মঙ্গলে আদৌ মানুষের বসতি গড়ে উঠবে কী ?

0
327
মঙ্গলে মানুষের বসবাসের প্রতীকী ছবি ।

বিজ্ঞান ডেস্ক: কয়েক দশকের মধ্যে মানুষ বসতি গড়বে লাল গ্রহ মঙ্গলে। আগামী কয়েক দশকের মহাকাশ বিষয়ে পরিকল্পনায় মঙ্গলের ব্যাপারে এমন আশার কথাই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা।
নাসা জানিয়েছে, পৃথিবী থেকে স্বাধীন মানুষের উপনিবেশ মানুষের সভ্যতা ছড়িয়ে দেবে। মানুষ মঙ্গলে ঘুরতে নয়, বসবাস করতেই যাবে। মানুষ মঙ্গলে কয়েক বছর ধরে বসবাস করার পর শুধু নিয়মমাফিক রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়বে। মঙ্গলে বসবাসকারী মানুষরা সেখানকার খনিজ ব্যবহার করেই জ্বালানি, পানি, অক্সিজেনসহ ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করবে। ওই সময়কার অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে পৃথিবীতে কোনো তথ্য পাঠানো যাবে।

গবেষণার ধাপ
২০৩০ সালের মধ্যেই মঙ্গলে বসবাসের গবেষণা শেষ হবে। এ বিষয়ে নাসার একটি পরিকল্পনা পত্রে মঙ্গলে বসতি স্থাপনে তিন ধাপে নাসার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। গবেষণার প্রথম ধাপ হবে পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয় ধাপের গবেষণা করা হবে গভীর মহাশূন্যে, যেখান থেকে কয়েকদিনের মধ্যে পৃথিবীতে ফেরা যাবে। আর তৃতীয় ধাপের গবেষণায় পৃথিবীর ওপর কম নির্ভরশীল বা একদমই নির্ভরশীল হবে না।

প্রথম ধাপ: নাসার গবেষকরা বলেন, মঙ্গলে মানুষের বসতির পূর্বে গবেষণা হবে পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। গবেষণার প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হবে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস)। মহাকাশ স্টেশনের গবেষণার মধ্যে থাকবে বিভিন্ন যন্ত্রের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা এবং দীর্ঘ সময় মহাশূন্যে থাকলে পৃথিবীর ওপর কী প্রভাব পড়ে। মঙ্গল অভিযানে অংশ নেওয়া মানুষকে কয়েক দশক মঙ্গলে থাকতে হতে পারে। আবার পৃথিবীতে না ফেরার আশঙ্কাও আছে।

দ্বিতীয় ধাপ: দ্বিতীয় পর্যায়ে নাসার পরীক্ষা হবে পৃথিবীর ওপর কম নির্ভরশীল। এই পরীক্ষার স্থান হবে গভীর মহাকাশ।

তৃতীয় ধাপ: এই ধাপে পৃথিবী ও পরনির্ভরশীল তার ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছাবে আর তখনই শুরু হবে মঙ্গল বসতি স্থাপনের অভিযান। এই পর্যায়ে মঙ্গলের কক্ষপথ, মঙ্গলের কোনো চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহে মানুষের অভিযান পরিচালিত হবে।

যা নিয়ে আরো গবেষণা চলছে:
নাসার গবেষকরা বলেন, নাসা ও এর সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলো মহাকাশে মানুষের বসবাস নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো কি মঙ্গলে জীবন ছিল? এখনো কি মঙ্গলে জীবন আছে, মানুষের জন্য মঙ্গলে বসতি কি নিরাপদ হবে? মহাকাশের অন্য কোথাও বা পৃথিবীতে কীভাবে জীবনের শুরু হয়? মঙ্গল নিয়ে গবেষণায় পৃথিবীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী তথ্য জানা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই গবেষণা চলছে।

মঙ্গল নিয়ে এত কৌতুহল কেন ?
পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না কিংবা বসবাস করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই গবেষক-বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন। বিশেষ করে মঙ্গলে গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান পেতে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ। পৃথিবী থেকে অনেকটা লাল দেখানোর কারণে এর অপর নাম হচ্ছে লাল গ্রহ। পৃথিবীর মতো ভূ-ত্বক রয়েছে এ গ্রহে। এর ভূ-ত্বকে রয়েছে চাঁদের মতো অসংখ্য খাদ, আর পৃথিবীর মতো আগ্নেয়গিরি, মরুভূমি এবং মেরুদেশীয় বরফ।

প্রাণের অস্তিত্বের জন্য মূল উপাদান পানির সন্ধান করছেন বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহে। অবশেষে মঙ্গলে দীর্ঘ অভিযানের পর সোমবার নাসার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিলেন সেখানে পানির প্রবাহ রয়েছে। তাদের এ ঘোষণায় আশার আলো দেখা দিয়েছে সবার মনে। এরপরই শুরু হয় বিস্তর গবেষণা ।

