সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি সংস্কার

3
348

পবিত্র রমজান মাসের রোজা পালন করা মুসলমানদের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত। অথচ ইবাদতের সঠিক সময় নির্ধারণ করা নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্তি বিরাজমান ছিল। হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান: দ্বীন জয়ী থাকবে ততদিন, যতদিন মানুষ (সূর্যাস্তের পর) শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করবে, কেননা ইহুদি-নাছারাগণ বিলম্বে ইফতার করে। (আবু দাউদ শরীফ)

হযরত রাসুল (সা.) ফরমান: মানুষ কল্যাণের সাথে থাকবে ততকাল, যতকাল তারা শীঘ্র ইফতার করবে (বোখারী শরীফ)। তিনি আরো ফরমান- আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, আমার বান্দাদের মধ্যে আমার নিকট অধিকতর প্রিয় তারাই, যারা শীঘ্র শীঘ্র ইফতার করে। (তিরমিজি শরীফ)

সূর্যাস্তের পর পরই ইফতার করার জন্যে হযরত রাসুল (সা.) মুসলমানদেরকে তাগিদ দিয়েছেন, যার স্বপক্ষে আরো হাদিস রয়েছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের সমাজে সূর্যাস্তের ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত বিলম্ব করে ইফতার করার রেওয়াজ চালু ছিল। আমি দেখলাম যে, ইফতারের ক্ষেত্রে এরূপ অহেতুক বিলম্ব আমাদের রোজা পালনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; আমরা হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অমান্য করে ইহুদি-নাসারাদের পর্যায়ভুক্ত হচ্ছি। কিন্তু বর্তমান এ বিজ্ঞানের যুগে ঘড়ির সাহায্যে সূর্যাস্তের নিরূপিত সঠিক সময় অনুসারে ইফতার করা সম্ভব এবং এ ক্ষেত্রে সতর্কতার জন্যে বিলম্বের কোনই প্রয়োজন নেই। এজন্যে আমি বিলম্বে ইফতার করার প্রচলিত নিয়ম পরিত্যাগ করে বিজ্ঞানভিত্তিক সময় অনুসারে সঠিকভাবে সাহরি-ইফতার ও নামাজের সময়সূচি প্রণয়নে উদ্যোগী হই। প্রচলিত পদ্ধতির ভুল সংশোধনকল্পে আমার প্রস্তাবিত সাহরি-ইফতারের সময়সূচি সরকারীভাবে গৃহীত হয় এবং এদেশে ইফতার ও নামাজের বিজ্ঞানভিত্তিক সময়সূচি প্রবর্তিত হয়।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : তিনি তোমাদের ধর্মে তোমাদের জন্য কঠিন কোন বিধান দেননি। (সূরা আল হাজ্ব : আয়াত ৭৮)

সুতরাং মহান আল্লাহ্ ধর্মীয় বিধিবিধান অযথা কঠিন না করার নির্দেশ দিয়েছেন যেন ধর্ম পালন মানুষের জন্যে অযথা কষ্টদায়ক না হয়। রমজানের রোজা পালনের বিধান হচ্ছে, সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারসহ যাবতীয় পাপাচার থেকে বিরত থাকা। অথচ প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আমরা সূর্যোদয়ের দেড়-দুই ঘন্টা পূর্ব হতেই পানাহার পরিত্যাগ করার নিয়ম অনুসরণ করতাম, যার ফলে রোজা পালনের সময়কাল অযথা বৃদ্ধি পেত। এতে অনেকের জন্যে রোজা পালন করা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতো। এমনকি এ কারণে কেউ কেউ রোজা পালনে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। এভাবে রোজা পালনকে কষ্টসাধ্য করায় কোনো সুফল নেই। সাহরির শেষ সময় নির্ধারণ করে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে : পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির অন্ধকার (কালো রেখা) থেকে প্রভাতের সাদা আলো (শুভ্র রেখা) প্রকাশিত না হয়। (সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ১৮৭)

