স্থাপত্যের কালোত্তীর্ণ সম্রাজ্ঞী জাহা হাদিদ

0
184

নারী ডেস্ক: স্থপতি, ফ্যাশন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, চিত্রশিল্পী- অনেকগুলো চরিত্রের অধিকারিণী এক কিংবদন্তি। সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিকে যিনি নিয়ে গেছেন চরম সীমায়, বারবার। জীবনে পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা। কখনো পুরুষ সংখ্যা গরিষ্ঠতায় বা বিদেশি হিসেবে। কখনো বা একজন ডিজাইনার হিসেবে যার কাজগুলো ছিল খরুচে। হার মানিয়েছেন লিঙ্গবৈষম্যকে, ঠিক যেভাবে অভিকর্ষ হার মেনেছে তার স্থাপনাগুলোর কাছে। স্থাপত্যকে অবলোকন করার দৃষ্টিভঙ্গিকেই পাল্টে দেন তিনি। জাহা হাদিদ তার নাম।

তার বিল্ডিংগুলো সবসময় এমন যাতে হারাম হয়ে যেত প্রকৌশলীদের ঘুম। নির্মাণ প্রযুক্তিকে শেষ সীমায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি। জাহা তার কাজগুলোকে নিয়ে বলতেন, “আমি অভিকর্ষকে স্রেফ ভুলে যেতে চাই, ভাসতে দিতে চাই একে।”

রাজনীতিবীদ বাবার ঘরে জন্ম হাদিদের। দেখেছেন সেই এক বাগদাদকে যা এখনকার সময়ে কল্পনাতীত। বেড়ে উঠেছিলেন এমন এক সমাজে যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ছিল স্বাধীন, মুক্ত। পেয়েছেন এমন এক বাগদাদ যেটি একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল লে কোবুজিয়ের মতো আধুনিক স্থপতিদের হাত ধরে। ১৯৫০ সালের ৩১ অক্টোবর ইরাকের বাগদাদে তার জন্ম। বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতার দরুন তিনি শৈশবে ঘুরে বেড়িয়েছেন অনেক দেশ। পাশাপাশি পেয়েছিলেন একজন শিল্পীমনা মা, সবমিলিয়ে যা তাকে পুরোদমে একজন স্থপতি হতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল বেশ। ছোটবেলায় মায়ের কাছে হাতেখড়ি ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের। নিজের মতো করে সাজাতেন তার ঘর। তার বয়সী যেকোনো মেয়ের চেয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকতেন তিনি।

পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান লেবাননে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত থেকে গণিত বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৭২ সালে যান ব্রিটেনে। বিখ্যাত ‘আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার’ এ শুরু করেন স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা। পরে কিছু সময় শিক্ষকতায়ও নিয়োজিত ছিলেন সেখানে। বিশ্বের অনেক বড় বড় আর্কিটেকচার স্কুলে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল তার।

রাশিয়ান সুপারম্যাটিস্টিক চিত্রশিল্পী কাজিমির মালেভিচের চিত্র তিনি শুধু দেখেনইনি। একে পুরোপুরি আত্মস্থ করেছিলেন নিজের মাঝে। তার কাজে যার প্রভাব ছিল বেশ। পাশাপাশি গাণিতিক জ্ঞান আর আরবি ক্যালিগ্রাফির ছায়াও ছিল তার উপর। কারো কাছে তিনি নিও-ফিউচারিস্টিক, ডিকনস্ট্রাকশনিস্টিক। তার নামের সাথে চলে আসে নতুন নতুন রীতি, যেমন- স্টার্কিটেক্ট। জাহার কাজগুলো সবসময়ই হতো অদ্বিতীয়। তার আঁকা চিত্র, বিভিন্ন প্রজেক্টের ধারণাগুলো আসলে একেকটা শিল্পের কাতারেই পড়ে।

চরম ঐতিহ্যবাদী লন্ডনে ১৯৮০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা করেন তার আর্কিটেকচারাল ফার্ম ‘জাহা হাদিদ আর্কিটেক্ট’। সমসাময়িক পোস্ট মডার্নিজমের সময়ে এমন কিছু অভাবনীয় কাজের কল্পনা করেন যা সাধারণ মানুষ তো বটেই, নির্মাতাদের চোখেও ছিল প্রায় অসম্ভব। দিনশেষে এটিই তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেয়।

স্পেসকে হাতের মুঠোয় আনার জন্য জ্যামিতিক রূপের বহুমাত্রিক পথ উদ্ভাবন করেছেন তিনি। জাহার কাজের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তার নকশার ‘নির্মাণ-অযোগ্য’ ট্যাগকে অতিক্রম করতে পারাটা। প্যারামেট্রিসিজম ছিল তার একটি সিগনেচার স্টাইল, যা দিয়ে তিনি আধুনিককালে স্থাপত্যকে দেন নতুন রূপ। তার নির্মাণকাজ প্রচলিত নির্মাণপন্থাকে রীতিমতো অস্বীকার করে।

