শেখ সাদীর সুবাসিত ‘বূস্তান’

0
516
আল্লামা শেখ সাদী

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
দিনের বেলা আকাশে দেদীপ্যমান সূর্যকিরণ বিলায়। রাতে চাঁদের জোছনা ঘুমন্ত পৃথিবীর উপর শান্তি সুখের শামিয়ানা টানায়। তার সাথে অগণিত গ্রহতারার মিটিমিটি বাতি যদি না থাকে এই পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যাবে, ভুতুড়ে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হবে। মানবসভ্যতার আকাশে চাঁদসূর্য তারকারাজির আলোর মেলার সাথে তুলনা করা যায় প্রত্যেক জাতির সাহিত্য সম্ভারকে। কারণ, কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও তাঁদের রচনা ও সাহিত্যকর্ম মানব সমাজকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। আকাশের গ্রহ-তারকা হয়ে মানব সভ্যতার সাজানো মঞ্চে আলো বিকিরণ ঘটায়।

বিশ^সভ্যতার আলোকসজ্জা সাহিত্য ভান্ডারের একটি হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে রয়েছে অসংখ্য অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র দুর্লভ প্রতিভা, যাঁরা মানব জাতিকে সত্য, সুন্দর, প্রেম ও মানবীয় গুণাবলিতে সজ্জিত হওয়ার পথ দেখিয়েছেন, এখনো দিকপালের ভূমিকায় বাতিঘর হয়ে রয়েছেন। এসব মনীষীর অমর সাহিত্যকর্ম বিশ^সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদ সম্ভারের একটি হচ্ছে শেখ সাদীর ‘বূস্তান’। ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’ শেখ সাদীর জগদ্বিখ্যাত রচনা। এ দুটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় রচিত। ‘গুলিস্তান’ গদ্য সাহিত্য, তবে প্রতিটি বাক্যে রয়েছে ভাষার ঝংকার, ছন্দের সমাহার আর মাঝে মাঝে কবিতার পুষ্পমাল্য সাজানো। আর ‘বূস্তান’ একেবারে পদ্য রচনা।

‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তানকে’ আমরা ফারসির জগতে আঁধার রাতের প্রদীপের সাথে তুলনা করতে পারি। গ্রামীণ জীবনে সন্ধ্যালগ্নে যখন ঘরের বাইরে চেরাগ জ¦ালানো হয়, চারিদিক থেকে প্রেমাসক্ত কীটপতঙ্গ উড়ে উড়ে জড়ো হয়। তারা ঘুরতে থাকে। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। প্রদীপের আলোতে আত্মাহুতি দিয়ে প্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখায়। প্রাণটা বিসর্জন দিতে মুখে ‘উহ’ শব্দটিও আনে না প্রেমের অনুরাগে। বস্তুত শেখ সাদী ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’ রচনার পর থেকে এই দুটি প্রদীপের উপর সাহিত্যের কত প্রেমাসক্ত আত্মহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যান কারো জানা নেই।

শেখ সাদীর পুরো নাম ফারসি উইকিপিডিয়ার মতে আবু মুহাম্মদ মুশাররফ উদ্দীন মুসলেহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুশাররাফ সাদী (৬০৬-৬০ হিজরি)। খ্রিস্টিয় পঞ্জিকার হিসেবে জন্ম ১২১০ খ্রিষ্টাব্দ আর মৃত্যু ১২৯১ বা ১২৯২ সাল। শেখ সাদী নামটি আমাদের মাঝে এতো পরিচিত স্মরণীয়-বরণীয় হলেও তিনি কিন্তু আমাদের দেশের বা বাংলা ভাষার কবি নন। দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন আজ থেকে সাড়ে সাতশ’ বছর আগে প্রাচীন পারস্যের রাজধানী শিরাজে। তিনি কবি-সাহিত্যিকদের স্বপ্নের দেশ ইরানের কবি। সাহিত্যচর্চা করেছেন ফারসি ভাষায়। মাঝে মধ্যে আরবি রচনাও স্থান কাল অতিক্রম করে চিরন্তনতা পেয়েছে তাঁর রচনায়। আমাদের দেশে মসজিদে মাহফিলে একটি না’তে রাসুল (সা.) পাঠ করা হয় পরম ভক্তিতে পবিত্র চেতনায়। নবি করিম (সা.)-এর প্রতি উম্মতের ভালোবাসা ও আবেগের সবটুকু উজাড় করা হয় মাত্র চার লাইনের এই কবিতায়। বালাগাল উলা-এর সাথে আমাদের দেশের ছোটো বড়ো প্রায় সবাই পরিচিত। দুনিয়ার তাবৎ রাসুল প্রেমিকের জপমালা ‘বালাগাল উলা’র চতুষ্পদি কবিতাটি রয়েছে শেখ সাদীর ‘গুলিস্তান’-এর ভূমিকায়। এ নিয়ে আমার একটি আলাদা পুস্তিকা আছে, তাতে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ‘বালাগাল উলা’র যে অসাধারণ অনুবাদ করেছেন তার উপর বিশদ আলোচনা করেছি। ‘গুলিস্তান’ ফারসি ভাষায় রচিত হলেও ‘বালাগাল উলা’ রচিত হয়েছে আরবিতে। তাতে প্রমাণিত হয় ‘গুলিস্তান’ বা শেখ সাদীর রচনার ভাবে ও ভাষায় রয়েছে আরবির মিশেল।
জানার বিষয় হলো, শেখ সাদী তাঁর ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’-এ মানব সভ্যতার জন্য এমন কী উপঢৌকন রেখে গেছেন, যার আবেদন এখনো কালজয়ী। গবেষকরা একমত, মানবতা, মানব প্রেম, মনুষ্যত্বের অলঙ্কার সুন্দর চরিত্র, জীবনাচার আর সদুপদেশের শৈল্পিক উপস্থাপনায় এই দুটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় তো বটেই, বিশ^সাহিত্যে নজিরবিহীন। গুলিস্তানে গুল মানে ফুল স্তান অর্থ অনেকটা বাংলায় স্থানের মতো। মানে যেখানে ফুল পাওয়া যায়। ফুলের কানন।