এ প্রসঙ্গে হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান : বিল্লালের আজান এবং (সুবহে কাজিবের) শুভ্র রেখা যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্তিতে না ফেলে। (পানাহার কর) যতক্ষণ পর্যন্ত সুবহে সাদিক সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত না হয়। (আবু দাউদ শরীফ, ২৪১৪)

অন্য এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেন : তোমরা খাও এবং পান কর, আর তোমাদেরকে সুবেহ্ কাজিবের উচ্চ লম্বা রেখা (যা পূর্ব হতে পশ্চিমে দৃশ্যমান) যেন সাহরি খাওয়া থেকে বিরত না রাখে। আর তোমরা ততক্ষণ পানাহার কর, যতক্ষণ না সুবেহ্ সাদিকের লম্বা লাল আলোকরশ্মি (যা পূর্বাকাশে উত্তর-দক্ষিণে দৃশ্যমান) প্রকাশ পায় (আবু দাউদ শরীফ ২৩৪০)।

১৯৯৩ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চে উদযাপিত পবিত্র রমজানের রোজার সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি পবিত্র কুরআন ও হাদিসসম্মতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করে জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলোতে সম্প্রচার করার জন্যে আমি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেই। কেননা দেশের বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে সময়ের হিসাব করার ফলে কেউ কেউ সূর্যাস্তের ৫ থেকে ১০ মিনিট এমনকি ১২ মিনিট পরও ইফতারের সময় নির্ধারণ করে থাকেন। ফলে তা অনুসরণ করে রোজাদারগণ সঠিকভাবে রোজা পালনে ব্যর্থ হন। যেমন, ১৯৯৩ সালে সূফী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে সরবরাহকৃত সূর্যাস্তের নির্ঘন্টের সাথে সঙ্গতি রেখে ইফতারের সময়সূচি প্রকাশ করে।

অন্যদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সনাতন রীতিতে প্রণীত ইফতারের সময়সূচিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া সূর্যাস্তের সময় থেকে সর্বোচ্চ ৯ মিনিট পর্যন্ত ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। ফলে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফ থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয় এবং জাতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহে ব্যাপক লেখালেখি হয়। অবশেষে বিষয়টি একজন সংসদ সদস্যের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, স্পীকার মহোদয় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীকে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা প্রদানের আহ্বান জানান। যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী এ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক নামাজের সময়সূচী প্রণয়নের জন্য ১১ সদস্যবিশিষ্ট ‘সাহরি-ইফতার ও নামাজের স্থায়ী সময়সূচি নির্ধারণ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করেন। উক্ত কমিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সময়ের ব্যবধানের প্রতি লক্ষ্য রেখে ৬৪টি জেলাভিত্তিক সময়সূচি নির্ধারণ করে।

১৯৯৩ সালের ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ধর্মমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তা গৃহীত হয়। বৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রণীত এ সময়সূচিতে আবহাওয়া দপ্তরের নির্ধারিত সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সাহরি ও ইফতারের সময় নির্ধারণ করা হয়।

মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জতের অপার দয়ায় এভাবেই আমার প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯৯৩ সাল হতে বাংলাদেশে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিজ্ঞান ভিত্তিক সাহরি ও ইফতারের সময়সূচি প্রবর্তিত হয়েছে।

সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার প্রথম খণ্ড থেকে সংকলিত

3 COMMENTS

  1. আলহামদুলিল্লাহ্, মারহাবা ইয়া যুগের ইমাম বাবা দেওয়ানবাগী মারহাবা…

  2. আলহামদুলিল্লাহ, সূফী সম্রাট হযরত শাহ্‌ দেওয়ানবাগী (মাঃ আঃ) হুজুর কেবলাজানের এ অনন্য সংস্কারের কারণে আমরা সঠিক পদ্ধতিতে সিয়াম সাধনা করার সুযোগ পেয়েছি, আমিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here