বান্দার নামে নয়, আল্লাহর নামে কোরবানি


কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ ফরমান:
“ক্বুল ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ্ইয়াইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।” অর্থাৎ “হে রাসুল! আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ সবই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।” (সূরা আল আনআম ৬: আয়াত ১৬২)


কোরবানি সুন্নতে ইব্রাহিম। হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর নামে কোরবানি করে খলিলুল্লাহ উপাধি লাভ করেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জন্যে কোরবানির মতো একটি ফজিলতপূর্ণ বিধান পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করাই ইসলামের নির্দেশ। কোরবানির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ আল্লাহর প্রেম অর্জনের মাধ্যমে ধর্মনিষ্ঠা ও তাকওয়া অর্জন করবে। তাই পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “লাইয়ানাল্লাহা লুহুমুহা ওয়ালা দিমাউহা ওয়ালাকিই ইয়ানালুহুত্তাক্বওয়া মিনকুম।” অথার্ৎ- “আল্লাহর কাছে তোমাদের কোরবানিকৃত পশুর মাংস ও রক্ত পৌঁছায় না বরং তোমাদের ধর্মনিষ্ঠা ও খোদাভীতি পৌঁছে থাকে।” (সূরা আল হাজ্ব ২২: আয়াত ৩৭)


হযরত জাবের (রা.) বর্ণনা করেছেন, হযরত রাসুল (সা.) বলেছেন, “গরু ৭ জনের পক্ষ থেকে এবং উট ৭ জনের পক্ষ থেকে (কোরবানি করা যায়)।”


কোরবানির বর্ণনা প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন “কোরবানির পশু জবেহ করতে গিয়ে হযরত রাসুল (সা.) বললেন: ‘বিসমিল্লাহ্’ “আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বাল মিম মুহাম্মাদিন ওয়াআলি মুহাম্মাদিন ওয়া উম্মাতি মুহাম্মাদিন।” অর্থাৎ- “হে আল্লাহ্! আপনি এটা মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবার ও মুহাম্মদের উম্মতগণের পক্ষ হতে কবুল করুন।”


পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফ থেকে আমরা কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারি। কিন্তু আমাদের সমাজে কোরবানির প্রচলিত রীতি দেখে মনে হয় আমরা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিধান থেকে দূরে সরে পড়েছি। আসলে বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করাই মূখ্য উদ্দেশ্য। যদিও কোরবানি করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় তথাপি সমাজের প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী কোরবানিদাতা ব্যক্তিগণ বলে থাকেন যে, আমি নিজ নামে অথবা পিতা বা মাতার নামে কোরবানি করেছি। অথচ এভাবে বলা মারাত্মক ভুল। কেননা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নামে কোরবানি করা সম্পূর্ণ অবৈধ। যেহেতু আমরা পশু কোরবানি করি আল্লাহর সস্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, সুতরাং এ ফজিলতপূর্ণ কোরবানির ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের এ ভ্রান্ত কথা ও ধারণা পরিহার করে- “নিজের, পিতার কিংবা ৭ জনের নামে কোরবানি করছি” না বলে “আমাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি করছি” একথা বলা বাঞ্ছনীয়। আসলে “ব্যক্তির নামে নয়, ব্যক্তির পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি” এভাবে কোরবানি করার মাঝেই ফজিলত নিহিত রয়েছে।


আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে ‘কোরবানি’ শব্দের উৎপত্তি যার আভিধানিক অর্থ হলো, নৈকট্য লাভ করা। তিনি বলেন, মানুষ যে কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে মূলত এটাই তার জন্য কোরবানি।


প্রসঙ্গত আত্মসমর্পণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কোরবানির ঐতিহাসিক পটভূমির কথা স্মরণ করলে দেখা যায়, হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পুত্রের স্নেহ, মায়া-মমতা পরিত্যাগ করে হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্যে নির্জন মরু প্রান্তরে নিয়ে যান। আল্লাহর উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী হযরত ইসমাঈল (আ.) পিতার মুখে প্রভুর নির্দেশ শোনামাত্র কোরবানি হতে রাজি হয়ে যান। তারপর পিতাকে মিনতি করে জীবনের শেষ আবদার রেখে বললেন, পিতা! আপনি দয়া করে আমার তিনটি শর্ত মেনে নিন। স্নেহময় পিতা তখন বললেন, বাবা! তোমার শর্তগুলো কী বলো? পুত্র বললেন, আব্বাজান! কোরবানি করার পূর্বে আমার হাত-পা মজবুত করে বেঁধে নেবেন। কারণ গলাকাটা অবস্থায় নিজের অজ্ঞাতসারে হাত-পা ছুঁড়লে তা আপনার শরীর মোবারকে গিয়ে লাগতে পারে কিংবা রক্তের ছিটা গিয়ে লাগতে পারে। আপনি আল্লাহর বন্ধু, আপনার সাথে আমার বেয়াদবি হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত আপনি আপনার পবিত্র চোখে কাপড় দিয়ে ভালো করে বেঁধে নেবেন। কেননা আমার অন্তিম অবস্থা দেখে স্নেহপরবশ হয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে আপনাকে যেন দ্বিধাগ্রস্ত হতে না হয়।


