হাকিকতে হজ পালন

0
532

কাবা মুসলমানদের কেবলা হিসেবে পবিত্রতম স্থান এবং এর পুণ্যময় ইতিহাস সুদীর্ঘ, যার বর্ণনা পাওয়া যায় পবিত্র কুরআনে। এরশাদ হয়েছে: “নিশ্চয়ই মানবজাতির উপাসনার জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা মক্কায়; যা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী।” (সূরাম আলে ইমরান ৩ : আয়াত ৯৬)

মক্কার বায়তুল্লাহ্র ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ববর্তী নবিগণ এমনকি আদি মানব ও আদি নবি হযরত আদম (আ.) ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পুণ্যময় স্মৃতি। কাবা সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হলো আল্লাহর প্রেরিত নবি-রাসুলগণের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারী অর্থাৎ মুসলমানদের কেবলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ কাবাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর মুসলমানগণ হজের অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। হজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্য হলো- মহান আল্লাহ্ ও তাঁর হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি গভীর প্রেম ও আনুগত্য সৃষ্টি করা, কাবা ও হজ অনুষ্ঠানের সাথে বিজড়িত মহামানবগণের স্মৃতিচারণ করার মাধ্যমে তাঁদের প্রতি ভক্তি-অনুরাগ সৃষ্টি করে ফায়েজ হাসিল করত সৎ কাজের প্রেরণা লাভ করা, সমগ্র বিশ্বের মুসলমানগণের একত্রিত হয়ে একই স্থানে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, আল্লাহ্র মনোনীত মহামানবগণের বাণী অনুসরণে নিজের জীবনকে পবিত্র ও পাপমুক্ত রাখার সংকল্প করা আর সে অনুযায়ী উত্তম মুসলমানরূপে নিজেকে গড়ে তোলা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, হজের বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা ধুমধামের সাথে প্রতিপালিত হলেও হজের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য মুসলমানদের জীবনে চারিত্রিক সংশোধন ও আত্মিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না।

সহিহ্ বোখারী শরীফের কিতাবুল ঈমানে- উবায়দুল্লাহ্ ইবনে মুসা-ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) ফরমান- “ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের ওপর- (১) আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল-এ কথায় সাক্ষ্য দান করা; (২) নামাজ কায়েম করা; (৩) যাকাত দেওয়া; (৪) হজ করা এবং (৫) রমজান-এর সিয়াম তথা রোজা পালন করা। সুতরাং পবিত্র হজ ইসলামের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।”

আরবি ‘হাজ্জুন’ শব্দ থেকে হজ শব্দের উৎপত্তি। এর আভিধানিক অর্থ হলো সংকল্পবদ্ধ হওয়া। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে ইহ্রামের সাথে জিলহজ মাসের ৯ তারিখে কতগুলো নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন পূর্বক বায়তুল্লাহ্ (কাবা) শরীফ জিয়ারত করে আরাফার ময়দানে সমবেত হয়ে ইসলামি জীবন বিধান অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করার সংকল্প গ্রহণ করাকে হজ বলা হয়। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) হিজরি ১০ম সনে হজ পালন করেন। এ হজের সময় তিনি ৯ জিলহজ তারিখে তাঁর সব অনুসারীদের আরাফার ময়দানে হাজির করে ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতিগুলো বর্ণনা করেন এবং তাঁর দীর্ঘ কর্মময় জীবন সূচারুরূপে সম্পাদন করতে পেরেছেন কিনা উপস্থিত সবার কাছে তা জানতে চান। সবাই-তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পাদন করেছেন বলে স্বীকার করলেন। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ এলো- “আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পূর্ণ করলাম ও তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম” (সূরা মায়িদা ৫: আয়াত ৩)

