ। পদাধিকার বলে উক্ত কমিটির সভাপতি ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে প্রথম দিকে মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ এবং পরে আবুল মনসুর মুহম্মদ আবু মুসা (মনসুর মুসা)।
পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সভাগুলোতে বঙ্গাব্দ সংস্কারের যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়। বিশেষ প্রাধান্য পায় অধিবর্ষজনিত সমস্যা। বঙ্গাব্দের তারিখও খ্রিষ্টাব্দের তারিখের মধ্যে স্থায়ী সংযোগ সৃষ্টির বিষয়টিও বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় গুরুত্ব পায়। শেষ পর্যন্ত বঙ্গাব্দও খ্রিষ্টাব্দের তারিখের মধ্যে প্রতিরূপ সম্পর্কের ব্যবধান কমিয়ে আনার লক্ষ্যে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, ফেব্রুয়ারি মাসের নিকটতম বাংলা মাসে অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের সঙ্গে অধিবর্ষের অতিরিক্ত দিনটি যোগ করা হবে। অতঃপর ১৯৯৫ সালের ২৬ শে জুলাই কমিটি একটি চূড়ান্ত সুপাািরশ প্রণয়ন করে। এই সুপারিশ বঙ্গাব্দকে পুরোপুরিভাবে গ্রেগোরীয় পদ্ধতির বর্ষ গণনার সঙ্গে সংলগ্ন করা হয়। বলা হয়Ñ “(১) সাধারণভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে; (২) গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে, সেই বাংলা বছরকে অধিবর্ষরূপে গণ্য করা হবে এবং (৩) অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনে গণনা করা হবে।” ১৯শে আগস্টে অনুষ্ঠিত আরো একটি সভায় যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। সেখানে সুপারিশ করা হয়েছিল: “১। বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের বর্ষপঞ্জির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাংলা ১৪০২ সালের ১লা বৈশাখ থেকে এটি কার্যকর করার সুপারিশ করা হলো। ২। তারিখ পরিবর্তনের সময় হবে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায়। ৩। পূর্বে গৃহীত সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি বছর ১লা বৈশাখ হবে ১৪ই এপ্রিল।” এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গাব্দের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দিন শুরু হয়ে থাকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। তাই সর্বশেষ সুপারিশ অনুযায়ী রাত ১২টায় দিন শুরুর অর্থ হলোÑ বঙ্গাব্দের গ্রেগোরীয়করণের অবশিষ্ট কাজটুকুও সম্পন্ন করা।
সংযোজন
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার ২০১৬
বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি ১৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখ বাংলা একাডেমির সভাকক্ষে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়। প্রফেসর অজয় রায়ের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর শামসুজ্জামান খান, জামিল চৌধুরী, প্রফেসর আলী আসগর এবং অপরেশ কুমার ব্যানাজী। এর ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সুপারিশ অনুসারে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এই ছয় মাসের হিসাব হবে ৩১ দিনে। (আগে বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত পাঁচ মাস ৩১ দিন হিসাবে গণনা হতো)। কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও চৈত্র এই পাঁচ মাস হবে ৩০ দিন। (আগে আশ্বিন থেকে চৈত্র এই সাত মাস ৩০ দিনে গণনা হতো)। এখন ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিন এবং গ্রেগোরীয়ান বর্ষপঞ্জিতে যে বছর অধিবর্ষ হবে (লিপইয়ার) সে বছর বাংলায় ফাল্গুন মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে।
উক্ত সংস্কারের ফলে এখন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ৮ই ফাল্গুন, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ১২ই চৈত্র, ৮ই মে রবীন্দ্র জয়ন্তীর প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ২৫শে বৈশাখ, ২৫শে মে নজরুল জয়ন্তীর প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ১১ই জ্যৈষ্ঠ এবং ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রতিষঙ্গী বাংলা তারিখ হবে পয়লা পৌষ।
বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সুপারিশ যদিও বলা হয়েছিল বাংলা ১৪২৩ বঙ্গাব্দ থেকে নতুন বর্ষপঞ্জি চালু হবে কিন্তু বাংলা ও খ্রিষ্টীয় বছরের তারিখে সাযুজ্য রেখে বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করে তা ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ এবং ১৪২৫-১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে চালু করা হয়। একই সঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের বিষয়টি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সর্বসাধারণকে অবগত করে।
লেখক: অন্যতম সমন্বয়কারী কর্মকর্তা, নব্বইয়ের দশকের চূড়ান্তভাবে পঞ্জিকা সংস্কার প্রক্রিয়া