দেওয়ানবাগ ডেস্ক: গত চার মাস স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি সময় পার করছেন দেশের অগ্রগণ্য চিন্তাবিদ, বরেণ্য লেখক, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। করোনাকালীন সময়টাকে তিনি বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘সময়টাতে তো অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। সেখানে সবচেয়ে বড় অসুবিধাটা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। অন্যদের থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। তারপরও আমার সময়টা কাটছে, মানে সময়টাকে যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছি।’
৮৫ বছর বয়সী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস অধ্যাপক নিয়ম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস করতেন, ক্লাসও নিতেন। বের করতেন সমাজ চিন্তামূলক পত্রিকা। অংশ নিতেন সভা-সেমিনার, সামাজিক কর্মকাণ্ডে। কিন্তু এখন ঘরেই কাটছে তাঁর সময়। কিন্তু কিভাবে কাটছে এই সময়? কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার একটি চিত্র। ‘তিনটি কাজ সাধারণত করি। একটা হচ্ছে পড়া। দ্বিতীয়টা হচ্ছে লেখা। আর তৃতীয়টা হচ্ছে সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা। পড়াটা সম্ভব হচ্ছে। লিখতেও পারছি। কিন্তু পড়া ও লেখার জন্য অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ দরকার। অভ্যাস ছিল ছুটির দিন বাদ দিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয় অফিসে প্রতিদিন যাওয়া। লেখক-গবেষকদের সঙ্গে দেখা হতো। শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় হতো। পারস্পরিক বুদ্ধিবৃত্তিক আদান-প্রদান হতো। এতে পড়া ও লেখা, দুটিই উপকৃত হতো। এখন তো এটা হচ্ছে না। সাংস্কৃতিক কাজ তো করতেই পারছি না। একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম, দেশে যে পাঠাগার আছে, সেগুলোকে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রূপান্তর করা। শুরুও করেছিলাম। কাজটা ব্যাহত হলো। চার মাস ধরে ঘরের মধ্যে আছি। বের হতে পারছি না। ওই যে মেলামেশা, যোগাযোগ, আদান-প্রদান, এগুলো ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।’
একটু দম নিয়ে ফের যোগ করেন, ‘পড়াশোনা ও লেখার মাধ্যমেই সময়টাকে পার করছি। কোনো ক্লান্তি আসছে না। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাটার যে একটা প্রভাব, সেটা পড়ছে। কাজগুলো আমি সামাজিকভাবে করতে পারছি না। আমার ধারণা, পড়া ও লেখা সামাজিকভাবেই করতে হয়। যদিও কাজটি ব্যক্তিই করেন। কিন্তু অনেকের সঙ্গে সংলগ্ন হয়েই করতে হয়। এই সংলগ্নতার অভাব ভীষণভাবে অনুভব করছি।’ বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে গবেষণামূলক লেখাটি এগিয়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে ১৯৬৯ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উত্থান তা নিয়ে লিখছেন।
দীর্ঘ এই জীবনে আগে আর কখনো এতটা সময় ঘরবন্দি থাকতে হয়নি তাঁকে। ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়ও নানা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। নানা জায়গায় পালিয়ে থাকতে হয়েছে। সন্ত্রস্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু বন্দি অবস্থায়, এইভাবে একটানা বন্দি কখনো থাকা হয়নি। আগে কখনো অসুখ হলে হয়তো দু-তিন দিন কিংবা এক সপ্তাহ ঘরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এ রকম মাসের পর মাস বন্দি থাকা আমাদের কারো অভিজ্ঞতার মধ্যে নেই। এই অভিজ্ঞতাটাই বলে দিচ্ছে, পৃথিবীটা অনেক বদলে গেছে। পৃথিবীতে পুঁজিবাদী যে ব্যবস্থার মধ্যে আমরা আছি, তারই চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেল। এখানে মানুষকে বন্দি করে রাখছে এবং স্বেচ্ছাবন্দি হয়েই থাকতে হচ্ছে। এই বন্দিদের পুলিশ পাহারা দিচ্ছে না, আত্মীয়-স্বজনই দিচ্ছে।’
সময়টাকে কিভাবে দেখছেন, এমন প্রসঙ্গ তুললে কথার রেশ আরেকটু প্রলম্বিত করে বলতে শুরু করেন, ‘পৃথিবীজুড়ে যে ঘটনাটা ঘটল, এটা একটা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন মানুষের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যেভাবে পরিবর্তিত করেছিল, এটাও সেভাবে বদলে দেবে। দুটি ঘটনা ঘটবে। একদিকে শ্রেণিবৈষম্য বাড়বে, নারী নির্যাতন বাড়বে, বর্ণবাদ বাড়বে। একটা হতাশার মধ্যে পড়বে মানুষ। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাবে। স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে। অন্যদিকে বোঝা যাবে, এইভাবে পৃথিবী চলবে না। এ রকম একটা মহামারি সব কিছুকে তছনছ করে দিল। সামনের দিনের পথটুকু কী হবে, এসব বিষয় নিয়েও ভাবছি। ভাবছি লেখার মধ্যে কিভাবে আনা যায়।’
করোনা পরিস্থিতি বিশ্বে কী কী পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, সেদিকে কথা ঘোরালে তিনি বলেন, ‘পরিবর্তন আনবে দুই দিক থেকে। পৃথিবীতে অভাব বাড়বে, দরিদ্র বাড়বে। দরিদ্র দেশগুলো আরো দরিদ্র হবে। ধনী আরো ধনী হবে। লাখ লাখ লোক কর্মহীন হবে। কর্মের সংস্থান হবে না। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিক্ষোভ বাড়বে। সেই দুঃখ ও ক্ষোভ যদি প্রকাশ করতে না পারে তাহলে একটা অরাজকতা দেখা দেবে। আরেকটি দিক হলো, এই ব্যবস্থাকে বদল করার জন্য যে উপলব্ধি, সেটা আরো গভীর হবে, আরো বিস্তৃত হবে। এই যে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বাণিজ্যিকীকরণ, এটা যে কত ভয়ংকর, সেটা তো বোঝা গেল। হাসপাতালে মানুষ যেতে পারছে না। যেতে পারলেও চিকিৎসা পাচ্ছে না। কেবল করোনা নয়, কোনো চিকিৎসাই মানুষ পাচ্ছে না। এমনকি চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে পারছেন না। এতে বোঝা গেল, এই যে ব্যক্তিমালিকানার পৃথিবী, এটা বদলাতে হবে। সামাজিক মালিকানার জায়গায় যেতে হবে। মালিকানার সামাজিকীকরণের আন্দোলন তীব্র হবে। ওইটার ওপরই নির্ভর করবে পৃথিবী অরাজকতার মধ্যেই নিমজ্জিত হবে, নাকি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।’