তৃতীয়ত আমি আপনাদের একমাত্র সন্তান, মায়ের চোখের মণি। যে মা আমাকে বুকে করে নির্জন মরু প্রান্তরে নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন, শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও আমাকে লালন-পালন করেছেন, তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আমাকে কোরবানি করার পর আমার রক্তমাখা জামা দুঃখিনী মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেবেন। যখন আমার কথা মনে পড়বে, তখন মা দুঃখিনী এ জামা বুকে জড়িয়ে তাঁর অন্তরের জ্বালা কিছুটা জুড়াতে পারবেন। এ তিন শর্তে রাজি হয়ে পিতা যখন ছেলের গলায় ছুরি চালাচ্ছিলেন, তখন তিনি উচ্চারণ করছিলেন আল্লাহু আকবার আল্লাহ মহান। কিন্তু ছুরি তো চলে না, অর্থাৎ গলা কাটে না। তবু তিনি ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পুনরায় ছুরি চালালেন। তখন জিব্রাঈল বেহেশতি দুম্বা নিয়ে আসতে আসতে বলছিলেন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার” আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই আল্লাহ মহান। ছুরির নীচে শুয়ে হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল “ওয়া লিল্লাহীল হামদ”- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে। এমন সময় কোরবানি হয়ে গেল। চোখ খুলে হযরত ইব্রাহিম (আ.) দেখলেন, দুম্বা কোরবানি হয়েছে, আর ছেলে পাশেই দাঁড়ানো। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর নফসের জীব-প্রবৃত্তি এভাবে আল্লাহর হুকুমে কোরবানি হয়ে গেল। আর তাঁরা উভয়ে আত্মসমর্পণের এ অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর বন্ধু খেতাবে ভূষিত হলেন, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হলেন।


হযরত ইব্রাহিম (আ.) স্বীয়পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে আল্লাহর কুরবিয়ত বা নৈকট্য হাসিল করে ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তাঁদের সেই মহান ত্যাগের স্মৃতি বহন করে আজও মুসলিম জাতির মধ্যে ‘সুন্নতে ইব্রাহিম’ হিসেবে কোরবানির রেওয়াজ চালু রয়েছে।
পশু কোরবানির মাধ্যমে আমরা আত্মসমর্পণের হুকুম লাভ করেছি। কিন্তু পশু কোরবানি করতে গিয়েও কোরবানির নামে সমাজে কুসংস্কার প্রবেশ করেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আমরা আল্লাহ্কে বেমালুম ভুলে গিয়ে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে ব্যক্তির নামে কোরবানি করে থাকি। ফলে কোরবানির সুফল হিসেবে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা থেকে বঞ্চিত হই।


প্রকৃতপক্ষে- শুধু পশু জবেহ করাই কোরবানি নয়। যদি তাই হতো তাহলে হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে ১০০ দুম্বা, ১০০ উট ও ১০০ গরু কোরবানি করার পরও তাঁর কোরবানি কবুল হয়নি কেন? যখন নিজের সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর নামে জবেহ্ করার উদ্দেশ্যে গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন, দেখা গেল ছেলের পরিবর্তে দুম্বা জবেহ হলো। এখন প্রশ্ন হলো এ দুম্বা কোত্থেকে আসলো?


নিজের জীবাত্মার পশু প্রবৃত্তিকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে, নিজের স্বেচ্ছাচারিতাকে পরিত্যাগ করত আল্লাহর ইচ্ছার উপর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য হাসিল করাই প্রকৃত কোরবানি। হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মতো আপন সন্তানের ন্যায় প্রিয়বস্তু আল্লাহর রাস্তায় জবেহ বা উৎসর্গ করার মানসিক দৃঢ়তা পয়দা করা কোরবানির শিক্ষা। আমরা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর কাছ থেকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের শিক্ষা পেয়েছি। এ শিক্ষা মহামানবগণের শিক্ষা। এ শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রশিক্ষণ লাভের জন্যে আল্লাহর বন্ধুগণের সান্নিধ্য লাভ করা প্রয়োজন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের কোরবানির একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।


আল্লাহ তায়ালার মনোনীত মহামানবগণের সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁদের পবিত্র হৃদয় থেকে ফায়েজ হাসিলের মাধ্যমে আত্মার পশু-প্রবৃত্তি দমন করত হৃদয়ে আল্লাহর সুপ্ত নুর জাগ্রত করে বাস্তব জীবনে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করাই হাকিকতে কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির এই সঠিক শিক্ষা জীবনে বাস্তবায়িত করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার এটাই চিরন্তন পদ্ধতি।


[সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ১ম খণ্ড থেকে সংকলিত]বান্দার নামে নয়, আল্লাহর নামে কোরবানি

1 COMMENT

  1. আলহামদুলিল্লাহ।
    মহান মালিকের কাছে প্রর্থনা করি আমরা যেনো হাকিকতে কোরবাণী করতে পারি।।
    আমিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here