নারী ও শিশু ডেস্ক: জান্নাতে নারীকুলের শিরোমণি ও হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (রা.) ত্রিশ বছরেরও কম সময় পৃথিবীতে দৈহিকভাবে বেঁচে ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত হায়াতে জিন্দেগীতে তাকওয়া ও খোদাভীরুতার দিক দিয়ে তিনি নিজেকে এতটা উন্নত অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, কেয়ামত পর্যন্ত তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন।
হযরত মা ফাতিমা (রা.) সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত রাসুল (সা.)-এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে তাঁরই ঘরে লালিত- পালিত হয়েছেন। বিশ্বনবির পাশাপাশি তিনি মা হিসেবে পেয়েছিলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর মহীয়সী স্ত্রী ও চরম দুর্দিনের সঙ্গী বিবি খাদিজা (রা.)-কে। হযরত জাহরা’র উন্নত চরিত্র গঠনে বিবি খাদিজা (রা.)-এর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। হযরত খাদিজা (রা.) কুরাইশ বংশের একটি অতি সম্মানিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশ পরম্পরায় তাঁর পরিবারও ছিল একত্ববাদে বিশ্বাসী। ইসলাম আবির্ভাবের আগে যারা হাজরে আসওয়াদকে মসজিদুল হারাম থেকে ইয়েমেনে স্থানান্তরের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, বিবি খাদিজার পিতা ছিলেন তাদের অন্যতম। এছাড়া বিবি খাদিজার পিতৃব্য আসাদ ছিলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ চুক্তির অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। মক্কার নির্যাতিত ও অসহায় মানুষদেরকে জালেমদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছিল। বিশ্বনবি (সা.)-ও কিশোর বয়সে এই চুক্তিতে শামিল হয়েছিলেন।
এ ছাড়া বিবি খাদিজার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ছিলেন একজন ইনজিল কিতাবে জ্ঞানী ও আধ্যাত্মিক সাধক। হেরা পর্বতের গুহায় যেদিন আল্লাহর রাসূল (সা.) নবুয়ত প্রাপ্ত হন, সেদিন তিনি এই ঘটনা ওয়ারাকা ইবনে নওফেলকে খুলে বলেন। সবকিছু শোনার পর নওফেল বলেছিলেন, “খোদার কসম, আপনি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন। আপনি জেনে রাখুন মক্কার কাফের ও মুশরিকরা আপনার দাওয়াতের বাণী মেনে নেবে না এবং আপনার ওপর অত্যাচার চালাবে। ওরা আপনাকে আপনার মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করবে এবং আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমি যদি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তাহলে আল্লাহ্র ধর্ম রক্ষায় আপনাকে সহযোগিতা করব।” এরপর ওয়ারাকা ইবনে নওফেল বিশ্বনবি (সা.)-এর কপালে চুমু খেয়ে নিজের গন্তব্যে চলে যান।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বনবি (সা.) এমন একজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন যিনি একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যারা আগে থেকেই ছিলেন ঐশী মূল্যবোধ ও উন্নত নৈতিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ। মহান আল্লাহ্র কাছে বিবি খাদিজার মর্যাদা এতটা উঁচু ছিল যে, হাদিসে এসেছে, রুহুল কুদুস যতবারই দয়াল রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, ততবারই হযরত খাদিজা (রা.)-কে সালাম পৌঁছে দিয়েছেন।
একদিন রাব্বুল আলামিন বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-কে নির্দেশ দিলেন ৪০ দিন বিবি খাদিজার কাছ থেকে দূরে থেকে শুধু আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল হতে। হযরত রাসুল (সা.) আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করেন। ৪০ দিন পর আল্লাহ্ তায়ালা দয়াল রাসুলের জন্য জান্নাতি খাবার পাঠান। এরপর আল্লাহ্ তায়ালা দয়াল রাসুল (সা.)-কে নির্দেশ দেন হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাক্ষাতে যেতে। মহান আল্লাহ্ দয়াল রাসুলকে একজন পবিত্র সন্তান দানের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন।
উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজার গর্ভাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা দয়াল রাসুল (সা.)-কে বলেন, বিবি খাদিজার গর্ভে যে সন্তান আসছে, তার মাধ্যমে আপনার বংশ রক্ষা পাবে। তিনি হবেন এমন ইমামদের মাতা, যারা আপনার কাছে ওহি নাজিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আপনার স্থলাভিষিক্ত হবেন। আল্লাহ্র রাসুল (সা.) এই খুশির খবর হযরত খাদিজা (রা.)-কে খুলে বলেন।
আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে নারীর কোনো মানবীয়, সামাজিক ও আইনগত অধিকার ছিল না। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করাকে একটি পরিবারের জন্য কলঙ্ক মনে করা হতো। কারো পুত্রসন্তান না থাকলে মনে করা হতো তার বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কারণে মক্কার মুশরিকরা ভেবেছিল আল্লাহ্র রাসুলের পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামেরও অপমৃত্যু ঘটবে। কিন্তু তাদের অপমানকর বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ্ তায়ালা সূরা কাউসার নাজিল করে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, কাফেরদের এই দুরাশা কোনোদিনই সফল হবে না। বরং নবিনন্দিনী হযরত ফাতিমা (রা.)-এর মাধ্যমেই রাসুলের বংশ রক্ষা পাবে এবং ইমামত ও বেলায়েতের ধারা জারি থাকার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে।
হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা (রা.)-এর জন্মের দিনগুলোতে ইসলামের দ্রুত প্রসার মক্কার কাফিরদের বিচলিত করে তুলেছিল। তারা নানারকম নির্যাতন, হুমকি ও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেও ইসলামের প্রসার রোধ করতে না পেরে মুসলমানদেরকে ‘শোয়াবে আবু তালিব’ নামক উপত্যকায় অবরুদ্ধ করে রাখে। টানা তিন বছর বিশ্বনবি (সা.) ও তাঁর পরিবারসহ সব মুসলমান ওই উপত্যকায় দুর্বিসহ জীবন কাটাতে বাধ্য হন। সেই কঠিন দিনে হযরত জাহরা (রা.) ছিলেন দুগ্ধপোষ্য শিশু। জীবনের শুরুতেই এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ার মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালাই হয়ত তাঁকে ভবিষ্যতের আরো কঠিন দিন সহ্য করার জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। টানা তিন বছর অবরুদ্ধ করে রাখার পরও মুসলমানদের মনোবলে বিন্দুমাত্র নমনীয়তা আনতে না পেরে কাফেররা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়।
এই ঘটনার কিছুদিন পর হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রিয় সহধর্মিণী বিবি খাদিজা (রা.) রাব্বুল আলামিনের ডাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। হযরত ফাতেমাতুজ জাহরা (রা.) পরিণত হন মাতৃহীন এতিম শিশুতে। এরপর আর কিছুদিন যেতে না যেতে রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত রাসুল (সা.)-এর চাচা হযরত আবু তালিব (রা.) যিনি কাফেরদের চরম বিরোধিতা ও শত্রুতার মাঝে বিশ্বনবিকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন, তিনিও ইন্তেকাল করেন। পরপর ঘনিষ্ঠতম দু’জন দরদি মানুষকে হারিয়ে আল্লাহ্র রাসুল বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এ সময় আবু তালিবের অনুপস্থিতির সুযোগে মক্কার মুশরিকরা নানাভাবে বিশ্বনবি হযরত রাসুল (সা.)-কে কষ্ট দিতে থাকে। এ অবস্থায় আল্লাহ্র নির্দেশে তিনি প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন। এখান থেকেই হযরত ফাতেমাতুজ জাহরা (রা.)-এর জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। (চলবে)