মূল্যবোধের শিক্ষা: গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা


আহম্মদ উল্লাহ
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষায় মূল্যবোধের অবক্ষয় জনিত উদ্বেগ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বর্তমান যুগকে বলা হয় ক্ষমতা ও গতির যুগ। প্রতিটি ক্ষণস্থায়ী দিন ক্ষমতার বর্ধিত সম্ভাবনা তৈরি করে যার পরিণত জীবনযাপনের গতির ক্রমবর্ধমানশীলতা। আবার বর্তমান যুগকে অসীম এবং ক্রমপ্রসারমান জ্ঞানের যুগও বলা হয়। ‘জ্ঞানই শক্তি বা ক্ষমতা’ এটি আধুনিক পৃথিবীর একটি অন্যতম স্লোগান। এ সময়ে জ্ঞান বলতে বিজ্ঞানের জ্ঞানের প্রাধান্যকে বোঝায়। আধুনিক মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই আজ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত। বর্তমান প্রজন্মের নিকট বিজ্ঞানের জ্ঞানই যথার্থ ও সময়োপযোগী জ্ঞান বিবেচিত আর বৈজ্ঞানিকগণ অধিষ্ঠিত হচ্ছেন সাধারণ প্রশংসার স্তম্ভমূলে। বৈজ্ঞানিক অর্জন বিবেচিত হচ্ছে একরম রক্ষাকবচ হিসেবে। এ কথা সত্য যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সফলতা একদিকে যেমন মানুষের জীবনকে উন্নত ও বর্ধিত করছে অন্যদিকে তেমনি এটি তার ধ্বংসের রসদও সরবরাহ করছে। জ্ঞানের ক্রমাগত উন্নয়ন ক্ষমতাকে একদিকে যেভাবে সহজলভ্য করছে অন্যদিকে সেই ক্ষমতা আবার মন্দের নিয়ামক হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দেরিতে হলেও এই সচেতনতা তৈরির আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, ক্ষমতাই সবকিছু নয়। তাই প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে জ্ঞান ও ক্ষমতার যথাযথ সমন্বয় ও তার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে চিন্তা করার। বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেন “মানুষ যদি তার অর্জিত ক্ষমতা নিয়ে বাঁচতে চায় তবে তাকে কেবল মনের দিক দিয়ে নয় হৃদয়ের দিক দিয়েও বড় হতে হবে বা বেড়ে উঠতে হবে।”


প্রত্যেক ব্যক্তি জীবনের পথে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যক্তিগত চাহিদা ও সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে নিজস্ব একটি জীবনাদর্শ গড়ে তোলে। ব্যক্তির জীবনাদর্শের সাথে যুক্ত যে অনুভূতিগুলো তাকেই বলা হয় মূল্যবোধ। স্বাভাবিকভাবে ব্যক্তিজীবনের এই মূল্যবোধ ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার এবং সামাজিক চর্চা বা অনুশীলন দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ ধারাগুলির কোনো একটিতে পরিবর্তন হলে ব্যক্তির জীবনে মূল্যবোধের সংকট তৈরি হয়। ব্যক্তি তথা সমাজ জীবনে মূল্যবোধের যে সংকট তৈরি হয় তা নানা নামে অভিহিত করা হয়। যথা: ধর্মীয় মূল্যবোধের সংকট, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংকট, সামাজিক মূল্যবোধের সংকট, নৈতিক মূল্যবোধের সংকট ইত্যাদি। মূল্যবোধের এমন সংকটের অন্যতম কারণ হলো গতানুগতিক ও আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যকার সংঘাত। কেননা আধুনিক যুগ জ্ঞান ও ক্ষমতার যুগ। এ যুগে জ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তনের কারণে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ এই দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থায় কোনো জ্ঞানই স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে একরকম অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যার ফলে নানাবিধ সংকট তৈরির মধ্যদিয়ে মানব জীবন হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রণহীন, অস্থিতিশীল। যা থেকে মুক্তির আকাঙ্খা আজ মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্পষ্ট। এ সংকট নিরসনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।


