বিজ্ঞান ডেস্ক: বিজ্ঞানের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কথা উঠলে অনেককে হয়তো বলতে শুনবেন বিবর্তনবাদের কথা, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের অস্তিত্বের কথা, অথবা ভ্যাকসিন আসলেই নিরাপদ কিনা। কিন্তু এগুলো নিয়ে আসলে বিজ্ঞানে কোনো বিতর্ক নেই। আসলে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুতই এবং ভ্যাকসিন আসলেই শিশুদের জন্য নিরাপদ। এগুলোর একদম নগণ্য কিছু ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু মূল বিষয়গুলো নিয়ে নয়। তাই বলে বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই মহাবিশ্বের ব্যাপারে সব জেনে বসে নেই।
পদার্থবিদ ব্রায়ান কক্স বলেছিলেন, “অজানা বিষয় আমাকে নার্ভাস করে না- বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য তো এটাই। এমন বিলিয়ন বিলিয়ন জায়গা আছে, যেগুলোর ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আর এই না জানাটা আমাকে আগ্রহী করে তোলে, সেগুলোর ব্যাপারে জানার জন্য এবং এটাই বিজ্ঞান। অজানার ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে আপনি যদি সহজ হতে না পারেন, তাহলে বিজ্ঞানী হওয়াটা আপনার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। আমি কেবল একটা উত্তর চাই না। আমি সবকিছুর উত্তর চাই না। আমি চাই- এমন কিছু ব্যাপার থাকুক, যেটার উত্তর খুঁজতে হবে।”
রহস্য এক – কেন antimatter এর চেয়ে matter বেশি ?
পার্টিক্যাল ফিজিক্স নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক ধারণা বলে যে, ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার (বস্তু ও প্রতিবস্তু) আসলে সমান ও বিপরীতমুখী। যখন এদের মোলাকাত ঘটে, তখন এরা একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে দেয়, কিছুই বাকি রাখেনা এবং এ ধরনের অধিকাংশ ধ্বংসযজ্ঞ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির প্রথম দিকে হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও এতো এতো বস্তু রয়ে গেছে যেগুলো দিয়ে আমাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ এবং অন্যান্য সবকিছু তৈরি হয়েছে। তাহলে, অ্যান্টি ম্যাটার কই?
কিছু কিছু ব্যাখ্যা আছে মেসনকে কেন্দ্র করে। মেসন হচ্ছে ক্ষণজীবী সাব-অ্যাটমিক পার্টিক্যাল, যা একটা কোয়ার্ক এবং একটা অ্যান্টি-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। বি-মেসন কণাগুলো অ্যান্টি-বি-মেসনের চেয়ে একটু ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এর ফলাফল অনুসারে, যথেষ্ট পরিমাণ বি-মেসন কণা টিকে গেছে, আর তা দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের সকল বস্তু তৈরি হয়েছে। তাছাড়া, বি, ডি, এবং কে-মেসন কণা নিজেদের স্পিন পরিবর্তন করতে পারে- একবার অ্যান্টি-পার্টিক্যাল, আবার পার্টিক্যাল হতে পারে। রিসার্চে দেখা গেছে, মেসন কণা সাধারণত নরম্যাল অবস্থা (পার্টিক্যাল/বস্তুর রূপ) ধারণ করে, আর এজন্যেই সাধারণ বস্তুর পরিমাণ প্রতিবস্তুর চেয়ে বেশি।
রহস্য দুই- আমরা কেন ঘুমাই
বেশ কিছু ধারণা প্রচলিত আছে এ ব্যাপারে, কিন্তু কেউই একদম পাকা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেন, বিবর্তনের সুবাদে যেসব প্রাণী শিকারীদের হাত থেকে লুকানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে, তারা ঘুমানোর সুযোগ বের করে নিতে পেরেছে। কিন্তু যাদেরকে সবসময়েই সতর্ক থাকতে হয়, তারা ঘুম ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বিশ্রাম নেওয়ার বা নতুন উদ্যম অর্জন করার সামর্থ্য পেয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা যদিও জানেন না আমরা কেন ঘুমাই, কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন, ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আসলে কতখানি (যেমন, মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতা ঠিক রাখা)
রহস্য তিন – মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে?
