মহান মে দিবস

1
304

এস এম হাসান
আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে (১৮৮৬ খ্রি.) আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষেরা যে দিবসের আলোকবর্তিকা জ্বেলেছিলেন, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের এক ঐতিহাসিক গৌরবময় সেদিনটি হলো ১লা মে। এই দিনটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তবে বিশ্বব্যাপী এই দিনটি ‘মে’ দিবস নামেই অধিক পরিচিত। এ দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। মে দিবস শ্রমিকদের একটি বড়ো বিজয়। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা বিজয়ের ইতিহাস রচনা করে।

শ্রমের মূল্য শ্রমিকদের মর্যাদা আদায়ে এই দিনটি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। চিরকাল মে দিবস উপলক্ষ্যে সারাবিশ্বের মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজ শ্রমের মূল্য, শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা নিয়ে কথা বলে থাকে কিন্তু বাস্তবে তা পরিপূর্ণভাবে সফল হয়নি।

আজকে যে শ্রমিকদের মজুরীর কথা সর্বজনীন বিশ্বজনিন হয়ে উঠেছে, ইসলাম ধর্মে শ্রমের মূল্য, শ্রমিকদের মর্যাদা আদায়ে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.) সাড়ে ১৪শ বছর আগেই বলেছেন, “তোমরা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে মজুরী পরিশোধ কর।” ইহা ইসলাম ধর্মের একটি মহৎ আদর্শ। অন্যায়-অত্যাচার জুলুম নির্যাতন-অবিচার বৈষম্য ইত্যাদি ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। মানবতা, উদারতা, মানব সেবা, মানব কল্যাণ, মহানুভবতা সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরপোকার ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলি বিকাশের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম মহিমায়িত হয়েছে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। মহানবি (সা.) বিদায় হজের ভাষণে নারী-পুরুষ, দাস-দাসীদের অধিকারের কথাও বলেছেন।

উন্নত প্রযুক্তির আশীর্বাদে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু দিন বদলের ছোঁয়া লাগেনি শ্রমিকদের জীবনে। ফলে দেখা যায় আবারও বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণ প্রতিনিয়ত তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। মে দিবসে অনিবার্যভাবে উঠে আসবে শ্রমিকের মজুরি ও নিরাপত্তার কথা। মজুরির একটা জাতীয় মানদন্ড নির্ধারণ আজ অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু শ্রমিকদের জন্যই এই মানদন্ড নির্ধারণ জরুরি নয়। দারিদ্র্য বিমোচনসহ সরকারের অসংখ্য কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন প্রকৃত রূপ লাভ করবে মজুরির মানদণ্ডের ওপর।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলতে হয় বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। যাদের প্রতিদিনের উপার্জনে প্রতিদিন চলে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মজুরি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারিত দারিদ্র্য সীমার নিচে। ইতিমধ্যে সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এসকল পদক্ষেপের সুফল ৫ কোটি মজুরি শ্রমিকের কাছে পৌঁছবে কীভাবে, তা ভাবতে হবে? যেখানে সরকারের নির্ধারিত মজুরিই একজন মানুষকে বাধ্য করছে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করতে। অধিকাংশ শিল্পখাতে শ্রমিকের জন্য মজুরির কোনো নির্ধারিত মানদণ্ডই নেই। সেখানে শ্রমজীবী মানুষ কীভাবে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করবে? কীভাবে গার্মেন্টস শ্রমিক তার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাবে? ৫ কোটি পরিবারকে দরিদ্র্যসীমার নিচে রেখে দারিদ্র্য বিমোচনে কতোখানি সাফল্যের মুখ দেখবে? এ প্রশ্নগুলো আজ ভাবতে হবে। তাই মজুরির প্রশ্ন আজ কেবল শ্রমিক বা তার পরিবারের কোনো স্বতন্ত্র বিষয় নয়। এর আন্তঃসম্পর্ক অনেক ব্যাপক ও গভীর। একে শুধু শ্রমিকের সঙ্গে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখলে চলবে না। একে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে।

ন্যায্য মজুরি না পেলে বা মজুরিই আদৌ না পেলে, ছুটি না পেলে, কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হলে এদের নালিশ করার কোনো জায়গা নেই। অনেক ক্ষেত্রে আইন তাদের নালিশ করার অধিকার দেয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ নেই যেখানে এই অসহায় শ্রমিক যেতে পারে। আশ্চর্য হলেও সত্য, একজন নারী শ্রমিক স্ত্রী হিসেবে স্বামীর বিরুদ্ধে দেনমোহর না দেওয়া বা নির্যাতনের জন্য মামলা করতে পারে। কিন্তু সেই নারী শ্রমিককে তার মালিক যদি কাজ করিয়ে মজুরি না দেয় বা ঠিক সময় মজুরি পরিশোধ না করে অথবা কাজ করতে গিয়ে কারখানার অব্যবস্থাপনার জন্য সে আহত হয় তাহলে ঐ নারী শ্রমিকের নালিশ জানাবার কোনো জায়গা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে কর্মরত কিছু সংখ্যক শ্রমিক ব্যতীত দেশের কোটি কোটি নারী ও পুরুষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে আজ এ কথা প্রযোজ্য।

বিশ্বায়নের কথা বলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের দায়বদ্ধতা যতোই হ্রাস করা হোক একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপেক্ষাকৃত সুবিধাপ্রাপ্তদের দ্বারা অধিকাংশ মানুষ যাতে শোষণ-বঞ্চনার শিকার না হয় এবং দেশের উন্নয়নে সবার ভূমিকা যাতে স্বীকৃত হয় ও উন্নয়নের সুফলে সবার ন্যায্য প্রাপ্তি যাতে নিশ্চিত হয় সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের। রাষ্ট্রের এই ভূমিকার ব্যত্যয় হয়েছিল বলেই মে দিবসের ঘটনা ঘটেছিল। মে দিবসের শিক্ষা নিয়ে এবং মে দিবসের আগের বাস্তবতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। এগিয়ে যাওয়ার কাফেলায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে মালিক ও শ্রমিক। আর এটা নিশ্চিত করা একটি দেশের গণতান্তি্রুক সরকারেরই দায়িত্ব।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here