মূল্যবোধ মানব আচরণের নির্ধারক। ব্যক্তিক ও সমষ্টিক উভয় জীবনেই এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধ মানুষের আচরণের স্থায়ী মানদণ্ড তৈরি করে। আমরা বর্তমানে পরস্পর বিরোধী বা স্ব-বিরোধী একটি পৃথিবীতে বাস করছি। যে পৃথিবীতে একদিকে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্রুতি এগিয়ে চলছে অন্যদিকে বেশিরভাগ সমাজই আজ নৈতিক, মানবিক, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের এক রকম বিলুপ্তি লক্ষ্যণীয়। স্নেহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, আতিথেয়তা, সৌজন্যবোধ, সততা, শ্রদ্ধাশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা, সহযোগিতা, বিশ্বস্ততা, বিশুদ্ধতা, স্বার্থহীনতা, আধ্যাত্মিকতা, নম্রতা, বিনয়, পরার্থপরতা, ক্ষমাশীলতা, ইত্যাদি সর্বজন স্বীকৃত, আকাঙ্খিত ও লালিত মূল্যবোধগুলির ভয়ঙ্কর রকমের হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র পৃথিবীতে হিংসা, বর্বরতা, দলাদলি, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা স্বার্থপরতা, অতিব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রভৃতি অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সমাজকে করেছে কলুষিত। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে প্রায়শই আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রী কর্তৃক শিক্ষক নিগ্রহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী নিগ্রহ, নারী নির্যাতন ধর্ষণ, খুনের ঘটনা, পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা বা সন্তান কর্তৃক পিতামাতার হত্যা, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীবৃন্দের পারস্পরিক অকথ্য কুভাষণ, মন্ত্রীদের দুর্নীতি, অনৈতিক জীবনযাপন, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি অমানবিক বিষয়বলি। এমন বাস্তবতায় মূল্যবোধের শিক্ষা তাই খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। বলা যেতে যেতে পারে এটি আধুনিক সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা।


মানবিক ইতিবাচক আচরণের ক্ষেত্রে মূল্যবোধের ভূমিকা অপরিহার্য। আর এই অপরিহার্য বিষয়টির যথাযথ লালন ও প্রয়োগ সম্ভব শিক্ষা তথা মূল্যবোধের শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষার সাথে মূল্যবোধের ধারণা সম্পর্ক সহজাত বা বলা যায় মজ্জাগত। মূল্যবোধ এমনিতেই গড়ে ওঠে না। কোনো মানুষই পরিস্থিতি, ঘটনা, ব্যক্তিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। এসব মূল্যবোধ ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্মতিতে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠে এবং বিকাশ লাভ করে। শিক্ষাকে বলা হয় ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রক্রিয়া। ব্যক্তিত্ব বিকাশের একটি অপরিহার্য উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষা সব সময়ই সমাজের সাথে সম্পর্কিত। শিক্ষার ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় মাত্রাই রয়েছে। মূল্যবোধ ছাড়া শিক্ষা অর্থহীন। তাই শিক্ষার সকল ক্ষেত্রেই মূল্যবোধের শিক্ষার গঠন ও বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষা যাকে বলা যায় ধারাবাহিক লেখার অভিজ্ঞতা, সে শিক্ষা কেবল আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সফলতার ক্ষেত্রই তৈরি করে না পাশাপাশি মানব জীবনের তিনটি গুরুত্ব দিক যথা: শারীরিক, মানসিক এবং চারিত্রিক দিকের বিকাশের চেষ্টা করে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও তৃতীয়টি অর্থাৎ চারিত্রিক দিকটির সঠিক ও পূর্ণ বিকাশ না হলে এগুলো বিপজ্জনক।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দিকটির বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কেননা আমাদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্যগুলোর একটি হলো নিজেকে জানা। আর যথাযথ শিক্ষা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কারণ শিক্ষা আমাদের ব্যবহারিক জীবনের উপযোগী ও দক্ষ করার পাশাপাশি জীবনের পূর্ণ বিকাশেরও অপরিহার্য শর্ত। লক্ষ্যণীয় যে, মূল্যবোধের শিক্ষা কি এ বিষয়ে মতভেদ থাকলেও মূল্যবোধের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই।


বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বিকাশের প্রতি যত্নশীল কিছু শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক বিকাশে ব্যর্থ। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত বিকাশ সম্ভব হয়েছে সত্য কিন্তু মানুষের বিশুদ্ধ নৈতিক, আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি সম্ভবপর হয়নি। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, প্রতিযোগিতা, ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, তথ্য জানা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যা যথার্থ শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তাই সময় এসেছে মূল্যবোধের শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাববার। শিক্ষার উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত মূল্যবোধের শিক্ষার বিষয়টি অপরিহার্য করবার। যার অভাবে মানুষ আজ আদর্শ বিমুখ হয়েছে এবং একরকম আধ্যাত্মিক শূন্যতার মধ্যে বসবাস করছে। নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি মানুষ আজ শ্রদ্ধাশীল নয়। বস্তবাদী সমাজে মানুষ সঠিক বা ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ। ধর্ম এখন কেবল ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পদ ও ক্ষমতাকে এখন সর্বোচ্চ সম্মানজনক বিবেচনা করা হচ্ছে। যে কারণে মানবিক সম্পর্ক আজ নৈর্ব্যক্তিক ও গৌণ হয়ে পড়েছে। শিক্ষক, শিক্ষাবিদদের মধ্যে নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অবনমন আধুনিক সমাজে মূল্যবোধের বিলোপের আজ একটি প্রকাশ। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষানীতি তৈরিতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পেশাগত মান ও দক্ষতার প্রতি জোড় দেওয়া হচ্ছে। ফলে মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শিক্ষার ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত হচ্ছে না। যার পরিণতি শিক্ষার্থীরা আজ বেকার ও হতাশগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থার অতি বেসরকারিকরণ শিক্ষার নৈতিক মূল্যবোধ হ্রাসের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানে শিক্ষাকে পণ্য আর শিক্ষার্থীকে গ্রাহক বিবেচনা করছে। যার কারণে শিক্ষার কেবল বাজারজাত করণই হচ্ছে, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরিতে তা ব্যর্থ হচ্ছে।


কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মূল্যবোধ বলতে আসলে কি বোঝায় এবং কোনো কোনো মূল্যবোধের শিক্ষা উদ্ভুত সামাজিক সংকট নিরসনে কার্যকর? এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মূল্যবোধ ও মূল্যবোধের শিক্ষার ধারণার স্পষ্টকরণ জরুরি। এ বিষয়গুলির ধারণার স্পষ্টকরণের উপরই প্রশ্নের পরবর্তী অংশের উত্তর নিহিত। মূল্যবোধের ধারণাকে সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় অর্থেই ব্যাখ্যা করা যায়। সংকীর্ণ অর্থে বাস্তব বিনিময় মূল্যই মূল্যবোধের মানদণ্ড। কিন্তু শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে এই অর্থকে গ্রহণ করা যায় না। এক্ষেত্রে মূল্যবোধ বলতে বলা যেতে পারে- এটি এমন বোধ বা উপলব্ধি যা মানুষকে ভালো, সত্য, ন্যায় প্রভৃতিকে গ্রহণ করতে শেখায় এবং তার বিপরীতগুলিকে বর্জন করতে শেখায়। অর্থাৎ এটি একদিকে আমাদেরকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায় তেমনি উচিত-অনুচিতের দ্বন্দে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ মানুষের বিভিন্ন বিকল্পসমূহের মধ্যে একটি যা মানুষ নির্বাচন করে এবং সে অনুযায়ী আচরণ করে। কেননা এটি মানুষের বিকাশকে সম্পূর্ণ করে। আর মূল্যবোধ সমষ্টি তথা দল, সম্প্রদায় বা সমাজের সম্মিলিত সম্মতির মাধ্যমেই তৈরি হয়।
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here