শেখ সাদীর ‘গুলিস্তান’ ইরানের প্রাচীন রাজধানী শিরাজে অবস্থিত। ফুল দূর থেকে দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভুলায়। কাছে এলে খুশবুতে আমোদিত করে। বূস্তানের বূ মানে খূশবু। তার মানে বূস্তানের কাছে এলে তার সুবাসের মোহ মায়ায় সমঝদার লোকেরা আত্মহারা হয়ে যায়। ইরানি গবেষকরা বলেন, বূস্তান আরবি বোস্তান হতে ফারসিতে রূপান্তরিত। মানে বাগান। বূস্তানের সঠিক পরিচয়ের জন্য আমরা এর রচনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনতে পারি। শেখ সাদী নিজেই এই প্রেক্ষাপট ব্যক্ত করেছেন কবিতায় বূস্তানের ভূমিকায়। কবিতায় তাঁর ভাষার লালিত্য ও মমতা কিছুতেই ভাষান্তর করা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা শেখ সাদীর মনের কথাটি বুঝবার চেষ্ট করব।

দার আকসা’য়ে আ’লাম বেগাশতাম বাসী
বসর বোর্দাম আইয়া’ম বা’ হারকেসী
বিশে^র আনাচ কানাচে আমি অনেক ঘুরেছি
দিনকাল কাটিয়েছি সবার সাথে মিলেমিশি।
তামাত্তু বে হার গূশেয়ী য়া’ফতাম
যে হার খেরমানী খোশেয়ী য়া’ফতাম
যেখানে গিয়েছি পেয়েছি জীবনের পাথেয়
প্রতিটি ফলফুলের এক গুচ্ছ করেছি সংগ্রহ।
চো পা’কা’নে শীরা’যে খা’কী নেহা’দ
নাদীদাম কে রাহমত বার ইন খা’ক বা’দ
শিরাজের পবিত্র মনের মাটির মানুষ কোথাও
দেখিনি, এই মাটির উপর হোক রহমত অবারিত!
তাওয়াল্লায়ে মারদা’নে ইন পা’ক বূম
বার আঙ্গীখতাম খা’তের আয শা’ম ও রূম
এই পবিত্র ভূমির মানুষদের ভালোবাসার টানে
মনের আকর্ষণ ছিন্ন করেছি রোম, সিরিয়ার সাথে।
দারীগ আ’মাদাম যে আনহামে বূস্তা’ন
তুহী দাস্ত রাফতান সূয়ে দুসতা’ন
খারাপ লাগছিল কীভাবে এসব বূস্তান ছেড়ে
খালি হাতে ফিরে যাই প্রিয়জনদের মাঝে।
শেখ সাদী বলছেন, দুনিয়ার আনাচে কানাচে আমি অনেক ঘুরেছি। পরিস্থিতির চড়াই-উতরাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়েছি। নানা জনের সাথে মিশেছি। যেখানে যা পেয়েছি জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করেছি। বাস্তবতা হলো, শিরাজের বাসিন্দাদের মতো পবিত্র মনের মাটির মানুষ দুনিয়ার কোথাও আমি দেখিনি। শিরাজ ভূমির উপর আল্লাহ্র রহমত অবারিত হোক! স্বদেশ প্রেম, স্বদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার উজ্জ্বল নমুনা সাদীর এই অভিব্যক্তি। তিনি আরো বলেন, পবিত্র ভূমি শিরাজের জনগণের ভালোবাসার টানে যখন রোম-সিরিয়ার মায়ার বাঁধন ছেড়ে স্বদেশে ফিরে আসার মনস্থ করলাম, তখন মনটা ভারী হলো এই ভেবে যে, কীভাবে সুন্দর সুবাসিত এসব বূস্তানের প্রবাস জীবন থেকে খালি হাতে স্বদেশবাসীর মাঝে ফিরে যাব। বস্তুত প্রবাস জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয়ের সওগাত হলো এই বূস্তান, খুশবুতে আমোদিত ফুলবন। শেখ সাদী অন্যত্র বলেন,
গোল আ’ওয়ার্দে সাদী সূয়ে বূস্তা’ন
বেশওখী ও ফেলফেল বে হিন্দুস্তা’ন
সাদী ফুলের ডালি নিয়ে এসেছে বূস্তানের পানে
এ যেন মরিচের সওগাত নিয়ে যাওয়া হিন্দুস্তানে।
হিন্দুস্তান মরিচের জন্য বিখ্যাত। কেউ যদি একহালি মরিচ উপহার নিয়ে হিন্দুস্তানে যায় বড় বেমানান হবে। শিরাজও হচ্ছে ফুলের কানন। কাজেই ফুল উপহার নিয়ে ফুলের বনে বেড়াতে যাওয়াও বড্ড বেমানান। আমার জন্যও শিরাজের ফুলের জলসায় ফুলের নজরানা নিয়ে হাজির হওয়া নিশ্চয়ই বেমানান। এখানেও শিরাজের প্রতি মহাকবি শেখ সাদীর বিনম্র বিনয়ের নিবেদন সত্যিই অভিনব।

