মানবজাতির অবস্থান সব সময়ই বিভিন্ন সময় বা যুগে কখনওই একরৈখিক অথবা কণ্টকবিহীন ছিল না। বিভিন্ন যুগের মানব অবস্থান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক উপাদানগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মধ্যযুগের সামন্ত প্রথা, আধুনিক যুগে শিল্পবিপ্লব, উত্তর-আধুনিক যুগে চাহিদা ও বিতরণ ব্যবস্থা কখনওই ব্যক্তিবর্গের দারিদ্র্যের অনুকূলে কাজ করেনি। এর ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিবর্গের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক উপাদানগুলো তাদের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে সংগঠিত হয়নি। এ কারণে মানবকল্যাণের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে এবং দরিদ্র ব্যক্তির অবস্থান আরও নিম্নদিকে ধাবিত হয়েছে। ফলস্বরূপ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং ন্যায় অথবা ন্যায়বিচার পথটিও অধিকতর দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়েছে। এই প্রবন্ধে দারিদ্র্যের সাথে মানবাধিকার, ন্যায় এবং মানবিকতার সম্পর্ক দেখানো হবে আমার লক্ষ্য এবং এর জন্য করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।
দারিদ্র্যের কারণ
দারিদ্র্যের সঠিক সংজ্ঞা দেওয়া কি সম্ভব? প্রচণ্ড দারিদ্র্য এবং সেসাথে তাদের অক্ষমতা ধনী দেশ এবং এর জনগণের কল্পনাতে আসাও একটি অসম্ভব ব্যাপার। এর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে সামনে চলে আসে সেগুলো হলো: বিশ্বদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, চাকুরি অনিশ্চয়তা, বিরূপ আবহাওয়া, অসুস্থতা, চিকিৎসার ব্যয় বহনের অক্ষমতা, মজুরীর স্বল্পতাÑ বিষয়গুলোর অস্তিত্ব দরিদ্র ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারগুলোকে প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় নারীরা তাদের সন্তানদের পিছনে ফেলে ভালো মজুরীর জন্য বিদেশ গমনে তৎপর হয়, যার কারণে তাদের জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়। কিন্তু তাদের দরিদ্রতা তাদেরকে আইনগত এবং রাজনৈতিক অধিকার দাবীর বিষয়ে অসমর্থ করে দেয় শুধু তাদের শিক্ষার অভাব এবং পারিবারিক অস্তিত্ব রক্ষার কারণে। এভাবে দরিদ্র ব্যক্তিরা শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত হয় যা-কিনা ধনীদের ধারণার মধ্যেও অনুভূত হয় না। দরিদ্র ব্যক্তিদের তাদের অর্থাভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি প্রাথমিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতার বিষয়টিকে অস্বীকার করা অবশ্যই ন্যায়কে অস্বীকার করা হয়। এ সকল বিষয়গুলো ধনী ব্যক্তিদের থেকে দরিদ্র ব্যক্তিদের নিকট অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কারণ তারা প্রত্যক্ষভাবে এ সকল সমস্যার মুখোমুখি হয়। ধনী ব্যক্তি বা দেশসমূহ অতি দারিদ্র্য বিষয়টি থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানব যারা দারিদ্র্য সংক্রান্ত কারণে মৃত্যুবরণ করে তাদের অবস্থানের সাথে ধনীদের চিন্তা এবং আদর্শের কোনোরূপ মিল বা সম্পর্ক থাকে না বলে তাদের কল্যাণের বিষয়গুলো অবহেলিত হয়। কিন্তু এ সকল সংকটাপূর্ণ অবস্থানের ব্যক্তিরা যদি ধনীদের পরিচিত বা প্রতিবেশীর মধ্যে অবস্থান করতো তাহলে হয়তো দারিদ্র্য বিষয়টি উপেক্ষিত হতো না। বরং এ সকল ক্ষেত্রে তাদের সংকট পূরণে অনেক বেশি সহযোগীতা বা সমবেদনার বিষয়টি দৃঢ় হতো।