এতকিছুর পরেও তার ক্যারিয়ারের শুরুটা ছিল বেশ কঠিন। জীবনের বড় একটি ধাক্কা খান ওয়েলসের রাজধানীতে নির্মিতব্য কার্ডিফ বে অপেরা হাউজের নকশাকে ঘিরে। একাধিকবার সেই নকশা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলেও কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই তার নকশাতে এটি নির্মাণ করতে আগ্রহী হয়নি। তাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি অসম্ভব কাজ। কার্ডিফের ঘটনার পরে তার প্রতিষ্ঠানকে পার করতে হয় খুবই কঠিন সময়। তারা প্রায় প্রতিটি নকশা প্রতিযোগিতায় হারতে থাকেন। কারণ তার করা নকশাগুলো দেখতে মনে হতো স্রেফ একেকটা স্কেচ এবং সেই সময়ে নির্মাণের অযোগ্য। খুবই রেডিক্যাল এবং সেই আমলের জন্য অনাকাক্সিক্ষত। এই ধারা পুরো নব্বইয়ের দশকজুড়ে চলতে থাকে। তাদের হাতে ছিল না কোনো অর্থ। কিন্তু তাদের আশাবাদী মনোভাব ছিল সেই শক্তি, যার কারণে সেই ভয়ানক পরিস্থিতিতে তারা টিকে থাকতে পেরেছিলেন। আর ছিল তার সহকর্মী প্যাট্রিক শুমাখারের সমর্থন ও সহযোগিতা।

স্থাপত্যে নতুন ধারা প্যারামেট্রিসিজমে জাহা এবং তার সহকর্মী প্যাট্রিক ছিলেন অগ্রদূত। এটি তাত্ত্বিকভাবে আপনার কম্পিউটারকে বিভিন্ন গাণিতিক প্যারামিটারের মাধ্যমে নতুন নতুন আইডিয়া ও ডিজাইন উদ্ভাবনে সক্ষম করে। এমন কিছু ডিজাইন যা আপনার মনে সম্ভবত আসত না। এলিমেন্টের কোনো পুনরাবৃত্তি থাকে না এতে। বরং প্রতিটি মূহুর্তে আপনাকে বিভিন্ন অভাবনীয় ত্রিমাত্রিক নকশা উপহার দেবে। এতে পুরো নির্মাণ আলাদা আলাদা অংশে ভাগ হয়ে না থেকে তার পরিবর্তে পুরো নকশা মিলে রূপ নেয় একটি স্বতন্ত্র গড়নের।

তবে এটা পড়ে পাঠক ভুল বুঝবেন না। এটি কেবল তার কাজের একটি অংশই ছিল। কিন্তু তার নকশার পুরোটা জুড়ে থাকে তার কল্পনা, প্রকৃতিতে মিশে থাকা বিথীকে মানুষের তৈরি দুনিয়ায় নিয়ে আসার অনন্য প্রয়াস।

তাকে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয় ১৯৯৪ সালে জার্মানিতে করা ভিট্রা ফায়ার স্টেশনের কাজ। এটি ডিকনস্ট্রাকশনিজমের একটি অন্যতম উদাহরণ। জাহার কাজে কখনো ৯০ ডিগ্রী বলে কোনো জিনিস ছিল না। বাঁকানো দেয়াল, বিভিন্নভাবে ইন্টারসেক্ট করা দেয়াল, লাইনের কম্পোজিশনে সাজানো থাকে তার কাজগুলো। এরপরে করেন জার্মানির লাইপজিগের বিএমডাব্লিউ সেন্ট্রাল বিল্ডিং। ২০০৫ সালে সমাপ্ত হয় উলফসবার্গের ফ্যানো সায়েন্স সেন্টারের কাজ, যার জন্য ২০০৬ সালে তিনি লাভ করেন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস ইউরোপিয়ান অ্যাওয়ার্ড। একই বছর পান ইনস্টিটিউট অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাওয়ার্ড।

এরপরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০০৮ সালে করা লন্ডনের এভেলিন গ্রেস অ্যাকাডেমি ভবনের কাজ তাকে প্রায় ১৭০ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে বিখ্যাত স্টার্লিং প্রাইজ এনে দেয়। প্রথম নারী হিসেবে পান আরআইবিএ গোল্ড মেডেল। পান ফরাসি সরকারের পুরস্কার। জাপান থেকে পান প্রিমিয়াম ইমপেরিয়াল পদক। তিনি প্রথম মুসলিম ও একমাত্র নারী হিসেবে ২০০৪ বিশ্বখ্যাত প্রিৎজকার পুরষ্কার লাভ করেন, যাকে স্থাপত্যের নোবেল বলা হয়। ততদিনে তার মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি কাজই শেষ হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকেই তিনি একের পর এক সব উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টের কাজ পেতে শুরু করেন। তার উল্লেখযোগ্য আরো কিছু কাজের মধ্যে ছিল ইতালির রোমে অবস্থিত ‘ম্যাক্সি’, যা একবিংশ শতাব্দীর জাতীয় আর্ট মিউজিয়াম। রোমের মতো ক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের শহরে এটি এমন একটি স্থাপনা যাতে আছে গতিময়তা, স্পেসের ধারাবাহিকতা, কনক্রিটের বাঁকানো দেয়াল, শূন্যে ঝুলে থাকা সিঁড়ি, ছাদস্পর্শী প্রাকৃতিক আলোর সমাবেশ, যা একে করেছে অতুলনীয়।

ব্রিটেনের বিখ্যাত ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা তাকে আখ্যায়িত করেছিল ‘দ্য কুইন অফ কার্ভ’ উপাধিতে। পেয়েছেন ব্রিটিশ রাজের নাইটহুড সমতুল্য ডেম উপাধি। ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে মহাপ্রয়াণ হয় এই মহান নারী স্থপতির।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here