মানবতার উৎকর্ষ সাধক কবি হাফিজ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মানবতার উৎকর্ষ সাধক কবি হাফিজ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহা
কুরআন মজিদ সম্পর্কে হাফিজের দক্ষতা
মহাকবি হাফিজের অনন্যতার একটি কারণ ছিল কুরআন মজিদের বিষয়ে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য। সামগ্রিক পর্যালোচনায় আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, হাফিজ সম্ভবত যে বিষয়টিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন তা ছিল, তিনি যে সময়টি ভ্রমণে কাটাতে পারতেন, সে সময়টিকে কুরআন মজিদ অনুধ্যানে বিনিয়োগ করেছেন। এ কারণেই তিনি হাফেজে কুরআন হতে পেরেছেন এবং ‘হাফেজ’ নামেই তাঁর খ্যাতি। তিনি ১৪টি ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা রীতিতে কুরআন পড়তে সক্ষম ছিলেন। হাফিজ বলেন,

এশকাত রসদ বে ফারয়া’দ আর খোদ বে সা’ন হাফেয
কুরআ’ন যে বর বেখা’নী দার চা’রদে রেওয়ায়াত
তোমার প্রেম চিৎকার দিয়ে উঠবে যদি হাফিজের মতো
কুরআন মুখস্ত পড় চৌদ্দ প্রকার রেওয়ায়েত সহকারে।
হাফিজের কবিতায় কুরআনের আয়াত বা আয়াতাংশের উদ্ধৃতি
১. হাফিজের কবিতায় ফাঁকে ফাঁকে কুরআন মজিদের কোনো আয়াত বা আয়াতাংশের উদ্ধৃতি এসেছে অতিশয় শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে। যেমন-
হুযুর খালওয়াতে উন্স আস্ত ওয়া দূস্তা’ন জামআন্দ
ওয়াইন য়াকা’দু বেখা’নীদ ও দার ফারা’য কুনীদ
উপস্থিতি তো সান্নিধ্যের নির্জনতা আর বন্ধুদের সমাগম
ওয়া ইন ইয়াকাদু তেলাওয়াত কর আর খুলে দাও দরজা।
২. হাফিজ কুরআন মজিদের ভাবার্থকেও কবিতার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন সূরা আহযাবের ৭৩নং আয়াতের ভাবার্থ ভাস্বর হয়েছে তাঁর এ কবিতায়-
আ’সেমা’ন বা’রে আমা’নত নাতাওয়ানেস্ত কাশীদ
কুরআয়ে ফা’ল বে না’মে মানে দীওয়ানে যাদান্দ
আসমান পারে নি বহন করতে এই আমানত ভার
অবশেষে আমি পাগলের নামে এল ভাগ্যফল তার।
৩. তিনি কুরআনে বর্র্র্র্ণিত কাহিনিকেও শিল্পিত আঙ্গিকে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায়। যেমন-
ইউসুফে গুম গাশতে বা’য আ’য়াদ বে কেনআ’ন গাম মাখূর
কুলবেয়ে আহযা’ন শাওয়াদ রূযী গুলেস্তা’ন গাম মাখূর
হারানো ইউসুফ কেনানে আবার আসবে ফিরে চিন্তা নেই
দুঃখের এ কুটির হবে একদিন ভরা ফুলবন চিন্তা নেই।
৪. কখনো গল্পের পিঠে গল্প দিয়ে সাজিয়েছেন তিনি কবিতার পসরা-
আই হুদহুদে সাবা’ বে সাবা’ মী ফেরেস্তামেত
বিনগার কে আয কোজো’ বে কোজো’ মী ফেরেস্তামেত
ওহে প্রভাতের হুদহুদ তোমায় পাঠাচ্ছি সাবায়
দেখ প্রেরণ করছি কোত্থেকে কোথায় তোমায়?
আল্লাহর বাণী কুরআনের ব্যাপারে এমন পান্ডিত্যই হাফেজকে কবিতার শিল্পে অনন্যতা দিয়েছে। আমরা আবারো হাফেজ ও ঠাকুর প্রসঙ্গে ফিরে আসছি।
হাফিজ ও ঠাকুরের মনোবৈজ্ঞানিক চেতনা

হাফিজ এমনভাবে মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন এবং তাতে এতখানি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন যে, প্রত্যেক যুগের মানুষ মনে করে যে, হাফিজ আমাদের নিয়েই কবিতা রচনা করেছেন। তিনি কবিতার মাধ্যমে চিকিৎসার কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। মানবতার সকল দুঃখ দরদ নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও আমরা তার সাক্ষাৎ পাই। তিনি বিশে^র জ্ঞানী-মনীষীদের সাথে সাক্ষাতে আলাপকালে ভারতবর্ষের জনগণ তথা এশিয়ার গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা এমনভাবে তুলে ধরেছেন যা দুনিয়ার যে কোনো স্বাধীনচেতা মানুষকে প্রশংসামুখর করে। রোমান রোলানের সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি ভারতীয়দের কাল্পনিক কুসংস্কার পূজা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও বিজ্ঞানকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করার বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করেন। তাতে রোলান কবির চিন্তাধারার উচ্চতায় অভীভূত হয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষে মানুষে হানাহানির প্রতি ভীষণভাবে রুষ্ট ছিলেন। তিনি সকল মানুষকে মনে করতেন ঈশ^রের সন্তান। কাজেই ঈশ^রের সন্তানদের হত্যা করা যাবে না, অন্যায়ভাব তাদের রক্তপাত ঘটানো যাবে না; বরং মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে মর্যাদা দিতে হবে। মানুষের ব্যক্তিসত্তার বিকাশের প্রতি তিনি অতিশয় গুরুত্ব আরোপ করতেন। হাফিজ সিরাজি কিন্তু ঠাকুরের এসব কথাকে একটি মাত্র বাক্যে অত্যন্ত শৈল্পিক দ্যোতনায় উপস্থাপন করে বলেছেন-
জা’না’ রওয়া’ নাবা’শাদ খোনরীয রা’ হেমা’য়েত

প্রিয়তম মোটেও বৈধ নয় রক্তপাতে সমর্থন জ্ঞাপন
রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচার-বিশ্লেষণে হাফিজ ও ঠাকুরের দক্ষতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের জন্য কবিতা লিখতেন, প্রবন্ধ রচনা করতেন, ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করতেন। তাঁর এসব রচনার অধিকাংশই উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তুর কারণে ভারতের জাতীয় রচনাবলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ জাতীয় রচনার মধ্যে অন্যতম হলো ‘জাতীয় আন্দোলন’ শীর্ষক সংকলন, যা ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
হাফিজ তাঁর রচনায় যুগের প্রদর্শনেচ্ছু প্রতারকদের প্রতি কটাক্ষবান নিক্ষেপ করেছেন। তিনি তথাকথিত শরিয়তের আইন প্রয়োগকারী, সুফি, সংসারত্যাগী, মুফতি, মুহতাসিব প্রভৃতি শ্রেণিকে প্রকাশ্যে তিরস্কার করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে হাফিজ হলেন সামাজিক বিশ্লেষক, সমালোচক ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকাকে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন এবং তার থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
চরিত্র নির্মাণে হাফিজ ও ঠাকুর
ব্যক্তি-চরিত্র নির্মাণে হাফিজ ও ঠাকুরের মধ্যে চমৎকার মিল দেখা যায়। যেমন ঠাকুরের কাছে যিনি বাউল, হাফেজের দৃষ্টিতে তিনি রেন্দ। বাউলদের অধিকাংশ হিন্দু; তবে কিছুসংখ্যক মুসলমানও আছে। এরা নিজেদেরকে সব ধরনের বাধা বন্ধন থেকে মুক্ত মনে করে। অন্যকথায় ‘আয রাঙ্গে তাআ‘ল্লুক আ’যা’দেগা’ন’
‘সম্পৃক্ততার রঙ হতে মুক্ত’। এই জগতের কোনো নিয়ম-কানুনের এরা ধার ধারে না এবং কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও অনুসরণ করে না। কারো আনুগত্য করে না।
হাফিজ ও ঠাকুর দুজনই সংস্কারক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তির পতাকাবাহী। বিশ^সমাজের জন্য তাঁর দরদ স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনজ্ঞাত। বিশে^র বিভিন্ন দেশে তাঁর বিভিন্ন সফর ও উদ্দীপনাময় ভাষণসমূহ তাঁর এই উন্নত ও সংস্কারবাদী চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। ঠাকুরের সংস্কার কার্যক্রম ও উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি তখনকার ভারত ও ভারতীয় সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি গোটা মানবসমাজের শান্তি ও সৌভাগ্যের প্রত্যাশী ছিলেন। এ কথার উত্তম প্রতিপাদ্য ছিল তাঁর রচিত ‘আফ্রিকা কাব্য’। তাতে তিনি যারা আফ্রিকার কালো মানুষকে দাসত্বে শৃঙ্খলিত করেছে তাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান। নাজীদের গণহত্যার প্রতিবাদেও তাঁর কবিতা বলিষ্ঠ ভাষায় প্রতিবাদ জানায়। ১৯০৭ সালে ভারতীয় কংগ্রেস যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অধিবেশনে মিলিত হয় তখন তিনি তাঁর রচিত একটি প্রার্থনা পাঠ করে শোনান। সেই প্রার্থনা শুধু ঈশ^রের সামনে তাঁর বিনয়, কাকুতি ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর প্রবল ইচ্ছার সাক্ষ্য বহন করে না; বরং তাতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং পছন্দনীয় কাজ ও কল্যাণধর্ম কার্য সম্পাদনে মহাপ্রভুর সমীপে দাবি ও আকুতি প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

জাতীয় জীবনের উৎকর্ষে হাফিজ ও ঠাকুরের সাফল্যের মূল্যায়ন
উপসংহারে আমি বলতে চাই যে, হাফিজ ও ঠাকুর শুধু ইরান, ভারত বা বাংলাদেশের জন্য কবিতা রচনা করেন নি; বরং গোটা এশিয়া তথা গোটা বিশে^র মানবতার উৎকর্ষ সাধনে কবিতার শক্তিকে ব্যবহার করেছেন। মানবতার কল্যাণের শাশ^ত চেতনা উভয় কবিকে ইতিহাসের বিস্তর দূরত্ব সত্ত্বেও পরস্পরের একান্ত নিকটে নিয়ে এসেছে।
অনুবাদ: ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *