নির্মানের উদ্যোগ: ১৯৬১ সালে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
স্থান নির্বাচন: পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুর-কে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ১৯৬২-১৯৬৮ সালের মধ্যে একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের যথার্থতা যাচাই করা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজ আংশিক সম্পন্ন করা হয়।
প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত: ১৯৬৯-১৯৭০ সালের মধ্যেই ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।
পুনরায় নির্মানের উদ্যোগ: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৭২-১৯৭৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে জাতির জনক এ ঘোষণা দেন ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন ।
ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন: ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মেসার্স সোফরাটম কর্তৃক পরিচালিত ফিজিবিলিটি স্টাডির মাধ্যমে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন যৌক্তিক বলে বিবেচিত হয়।
সেসময় একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১২৫ মেগা ওয়াট) নির্মাণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।
২য় ফিজিবিলিটি স্টাডি: জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানি কর্তৃক ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়। উক্ত স্টাডির মাধ্যমে প্রকল্পের আর্থিক ও কারিগরী যৌক্তিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ স্টাডিতে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
বাস্তবায়ন শুরু: বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম.এ ওয়াজেদ মিয়া কর্তৃক ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল, এ সময়ে মানব সম্পদ উন্নয়নসহ কিছু প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশান প্লান-২০০০ অনুমোদিত হয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে রুপপুর প্রকল্প: ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়।
রোসাটমের সাথে সমঝোতা স্বারক সাক্ষর: ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলী সম্পাদন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলী ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
২০০৯ সালের ১৩ মে বংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশনের স্টেট এ্যটমিক এনার্জি কর্পোরেশন (রোসাটোম)-এর মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি সই
২০১০ সালের ২১ মে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক Framework Agreement স্বাক্ষরিত হয়।
প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় কমিটি, মাননীয় মন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সভাপতিত্বে কারিগরি কমিটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ ও ৮টি সাবগ্রুপ গঠন করা হয়।
জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহন: ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর মহান জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
আইএইএ’র মহাপরিচালকের সফর: ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক মি. ইউকিআ আমানো বাংলাদেশ সফর করেন এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে আইএইএ থেকে সকল ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
পারমাণবিক অবকাঠামোর মূল্যায়ন: ২০১১ সালের ৯-১৫ নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পারমাণবিক অবকাঠামোর সার্বিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য IAEA Integrated Nuclear Infrastructure Review (INIR) mission পরিচালিত হয়।
আন্তরাষ্ট্রিয় সহযোগিতা চুক্তি: ২০১১ সালের ২ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্ত রাষ্ট্রিয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ: ২০১২ সালের ১৯ জুন ইBangladesh Atomic Energy Regulatory Act-২০১২ পাশ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর ও চুক্তি: মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাশান ফেডারেশন সফরকালে (১৫ জানুয়ারী ২০১৩) রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের Preperatory stage of construction কার্যাদি সম্পাদনের জন্য State Export Credit চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাক্ষরিত আন্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি (IGA) এবং State Export Credit Agreement-এর ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন (১ম পর্যায়) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন: ২০১৩ সালের অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন জারি: ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের Operating Organization প্রতিষ্ঠা ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বিধান সম্বলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আইন, ২০১৫ জারি করা হয়।
কোম্পানি গঠন: ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য Nuclear Power Plant Company Bangladesh Limited (NPCBL) গঠন করা হয়।
জেনারেল কনটাক্ট স্বাক্ষরিত: ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মূল পর্যায়ের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য General Contract for Rooppur Nuclear Power Plant Construction স্বাক্ষরিত হয়।
অগ্রগতি রিভিউ ও লাইসেন্স প্রদান: ২০১৬ সালের ১০-১৪ মে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পারমাণবিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ও AEA-এর সুপারিশ বাস্তবায়ন অগ্রগতি রিভিউ করার জন্য INIR follow-up mission পরিচালনা করা হয়।
২০১৬ সালের ২১ জুন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের Site Licence প্রদান করা হয়।
টেস্ট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর: ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে স্টেট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
যুগ্ম সমন্বয় কমিটির সভা ও গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ে রাশান ফেডারেশন ও বাংলাদেশ পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত Joint Coordinating Committee (JCC)-এর একটি সভা গত ২২ জুন ২০১৬ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট Spent nuclear fuel management, nuclear fuel supply Ges operation and maintenance সংক্রান্ত Contract -এর বিষয়ে কতিপয় গরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
জ্বালানি বর্জ্য ফিরিয়ে নিতে চুক্তু স্বাক্ষরিত: ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশনের মধ্যে “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে পারস্পরিক সহায়তা” সংক্রান্ত একটি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ভারতের বিভিন্ন সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর: ২০১৭ সালের এপ্রিল পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ন ব্যবহারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার এবং গ্লোবাল সেন্টার ফর নিউক্লিয়ার এনার্জি পার্টনারশিপ ( জিসিএনইপি), ভারতের পরমাণু শক্তি সংস্থা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে।
আইএইএ’র মহাপরিচালকের সফর ও সন্তোষ প্রকাশ: আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক ইঊকিয়া আমানো ২০১৭ সালের ৩ জুলাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি এ কেন্দ্র স্থাপনে সকল আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও রাশান ফেডারেশনের সাথে ২০১৭ সালের ৩০আগস্ট এক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশনের লাইসেন্স প্রদান: ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অনুকূলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের Design and Construction License প্রদান করা হয়।
নির্মাণ কাজের উদ্বোধন: ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১নং ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই মাননীয় প্রধান মন্ত্রী উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথে পা দিয়েছে এবং দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ ক্লাবে পদার্পণ করেছে। আশা করা যায়, আগামী ২০২৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে।