‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’

0
938

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: গত ২৫ মে, সোমবার ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২১তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি উপলক্ষ্যে তার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শ্রদ্ধা জানানো শেষে জাতীয় কবির আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন তিনি। এসময় তিনি, ‘করোনা মোকাবেলায় কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যের বাণী সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।’ বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে জানান মন্ত্রী।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষ থেকে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানায়।

দিবসটি উপলক্ষ্যে বিশ্বখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগল বিশেষ ডুডল প্রকাশ করেছে। কবি নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়। তার কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ।

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া।

সৈনিক হিসেবে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া নজরুল কাজ করেছেন সাংবাদিক হিসেবেও। অসহযোগ আন্দোলনে তিনি তার লেখা বিখ্যাত সব কবিতার জন্য বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। নজরুল চার হাজারের বেশি সংগীত রচনা করেছেন, যা নজরুল সংগীত হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও তার লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। চলচ্চিত্র পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন তিনি। জাতীয় কবি নজরুল ১৯৭৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

কবি নজরুল বেঁচে ছিলেন ৭৭ বছর। কিন্তু তার মধ্যে ৩৪ বছর অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন। জন্মের পর থেকে মাত্র ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। এর মাঝে সাহিত্য রচনার কাল ছিল মাত্র ২৪ বছর। তিনি নির্বাক হয়েছিলেন ৭৭ বছর আগে, তার মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি প্রায় ৪৩ বছর। তার মানে প্রায় আট দশক তিনি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। তার পরও বাঙালির জীবনে নজরুলের দিগন্তবিস্তারি প্রভাব রয়েছে! কেন?

গবেষকরা বলছেন, সাহিত্য রচনার সময়কালের ব্যাপ্তি যাই হোক না কেন নজরুলের প্রভাব শতাব্দী পেরিয়ে আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মানবতাবাদী কবি নজরুল একুশ শতকে এসে হয়ে উঠেছেন মনুষ্যত্বের কবি। যখন দেশে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার বাড়ছে। তার বিপরীতে, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি নজরুল চর্চার বিকল্প নেই।

তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীকে। নজরুল তার কবিতা, গান, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করেছে এবং কারাদন্ড দিয়েছে। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করে বিদেশি সরকারের জেলজুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন।

রবীন্দ্রসৃষ্ট বিশাল জগতের পাশে কবি নজরুল গড়ে তোলেন নিজস্ব জগৎ। সেখানে ফুটিয়ে তোলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সদম্ভ অভ্যুদয়কে এই বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।


তার কবিতা ‘চল চল চল’ বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। দ্রোহ, প্রেম, মানবতা কবির রচনাকে করেছে চিরন্তন, নিয়ে গেছে গণমানুষের কাছাকাছি। কবিতায় বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান…’। কবির এমন অজস্র রচনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালিদের দিয়েছে শক্তি ও যুগিয়েছে প্রেরণা। এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তার রচনা আমাদের গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here