শিশু অধিকার ও ইসলাম (পর্ব ৫) : জেনেভা সনদ

0
549

নারী ও শিশু ডেস্ক: শিশু অধিকার বিষয়ক প্রথম আন্তর্জাতিক সনদ হচ্ছে শিশু অধিকার সনদ। ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য শিশু অধিকার ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ পাস হয়। এই সনদকে কখনো কখনো জেনেভা সনদ নামেও অভিহিত করা হয়।

১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে গৃহীত এই সনদের ভূমিকায় বলা হয়েছে, শিশুরা যেহেতু মানসিক ও দৈহিকভাবে অপরিণত সেহেতু জন্মের আগে ও পরে তাদের জন্য বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন এবং তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি তাদের জন্য যথাযথ আইনি সহযোগিতা প্রয়োজন। এরপর আরও বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানব সন্তান শিশুকালে যাতে সুখে থাকতে পারে এবং স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে পারে সে লক্ষ্যেই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এই সনদ অনুমোদন করেছে।

১৯৫৯ সালে সনদটি পাস হওয়ার ফলে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো শিশু অধিকার রক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এর ভিত্তিতে অনেক দেশ নিজেদের আইন ও নীতিমালায় পরিবর্তন আনে। শিশু অধিকার সনদ পাসের পর এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন প্রনয়ণের চেষ্টাও জোরদার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ দিনের আলোচনার পর ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার কনভেনশন পাস হয়। এর বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯০ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৮৯টি দেশ এই কনভেনশনে সই করেছে। এটিও হচ্ছে শিশু অধিকার বিষয়ক একটি বিশেষ সনদ।

শিশুরা সর্বত্র বৈষম্যহীনভাবে ভোগ করতে পারে এমন কিছু মৌলিক মানবাধিকারের কথা এতে বলা হয়েছে। যেমন- বেঁচে থাকার অধিকার; মত প্রকাশের অধিকার; পূর্ণ মাত্রায় বিকাশের অধিকার; কুপ্রভাব, নির্যাতন ও শোষণ থেকে নিরাপদ থাকার অধিকার; পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে পুরোপুরি অংশগ্রহণের অধিকার। কনভেনশনে বর্ণিত প্রতিটি অধিকার প্রত্যেক শিশুর মানবিক মর্যাদা ও সুষম বিকাশের জন্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী শিশু অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন শিশুর বাবা-মা। কনভেনশনে স্বাক্ষারকারী দেশগুলো ১৮ নম্বর ধারায় এই বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন যে, শিশুর বিকাশ ও উন্নয়নে বাবা-মা যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল। ঐশী ধর্ম ইসলামেও বলা হয়েছে, শিশু লালন-পালন ও তার বিকাশ ও উন্নয়নের মূল দায়িত্ব বাবা-মা’র ওপর বর্তায়। বলা হয়েছে, শিশুরা হচ্ছে পরিবারের জন্য বরকত। আল্লাহ্ তায়ালা বাবা-মা’র জন্য শিশুকে নেয়ামত হিসেবে দিয়েছেন। কাজেই সবাইকে শিশুর মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় এর জন্যও আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আসলে শিশু অধিকার হচ্ছে মানবাধিকারেরই অংশ। শিশুরা হচ্ছে এমন মানুষ যাদের অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই অধিকার রক্ষার ক্ষমতা তার নেই। তাই ইসলাম ধর্মে বারবার শিশু অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শৈশব হচ্ছে মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই অধ্যায়টি যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, ছেলে হোক-মেয়ে হোক সব শিশুর অধিকার সমান। শিশুদের প্রতি অনাচার ও সহিংসতা নিষিদ্ধ।

আল্লাহ্ তায়ালা এমন সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে জগতে পাঠিয়েছেন যখন শিশুরা কঠিন সময় অতিবাহিত করছিল। সমাজে শিশুদের প্রতি সহিংসতা সাধারণ নিয়ম ছিল।

সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আরবদের মাঝে যখন ইসলামের বাণী প্রচার করছিলেন তখন আরবরা জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার মধ্যে ছিল। তারা কন্যাসন্তানকে নিজেদের জন্য লজ্জাজনক ও অপমানকর বলে মনে করতো। এ কারণে আরবরা কন্যাশিশুকে জীবন্ত কবর দিত। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট বুঝা যায়, আরবরা দারিদ্র্যের অজুহাতে ছেলে সন্তানকেও হত্যা করতো।

ইসলামের পূর্বে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই শিশুদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। তাদেরকে ন্যূনতম অধিকারও দেওয়া হতো না। অভাব-অনটনের কথা বলে শিশু হত্যা চলতো। কন্যাশিশুদের হত্যার প্রবণতা ছিল সর্বত্র। পবিত্র কুরআনের সূরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা বলছেন, “তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন মুখ কালো হয়ে যায় এবং রাগে ক্ষুব্ধ হয়। তাকে শোনানো সুসংবাদের দুঃখে সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে; সে চিন্তা করে যে, হীনতা সহ্য করে কি তাকে (শিশুকে) রেখে দেবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে? তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কতই না নিকৃষ্ট।”

তবে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারি করা হয় যে, কোনো অজুহাতেই শিশু হত্যা করা যাবে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বনী ইসরাইলের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মারাত্মক অপরাধ।”

একইভাবে মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, যারা শিশুদের প্রতি দয়াশীল নয় তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here