নারী ও শিশু ডেস্ক: অনেকেই এটা উপলব্ধি করতে পারেন না যে, গর্ভে থাকা ভ্রূণ একটি পরিপূর্ণ মানুষের অধিকারপ্রাপ্ত। ভ্রূণের ক্ষতি করার অধিকার কারো নেই। পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, কেউ যদি মনে করেন আগত শিশুকে লালনপালন করা তার পক্ষে হয়ত সম্ভব হবে না এবং সেই ভয়ে ভ্রূণকে মেরে ফেলেন, তাহলে সেটি মহাপাপ বলে বিবেচিত হবে৷
প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার সূচনা হয় মাতৃগর্ভে। মাতৃগর্ভ থেকেই শিশুর খাদ্য ও পুষ্টির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হয়। গর্ভবতী মায়ের সুস্থতার পাশাপাশি মাতৃগর্ভে থাকা শিশুকে ভালো ও সুস্থ রাখতে মায়ের যথোপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যা দরকার। একজন গর্ভবতী মা তার শরীরের মধ্যে ধারণ করছেন আরেকজন ক্ষুদ্রাকৃতির মানুষ। পেটের ভেতর ছোট্ট এ মানুষটির বেড়ে ওঠার জন্য স্বাভাবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি দরকার। এর মধ্যে খাদ্য, আলো, বাতাস, বিশ্রাম ও সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ অন্যতম। ইসলাম ধর্মে এ বিষয়ে নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসলামি নীতিমালায় গর্ভবতী নারী ও গর্ভে থাকা ভ্রূণের যত্ম ও পরিচর্যাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মায়ের গর্ভে প্রাণ সঞ্চারের পর থেকে ভ্রূণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। গর্ভের শিশু মায়ের শরীর থেকে তার প্রয়োজনীয় আমিষ, শর্করা, স্নেহ, বিভিন্ন খনিজ লবণ ও ভিটামিন নিয়মিত সংগ্রহ করে। এ কারণে গর্ভবতী মায়ের শরীরে সব ধরনের পুষ্টি উৎপাদনের চাহিদা বেড়ে যায়। তখন প্রতিদিন অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়। একই সাথে আমিষ, ক্যালসিয়াম ও লৌহ বা আয়রনের প্রয়োজন বেড়ে যায়। সন্তান গর্ভে থাকলে মায়ের প্রয়োজন অনুসারে বাড়তি খাবার খেতে হয়। গর্ভবতী মা যদি সুষম খাবার পর্যাপ্ত গ্রহণ না করেন তাহলে গর্ভস্থ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। মায়ের অপুষ্টির জন্য সাধারণত দুর্বল শিশু জন্মগ্রহণ করে এবং জন্মের সময় শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়। ফলে শিশু নানা ধরনের অসুবিধা ও রোগের সম্মুখীন হয়। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে মা ও বাবা উভয়ের ভূমিকা থাকলেও বাস্তবতা হলো গর্ভস্থ শিশুকে পৃথিবীতে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকাই প্রধান।
শিশুকে সুস্থভাবে পৃথিবীতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকার প্রতি অত্যন্ত সম্মান দেখিয়েছে ইসলাম ধর্ম। সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সন্তান গর্ভে ধারণ করাকে ইবাদত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, গর্ভবতী নারী ওই ব্যক্তির মতো যিনি সারাদিন রোজা রাখেন এবং রাত জেগে ইবাদত করেন। গর্ভবতী নারীকে যুদ্ধের ময়দানে জান-মাল দিয়ে সত্যের জন্য জিহাদকারী ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামে একজন গর্ভবতী নারী মুজাহিদের মর্যাদা পেয়ে থাকেন।
গর্ভবতী নারীর জন্য সুষম খাদ্যের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীসহ পরিবারের সব সদস্যের পক্ষ থেকে মানসিক সমর্থন এ সময় খুবই জরুরি। গর্ভবতী নারী যদি বুঝতে পারেন সবাই তার পাশে রয়েছে এবং মায়া-মমতায় আগলে রেখেছে তাহলে এই সময়ের কষ্ট সহ্য করা তার জন্য সহজ হয়। মায়ের মানসিক প্রশান্তি গর্ভের সন্তানের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আসলে গর্ভে সন্তান আসার পর একজন নারী শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়। বমি থেকে শুরু করে মাথা ও কোমর ব্যথার মতো সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে আরও নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পবিত্র কুরআনের সূরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে।
প্রত্যেক মা যে তার সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কত কষ্ট করেন তা এই আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই আয়াতে মায়ের প্রতি মানসিক সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। মায়ের গর্ভে সন্তানের ভ্রূণ সৃষ্টিতে পিতা-মাতা দু’জনেরই ভূমিকা থাকলেও এরপর নয় মাসের গর্ভধারণ এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশুকে দুই বছর দুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব মাকেই পালন করতে হয়।
যখন একটি শিশু সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় থাকে তখন মা তাকে বুকের দুধ পান করিয়ে- প্রাণের সব মমতা ঢেলে দিয়ে সন্তানকে একটু একটু করে বড়ো করে তোলেন। নবজাতককে জন্ম দিতে এবং এরপর দুই বছর তাকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে মায়ের অসহনীয় কষ্ট হয় এবং তিনি এজন্য দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সূরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে এ বিষয়টির প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত একজন নারীর জন্য নানা ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন প্রয়োজন। গর্ভবতী নারীর জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম জরুরি। পাশাপাশি গর্ভবতী মায়ের রক্তশূন্যতা দূর করতে হবে। অন্য কোনো জটিলতা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে। কোনো কারণে গর্ভবতী মায়ের যদি তামাক সেবন, ধূমপান ও মাদক দ্রব্য নেওয়ার অভ্যাস থেকে থাকে তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। তাই অনাগত শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে এসব কুঅভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। গর্ভবতী মা-কে গর্ভকালীন সময়ে প্রয়োজনীয় টিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তার বয়স নয় মাস অতিক্রম করেছে। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম ভ্রূণকেও মানুষের মর্যাদা দিয়েছে এবং শিশু যখন ভ্রূণ অবস্থায় মায়ের গর্ভে থাকে, তখন থেকেই শিশুর যত্ন নিতে বলেছে।