সবাই জানি যে, চাঁদের আকর্ষণের ফলে জোয়ার-ভাটা হয়, পৃথিবীর অভিকর্ষের ফলে আমরা মাটিতে আটকে থাকি, বা সূর্যের মহাকর্ষেই গ্রহগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কিন্তু, আসলে আমরা কতটুকু বুঝি মহাকর্ষের?
বস্তু থেকে এ ধরনের শক্তিশালী একটা বল তৈরি হয় এবং দানবীয় বস্তুগুলোর অন্যান্য বস্তুকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাও বেশি। বিজ্ঞানীরা ভালোই বোঝেন, মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে? কিন্তু জানা নেই, কেন এই বল অস্তিত্বশীল। কেন পরমাণু জিনিসটা বলতে গেলে পুরোটাই ফাঁপা? পরমাণুকে যে বল ধরে রাখে, কেন সেটা মহাকর্ষের চেয়ে ভিন্ন। মহাকর্ষ কী আসলে কোনো বস্তু? পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আমাদের বর্তমান যে ধারণাগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া যায় না এখনো।
তবে মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে, তা বোঝার ক্ষেত্রে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে গেছি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের পর।
রহস্য চার- আমরা ছাড়া বাকিরা কই?
দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাস ৯২/৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। অর্থাৎ, এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত যেতে, আলোর লেগে যাবে ৯২/৯৩ বিলিয়ন বছর। বিশাল এই মহাবিশ্ব ছায়াপথ, নক্ষত্র, আর গ্রহ দিয়ে ঠাসা। কিন্তু এখন পর্যন্ত পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের যথোপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে, পুরো মহাবিশ্বে আমরাই একমাত্র প্রাণসমৃদ্ধ গ্রহের বাসিন্দা, এমনটা হবার সম্ভাবনা প্রায় একেবারেই অসম্ভব। তাহলে, এখন পর্যন্ত কারো সাথে যোগাযোগ তৈরি হলো না কেন?
এটাকে বলে ফার্মি’র ধাঁধাঁ (Fermi Paradox) এবং কেন মহাজাগতিক প্রাণীর দেখা পেলাম না- এটার ব্যাখ্যা আছে বেশ কয়েক ডজন, প্রত্যেকটা শুনতে আগেরটার চেয়ে চমৎকার। ঐ সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আমরা দিনের পর দিন আলোচনা করে যেতে পারি- আমরা কি কোনো সিগন্যাল মিস করলাম, তারা কি এসে আমাদের অজান্তেই চলে গেলো, ওরা কি আমাদের সাথে কথা বলতে পারেনি অথবা ওদের ইচ্ছাই হয়নি, নাকি সবচেয়ে অদ্ভুত এবং প্রায় অসম্ভব (পৃথিবীই একমাত্র প্রাণময় গ্রহের) ব্যাখ্যাটাই সত্য?
রহস্য পাঁচ- ডার্ক এনার্জি কী?
বিজ্ঞানের সকল রহস্যের মধ্যেম ‘ডার্ক এনার্জি’ হয়তো সবচেয়ে বেশি সাসপেন্সে ভরপুর। একদিকে, ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের সমগ্র ভরের ৮০% এর জন্য দায়ী। আর অন্যদিকে, ডার্ক এনার্জি একটা হাইপোথেটিক্যাল এনার্জি, যাকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় মহাবিশ্বের সকল কিছুর ৭০% তৈরির জন্য।
এটার পেছনে অনেক রহস্য এখনো খোলাসা না হলেও, মহাবিশ্বের প্রসারের পেছনে ডার্ক এনার্জির হাত আছে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। অমীমাংসিত রহস্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রথম ও প্রধানটা হলো, ব্যাটা কী দিয়ে তৈরি? ডার্ক এনার্জির পরিমাণ কি অপরিবর্তনীয়? নাকি মহাবিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম? ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব কেন সাধারণ বস্তুর ঘনত্বের কাছাকাছি মনে হয়? ডার্ক এনার্জি কি আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি এই থিওরিকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে?