সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারী-বেসরকারী অফিসে সাধারণ ছুটির মেয়াদ ষষ্ঠবারের মতো বাড়িয়েছে। এই ছুটির মেয়াদ চলবে ১৬ মে পর্যন্ত। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি অথবা অবনতি সাপেক্ষে এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানো-কমানোর বিষয়টি নির্ভরশীল। ২৬ মার্চ থেকে প্রায় একটানা কার্যকর এই ছুটির কবলে পড়ে ৫২ দিন ধরে দেশ থাকছে কার্যত অবরুদ্ধপ্রায় তথা লকডাউনে। এই প্রেক্ষাপটে যে প্রশ্নটি অনিবার্য সামনে চলে এসেছে তা হলো, মানুষের জীবন না জীবিকা- কোনটি আগে! বর্তমান বিশ্বায়িত বিশ্বে এটি এক অদৃষ্টপূর্ব প্রশ্ন ও পরিস্থিতি। চীনের উহানে উদ্ভূত এই ভয়ঙ্কর হন্তারক মহামারিসদৃশ ভাইরাসটি আক্রান্ত করেছে প্রায় সমগ্র বিশ্বকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানিসহ উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে রীতিমতো নাজেহাল ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের অর্থনীতি তো দূরের কথা, প্রায় সব দেশেরই দৈনন্দিন অর্থনীতির চাকা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে যার যার জাতীয় প্রবৃদ্ধি তো কমছেই, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আয়-উপার্জনও গেছে কমে অথবা নেই বললেই চলে।
বিশ্বব্যাপী গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষজন পড়েছেন সমূহ বিপদে। এমনকি দৈনন্দিন আহার যোগাতেও হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অনেক দেশই, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও, যথাসাধ্য প্রণোদনা দিচ্ছে- খাদ্য সংস্থানসহ নগদ অর্থে। তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সরকারী প্রণোদনা ব্যক্তি ও পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট ও পর্যাপ্ত নয়। তদুপরি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সবাই এই সুবিধার আওতায় আসতে পারেন না। ফলে ক্ষুণ্ন্নিবৃত্তির জন্য কিছু মানুষের জীবন-সংগ্রাম চলতেই থাকে। এ পর্যায়ে লকডাউন বা শাটডাউন দীর্ঘায়িত হলে প্রান্তিক গোষ্ঠীর দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রাম আরও বাড়তে থাকে। এরই একপর্যায়ে তারা দলে দলে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন রাজপথে। এই অবস্থা শুধু বাংলাদেশে নয়, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্সসহ অনেক দেশেই প্রত্যক্ষ করা গেছে। উন্নত বিশ্বেও শ্লোগান উঠেছে- ‘নট করোনা- বাট পোভার্টি কিলস’।
বাংলাদেশে বর্তমান সরকার অবশ্য বিশেষ করে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে যথাসম্ভব দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এক কোটি ওএমএস কার্ডের আওতায় অন্তত পাঁচ কোটি লোককে নিয়ে আসার চেষ্টা চলেছে রেশনিংয়ের আওতায়। দশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে দেওয়া হচ্ছে নানাবিধ নিত্যপণ্য। এসব বাস্তবতা এবং জনহিতকর উদ্যোগ সত্ত্বেও প্রায় সর্বস্তরের মানুষ পথে নামতে চায় ব্যক্তিগত আয়-উপার্জনের অনিবার্য তাগিদে। মানুষের এই ব্যক্তি উদ্যোগ ও আগ্রহের প্রশংসা করতেই হবে অকুণ্ঠচিত্তে। সরকার প্রধানত তাদের কথা চিন্তা করেই লকডাউন পরিস্থিতির শর্ত কিছু শিথিল করেছে। যেমন- ব্যক্তিগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে খোলার অনুমতি দিয়েছে পোশাকসহ কিছু শিল্প-কারখানা।
তবে এও সত্য যে, সব শিল্প-কারখানায় সর্বত্র এই শর্ত মানা সম্ভব নয়। এগুলোর সঙ্গে শ্রমজীবীর আহার, বাসস্থান, যাতায়াত ইত্যাদিও জড়িত। এর পাশাপাশি রোজা ও ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে সর্বস্তরের মানুষের চাহিদাও বেড়ে যায় অনেকগুণ। এ পর্যায়ে কোটি কোটি শ্রমজীবীর বেতন-বোনাসের বিষয়টিও জড়িত ওতপ্রোতভাবে। এর জন্য সরকারী প্রণোদনার পাশাপাশি আবশ্যক বেসরকারী উদ্যোগও। সরকার পোশাক খাত, কৃষি, শিল্প সেক্টরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধির ধারা এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তা সহায়ক হবে নিশ্চয়ই।
বাংলাদেশ অবশ্য এদিক থেকে ভাল অবস্থানে রয়েছে। বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় আগামীতে খাদ্য সঙ্কট এড়ানো যেতে পারে। গ্রামগঞ্জের ধান-চালের মোকামগুলো এখন জমজমাট। তবে বহির্বিশ্বে পোশাক রফতানির চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। পোশাক শিল্প মালিকরা তা দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন নিশ্চয়ই।
সরকার গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে বলা চলে। তবু সতর্ক ও সাবধানতার বিকল্প নেই। সে অবস্থায় যথাযথ সুরক্ষাসহ শিল্প-কারখানাসহ মেগা প্রকল্পগুলো সচল এবং সর্বস্তরের মানুষ উদ্যোগী হলে জীবন-জীবিকা চলতে পারে হাত ধরাধরি করে।