মঙ্গলে পানির অস্তিত্ব সত্যিই আছে কী ?
১৯৬৫ সালে মেরিনার ৪ মহাকাশযান প্রথমবারের মতো মঙ্গল গ্রহ অভিযানে যায়। এই অভিযানের পর থেকে অনেকেই ধারণা করে আসছিলেন যে মঙ্গলে তরল পানির অস্তিত্ব আছে। মঙ্গল থেকে পাওয়া আলো এবং আঁধারের তরঙ্গের মধ্যে পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে এই ধারণা করা হয়। বিশেষত মঙ্গলের মেরু অঞ্চল থেকে এ ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ে, যা মহাসাগর বা জলাশয়ের প্রমাণ হিসেবে অনেকেই গ্রহণ করেছিল।
গ্রহের বাসযোগ্যতা তথা একটি গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটার সম্ভবনার পরিমাণ বহুলাংশে এর পৃষ্ঠতলে পানির অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে। এই শর্তটি পূর্ণ করার জন্য গ্রহটিকে অবশ্যই বাসযোগ্য অঞ্চলে থাকতে হবে। বর্তমানে সূর্যের বাসযোগ্য অঞ্চলের ভিতর পৃথিবী অবস্থান করছে।

নাসা ঘোষণা দেয় মঙ্গলে তরল পানি প্রবাহের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সংবাদ সম্মেলনে নাসার প্ল্যানেটারি সায়েন্স বিভাগের পরিচালক জিম গ্রিন ঘোষণা দেন, ‘এতদিন ভাবা হতো মঙ্গল একটি শুষ্ক গ্রহ। কিন্তু তা নয়, মঙ্গলে বিশেষ পরিবেশে তরল পানির সন্ধান মিলেছে । এর অর্থ মঙ্গলে এখনও প্রাণের উদ্ভবের পরিবেশ রয়েছে।’
শুধু তাই নয়, অবিশ্বাস্য চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া গেছে মঙ্গলে। রহস্যময়, রক্তিম এ গ্রহে পানির পাশাপাশি আছে অক্সিজেনও। যা প্রাণের জন্য অত্যাবশ্যক। এর মানে এখানে জীবনেরও অস্তিত্ত্ব আছে। তাছাড়া মঙ্গলে অনেক মূল্যবান খনিজ পদার্থেরও সন্ধান পাওয়া গেছে বলে নাসার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। ফলে মানুষের জন্য সম্ভাব্য বাসস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

নাসার গবেষকেরা জানিয়েছেন, তারা মঙ্গলের পৃষ্ঠে খনিজ পদার্থের থাকার প্রমাণ পেয়েছেন। তারা এর পৃষ্ঠের ঢালে রহস্যময় দাগও দেখতে পেয়েছেন। বেশ লম্বা সময় ধরে চলা পানির প্রবাহ আর ভাটার টানেই এই দাগের সৃষ্টি হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। মঙ্গলে যখন গ্রীষ্মকাল, তখন কিছু এলাকায় তাপমাত্রা থাকে- ২৩ ডিগ্রি।
কিন্তু বিভিন্ন ধাতব লবণ থাকে বলে সেই পানি এত কম তাপমাত্রাতেও তরল অবস্থায় থাকতে পারে। তখন তা বিভিন্ন টিলা, পাহাড় থেকে স্রোতের মতো নেমে আসে ছোটো ছোটো খাল বা নালাপথ ধরে। আবার শীতকালের শুরু থেকেই তা শুকিয়ে যায়। মঙ্গলের বিভিন্ন স্থানে তারা এইরূপ জল প্রবাহের অস্তিত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন।
নাসার সহযোগী প্রশাসক জন গ্রুনসফেল্ড বলেন, ‘মঙ্গলে আমরা পানিকে অনুসরণ করছিলাম, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সন্ধানে আমাদের যে অনুসন্ধান এটা তারই অংশ। এখন আমরা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নিয়ে বলতে পারি, আমরা যা ভেবেছিলাম, তাই পাচ্ছি। এখন প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, মঙ্গলে প্রবাহমান পানি আছে এবং তা এই সময়েই।

তাহলে মঙ্গলে কি মানুষের বসবাস সম্ভব?
অনেকের আলোচনা শুনলে মনে হবে মঙ্গলে বসবাস সময়ের ব্যপার মাত্র, মনে হবে এতো সহজ ব্যপার। অনেক গবেষকদের মতে মঙ্গলে বসবাস সম্ভব না। এই না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। মঙ্গলে শুধু পা রাখা যেতে পারে বা কয়েকদিন থেকে সেখানে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো যেতে পারে, কিন্তু সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা এক আলাদা কাহিনী। প্রথমেই পৃথিবীর সাথে মঙ্গলকে তুলনা করতে গেলে মার্স একটি বিরাট মরুভূমি, যেখানে নেই পর্যাপ্ত পানির উৎস, এর মেরু এলাকায় কিছু পানির বরফ রয়েছে এবং হতে পারে সার্ফেসের কিছু অংশে তরল পানি রয়েছে, কিন্তু সেটা একেবারেই যথেষ্ট নয়। সম্পূর্ণ মার্স এক বিশাল শুকনো মরুভূমি যেখানে বালু আর পাথর ছাড়া আর কিছুই নেই।

আরেকটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে আমাদের বসবাস করার জন্য চাই সঠিক এবং সহনশীল তাপমাত্রা, সেদিক থেকেও মার্স একেবারেই বসবাসের অনুপযোগী। মঙ্গলের বায়ুমন্ডল অনেক পাতলা, তাই এতে গরম ধরে রাখার মতো ক্ষমতা নেই, তাই এই গ্রহ সম্পূর্ণ ফ্রিজিং কোল্ড পরিবেশের। মঙ্গলে গরমের দিনে সবচাইতে গরম স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হচ্ছে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যদিও এটা এতোটাও মন্দ নয় কিন্তু এর গড় তাপমাত্রা -৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -১৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যেটা সহ্য করা একেবারেই অসম্ভব। তবে ভবিষ্যতে হয়তো মার্সের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, বা স্পেশাল স্পেস স্যুট এবং স্পেশাল বাসস্থান বানিয়ে তাপমাত্রা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাপমাত্রায় এক মাত্র সমস্যা নয়।

মঙ্গলের বায়ুমন্ডল অত্যন্ত পাতলা এবং এর বায়ুচাপ অনেক কম, তাই যখন মানুষ ভর্তি স্পেসক্র্যাফট মঙ্গলের পৃষ্ঠে নামার জন্য চেষ্টা করবে, সেটার স্পীড কমানোর জন্য বায়ু যথেষ্ট সাপোর্ট করতে পারবে না। রকেট বুস্টার ব্যবহার করে হয়তো এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে, কিন্তু আরেকটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের বিরাট কমতি রয়েছে। এর বায়ুমণ্ডলের কেবল ০.১৪% অক্সিজেন রয়েছে, যেখানে পৃথিবীতে ২১% অক্সিজেন রয়েছে।

মঙ্গল গ্রহে বসবাসের আরেকটি বড়ো এবং বলতে পারেন সবচাইতে বড়ো ঝুঁকি হচ্ছে রেডিয়েশন। আমাদের প্ল্যানেট আর্থে রয়েছে সক্রিয় আইরন কোর, যেটার ফলে তৈরি করে সক্রিয় চৌম্বক ক্ষেত্র, আর এই চৌম্বক ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড সোলার রেডিয়েশন থেকে বা গভীর স্পেস থেকে আসা যে কোনো রেডিয়েশন থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে। মঙ্গলের কোর যেহেতু নিভুনিভু, তাই এর চৌম্বকক্ষেত্র অত্যন্ত কম বা বলতে পারেন নেই বরাবর, অর্থাৎ মঙ্গলে স্পেশাল স্পেস স্যুট পরিধান করে বসবাস করার পরেও রেডিয়েশন থেকে আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক অংশে বেড়ে যাবে। মঙ্গলে মাত্র কয়েকদিন কাটানো আর কোনো নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে ১০ বছরের বেশি সময় কাটানোর সমান রেডিয়েশনে আক্রান্ত হতে পারেন।

মঙ্গলে মানুষ বসবাসের উপযোগী হবে কী?
মঙ্গলের বর্তমান অবস্থা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, এটা বাসের পক্ষে কতোটা অনুপযোগী, তবে গবেষকরা যে পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন, যেগুলো প্রয়োগ করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে হয়তো এই গ্রহে প্রাণ টিকে রাখানো সম্ভব হতে পারে। মঙ্গলকে বাসের জন্য উপযোগী করে তুলতে অনেক বিষয়ের উপর পরিবর্তন আনতে হবে, আর প্ল্যানেটের মতো বিশাল কোনো অবজেক্ট, আর তারপরে আবার আমাদের প্ল্যানেট থেকে শতশত মিলিয়ন দূরের গ্রহের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোকে পরিবর্তন আনা একেবারেই মুখের কথা নয়।

মঙ্গলকে বাস উপযোগী বানাতে চারটি বিশেষ পরিবর্তন আনতে হবে, প্রথমত, এর তাপমাত্রা বাড়াতে হবে, যাতে ঠাণ্ডায় জমে কুলফি না হয়ে যান। দ্বিতীয়ত, বায়ুমন্ডলের চাপ বাড়াতে হবে, যাতে লিকুইড পানি সেখানে ধরে রাখা যায়। তৃতীয়ত, বায়ু পরিস্কার করতে হবে এবং অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে হবে, যাতে খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া সম্ভব হয় এবং চতুর্থত, ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করতে হবে যাতে সোলার রেডিয়েশন বা ডীপ স্পেস রেডিয়েশন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাহলেই মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাস সম্ভব হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here