একটি বিষয় ঐতিহাসিকভাবে এবং স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে কেবল ‘আর্থিক সাহায্য’ কিন্তু বিশ্বদারিদ্র্যকে দূরীকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। কারণ বিষয়টি এতটাই বৃহৎ যে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজ অথবা একটি বিশেষ দেশেরও এ সংকট সমাধানে অবদান অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বিশেষ দেশে একটি ভূমিকম্প বা বন্যাদুর্গত স্থানে আমাদের সাহায্য বা অবদান অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ ঐ শহরটি এক/দুই বছর পর আমাদের সাহায্যে পুনর্গঠিত হয়ে উঠতে পারে। এরূপ ফলাফল সম্ভব কেবল একটি বিশেষ দুর্গত অবস্থান যেটি পূরণ করা যায় বিষয়টির সীমিত অবস্থানে। অন্যদিকে দারিদ্র্য এতটাই বৃহৎ যে আমাদের সাহায্য তখন-সীমিত এবং অর্থহীন দেখায়। তবে বিষয়টি অন্য দৃষ্টিতে দেখলে কিন্তু এটি অর্থপূর্ণ মনে হতে পারেÑ অসীম দারিদ্র্যের মধ্যে যদি দশজন অতি দরিদ্র শিশুকেও আমরা সাহায্য করে ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচাতে পারি। এক্ষেত্রে যদিও অন্য অনেক দরিদ্র শিশুকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে কেবল এই দশজন শিশুকেই সাহায্য করা যায় সেটিকেও কিন্তু আমরা অনেক গুরুত্ব প্রদান করতে পারি। এটি উপযোগবাদী ধারণার সাথে জড়িয়ে পড়ে যদিও কান্ট এবং রলস এখানে ভিন্নমত পোষণ করবেন। কারণ তারা কখনও সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে না বলে সমাজের বণ্টনমূলক ব্যবস্থার কথা বলেছেন যা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসমতা দূরীকরণের সাহায্য করবে। (Peter Jones: 1994)
দারিদ্র্যের নতুন ধারা
অতি দারিদ্র্য বিষয়টি বর্তমান যুগে অতীতের থেকে প্রসঙ্গ এবং কারণিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্নরূপে উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে এর ধারাবাহিকতা পূর্বের মতো মাটি, সার অথবা আবহাওয়ার মতো প্রাকৃতিক সত্তা কেন্দ্রিক নয়। এটি বরং সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের বিষয়টি কিভাবে গঠিত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে। বিশ্বের মানবজাতির বৈশ্বিক উপাদানের ২% ব্যবহার বিধায় এর তীব্রতা সম্পূর্ণরূপে অথবা আংশিকও অস্বীকার বা উপেক্ষা করা হয়। এর তীব্রতা অনুধাবন করার জন্য শুধু আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। বরং এর তীব্রতা অনুধাবন অথবা দূরীকরণের জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনী প্রক্রিয়া পুনর্গঠন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি করা সম্ভব হলেই অতি দারিদ্র্য অবস্থান থেকে ব্যক্তি মুক্তি লাভ করতে পারে অথবা এটিকে এড়িয়ে যেতে পারে। অতি দারিদ্র্য অনেক বড় পরিসরে উদ্ভব হয় কেননা এটি নিজস্ব শক্তিতে অগ্রসর হয় এবং বিনিময়ে বৃহৎ অসমতার প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অতি দরিদ্র ব্যক্তি নিজস্ব স্বার্থ পূরণের জন্য উপায় খুঁজতে তৎপর হয়ে ওঠে এবং অন্যদিকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিগণ এ সকল স্বার্থকে সামান্যই দাম দেয়। প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তার পূরণে মানবাধিকার যেমন অস্বীকার করা যায় না ঠিক সেই প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট দাবীগুলোর ওপর আমাদের মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দরিদ্র ব্যক্তির মানবাধিকার শুধু অপূরণীয় থাকে না; বরং এসব বিষয় অপূর্ণ হয় কিছুসংখ্যক মানবের পছন্দ বা ইচ্ছার অভাবে। চরম দারিদ্র্যের ধারাবাহিকতা সকল ক্ষেত্রেই মানব সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করে দেশীয় অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে বৈশ্বিক আর্থিক অবস্থানের সম্পর্কিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে সঞ্চয়, ভোগ ইত্যাদি বিষয়ে ক্ষুদ্র ব্যক্তি সিদ্ধান্ত সবই চরম দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে জড়িত থাকে। অতি দরিদ্র অবস্থান থেকে অব্যাহতির জন্য মানবজাতির কিছু সিদ্ধান্তের অবশ্যই পরিবর্তন দরকার। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিশ্ব দারিদ্র্যের নতুন রূপ পরিলক্ষিত হয়েছে যা দারিদ্র্যের সংখ্যা এবং প্রকৃতিতে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এর মোকাবিলা করার জন্য বিশ্ব অর্থনীতির বণ্টনের ক্ষেত্রে নুতন পদ্ধতির প্রচলন করতে হয়েছে।