দীর্ঘ সফর জীবনের তিতা-মিঠা হরেক রকম অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ‘বূস্তান’। কবিতার এই ফুলের ডালি তিনি উপহার দিয়েছেন প্রথমে স্বদেশবাসীর করকমলে। তারপর মানব সভ্যতার বিশাল জলসায়। সেই উপহার বিশ^সমাজ প্রাণ ভরে নিয়েছে। তাই সাড়ে সাতশ’ বছর পরও ভিন দেশের মানুষের কাছেও ‘গুলিস্তান’, ‘বূস্তান’ এর এতো কদর। আর শেখ সাদীর নাম শুনলে সবাই ভাবে একান্ত কাছের প্রাণের প্রিয়জন। সম্পূর্ণ কবিতায় লেখা ‘বূস্তান’-এ দ্বিপদী শ্লোকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ‘বূস্তান’-এর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যমণি মানুষ। মানব জীবনকে সাজানোর নীতিমালা, সুন্দর সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ পরিচালনার রূপরেখা, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, জুলুমের অবসান ও সুন্দরের পরিচর্যা, রাষ্ট্রপরিচালনার ঐতিহ্যনির্ভর নির্দেশনা আর প্রেমপ্রীতির বন্ধনে পরিবার ও গোটা মানব সমাজকে আত্মীয়তার চেতনায় উজ্জীবিত করার উপদেশমালার বিশাল সম্ভার ‘বূস্তান’। বর্ণনার প্রতিটি স্তরে রয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফুরণ, মিথ্যা ভন্ডামি ও প্রতারণার অবলোপন আর চারিত্রিক অসঙ্গতি দূর করার তীব্র তাগাদা।

‘বূস্তান’-এর রচনাকাল ৬৫৫ হিজরি। তখন শিরাজের শাসনক্ষমতায় ছিলেন আতাবক বংশের রাজা আবু বকর ইবনে সাদ। শেখ সাদী ন্যায়পরায়ন শাসক ইবনে সাদ এর নামানুসারে নিজের কবিনাম গ্রহণ করেন সাদী আর অমূল্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন আবু বকর ইবনে সাদ এর নামে। এই উৎসর্গ ইবনে সাদ এর হাত হয়ে এখন গোটা মানব সভ্যতার জন্য সওগাত। গবেষকরা বলেছেন, মানব সমাজে সর্বস্তরের মানুষের সামনে পেশ করার উপযোগী একক পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম ‘বূস্তান’। এর মতো কোনো পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম জগতের কোনো কবি-সাহিত্যিক বা মনিষী রচনা করতে পারেন নি। এই দাবিটি করেছেন ‘বূস্তান’-এর টীকাকার ইরানের সর্বমহলে সমাদৃত সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ খাযআলী।
শেখ সা‘দী, বুস্তান, জাভিদান প্রকাশনা সংস্থা, তেহরান, ১৩৬৬ (১৯৮৭ ইংরেজি) থেকে সংকলিত।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here