তখন হযরত রাসুল (সা.) ইসলাম ধর্মের মৌলিক নীতিগুলো তুলে ধরে সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি এগুলো পালন করতে পারবে? সবাই তা স্বীকার করে পালন করার জন্য দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) উপস্থিত সবাইকে তাঁর উল্লেখিত নীতি ও আদর্শসমূহ যারা অনুপস্থিত রয়েছেন, তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। তখন থেকেই বিশ্ব মুসলিম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পবিত্র হজ পালন করে আসছে। মুসলমানগণ প্রতি বছর ৯ জিলহজ তারিখে আরাফার ময়দানে সমবেত হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথে নিজেদের পরিচালিত করার জন্যে সংকল্প করে থাকেন, তাকেই আমরা হজ বলে থাকি। সাধারণভাবে ইহ্রাম বেঁধে পবিত্র কারা শরীফ তাওয়াফ করাকে ‘উমরাহ’ বলা হয়; আর তাওয়াফ করে ৯ জিলহজ তারিখে আরাফার ময়দানে সমবেত হয়ে হযরত রাসুল (সা.) কর্তৃক বিদায় হজে প্রদত্ত খুৎবা স্মরণ করে তাঁর নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করার সংকল্প গ্রহণ করাকে হজ বলা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, হযরত রাসুল (সা.) হজ উপলক্ষ্যে ১,১৪,০০০ মুসলমানসহ মদীনা থেকে মক্কায় যান এবং কোরবানির জন্যে তাঁর কাছে ১০০টি উট ছিল। বিদায় হজের বাণী প্রদানকালে নবিজি ঘোষণা করেন-পথ প্রদর্শক হিসেবে তোমাদের জন্যে আল্লাহর কালাম ও তাঁর রাসুলের চরিত্রাদর্শ রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা কুরআনের অনুশাসন মেনে আমার চরিত্রাদর্শ অনুযায়ী চলবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।

এ হজ কেবলমাত্র সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্যে ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। অর্থাৎ- মক্কা মুয়াজ্জমায় গিয়ে হজ পালন করার মতো যার শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তার জন্যে জীবনে অন্তত একবার হজ করা ফরজ। ধনীদের উপর হজ ফরজ করার কারণ হলো- ধনীরা সাধারণত পার্থিব বিষয়ে অধিক আসক্ত থাকে। ফলে ধর্ম পালনের ব্যাপারে তাদের মাঝে কিছুটা উদাসীনতা দেখা যায়। কিন্তু হজের আহকামগুলো পালনের মাধ্যমে তারা দৈহিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ লাভ করে তাদের মনকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। যেমন,ইহরাম বাঁধার সময় সেলাই বিহীন দুই খন্ড সাদা কাপড় পরিধান করে খালি মাথা ও খালি পা হওয়ার মাধ্যমে হাজিদের হৃদয়ে মৃত্যু চিন্তা উদয় হয়। ইহ্রাম অবস্থায় সকল প্রকার কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহ্র ধ্যানে নিমগ্ন থাকার বিধান রয়েছে।

হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “মুতু কাবলা আনতা মুতু।” অর্থাৎ- “তুমি মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করো- মৃতবৎ আচরণ বা পার্থিব সকল আসক্তিমুক্ত হও।”

ইহরাম হলো মৃতবৎ আচরণের প্রশিক্ষণ। মৃত ব্যক্তি জীবহত্যা করতে পারে না। ইহরাম অবস্থায় প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ। কেউ তা করে বসলে তাঁর জীব প্রবৃত্তিকে মৃতবৎ করার ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়। তাই এর কাফ্ফারা হিসেবে অন্য একটি হালাল জীব কোরবানি দিতে হয়। কাবা শরীফ তাওয়াফ করার সময় মন আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয়, আরাফার ময়দানে গিয়ে আদি পিতার গুনাহ্ মাফের ঘটনা স্মরণ করে নিজের জীবনের গুনাহ্র জন্যে মনে অনুতাপ-অনুশোচনা সৃষ্টি হয় এবং হাজিগণ আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন। আল্লাহর হুকুম অমান্য করে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল আস্বাদন করার অপরাধে হযরত আদম (আ.) বিবি হাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কৃত অপরাধের জন্যে ৩৬০ বা ৩৯০ বছর আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করার পর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অসিলায় আল্লাহ্ তাঁর গুনাহ্ মাফ করে দেন। হযরত আদম (আ.) আরাফাতের ময়দানে তাঁর গুনাহ্ মাফের সুসংবাদ প্রাপ্ত হন এবং দীর্ঘ দিনের বিরহের আগুনে পুড়ে অবশেষে আরাফাতের ময়দানেই তিনি বিবি হাওয়ার সাথে মিলিত হন। সাফা-মারওয়া পর্বত সাঈ করার সময় হযরত বিবি হাজেরা ও শিশু হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতি মনে পড়ে, তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আল্লাহর প্রিয় পাত্রগণের জীবনে সংঘটিত ঘটনাকে স্মরণ করে তাঁদের প্রতি আমাদের অন্তরে মহব্বত সৃষ্টি হয়, তাঁদের আচার-আচরণকে অনুসরণ করে তাঁদের প্রতি আমাদের আনুগত্য প্রকাশ পায়। হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবাঘর নির্মাণ করে নিজে সেখানে অবস্থান করতেন। তাঁর প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রকাশ করে তাঁর অনুসারীরা কাবাঘরকে তাওয়াফ করতেন। হজ করতে গিয়ে হাজিগণ আজও কাবাঘরকে ৭ বার তাওয়াফ করে থাকেন। এর প্রধান কারণ মূলত হযরত রাসুল (সা.)-এর আচরণ অনুসরণ করে আল্লাহর বন্ধুগণের প্রতি সম্মান ও আনুগত্য প্রদর্শন। মিনায় গিয়ে হাজিগণকে কোরবানি করতে হয়। কোরবানি মূলত সুন্নতে ইব্রাহীম। কিন্তু হযরত রাসুল (সা.) যেহেতু কোরবানি করেছেন, হাজিগণ মিনায় গিয়ে কোরবানির মাধ্যমে স্বীয় নবি ও তাঁর পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশ করে থাকেন। পথে পাথরের নির্মিত ফলকে কাঁকর নিক্ষেপ করতে হয়। এ কাঁকর নিক্ষেপ করেছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ.) শয়তানের উদ্দেশ্যে। কোরবানি হওয়ার জন্যে যখন তিনি পিতার সাথে মিনার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন শয়তান তাকে ওয়াছ ওয়াছা দিয়েছিল। পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে একথা জানালে পিতা তাকে পরামর্শ দিলেন শয়তানের প্রতি কাঁকর নিক্ষেপ করতে। হযরত রাসুল (সা.) যেহেতু হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর এই আচরণকে অনুসরণ করেছেন, আমরাও তাই হজ পালন করতে গিয়ে শয়তানের উদ্দেশ্যে কাঁকর নিক্ষেপ করি। একই সাথে তাঁর আদর্শ অনুসরণের পথে নিজের নফ্স শয়তান যদি কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সে বাধাকে অতিক্রম করতে হবে- এ শিক্ষা লাভ করা। মদীনায় গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের মাধ্যমে অন্তরে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রতি গভীর প্রেম জাগ্রত হয়। বস্তুত ধনীদের উপর হজ পালনের বিধান রাখার উদ্দেশ্য হলো- তাদেরকে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবার প্রশিক্ষণ দেওয়া। প্রকৃত হজ পালনের মাধ্যমে একজন ধনী মুসলমান ইসলাম ধর্মের আরকান-আহকামগুলো রীতিমত পালন করে শান্তিময় জীবন যাপনের শিক্ষা লাভ করে থাকেন। নিজের চরিত্রকে ইসলামের ছাঁচে ঢেলে বাকী জীবন সে মোতাবেক চলার সংকল্প গ্রহণ করা হলো হজের প্রধান শিক্ষা। এ শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়ন করতে হলে ধনীদেরকে হজ শেষে দেশে ফিরে এসে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উপায় অন্বেষণ করতে হবে। হযরত রাসুল (সা.)-এর আদর্শের শিক্ষাদাতা তাঁর নূরে হেদায়েতের ধারক-বাহক আল্লাহর অলীগণের সান্নিধ্য লাভ করতে হবে।

সামর্থ্যবান ধনী মুসলমানদের এ হজ ছাড়াও ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্যে আরো এক রকম হজ রয়েছে। যাদের বায়তুল্লাহ্ শরীফে যাওয়া কিংবা মদীনা মনোয়ারায় গিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের সামর্থ্য নেই, তাদের হজ প্রসঙ্গে হযরত জালালুদ্দিন রুমী (রহ.) বলেছেন,
“দিল ব দস্তে আরকে হজে আকবরাসত, ছদ্ হাজারা কাবা এক দিল বেহেতরাস্ত”- তুমি যদি আল্লাহর বন্ধুকে ভালোবাসতে পার, আকবরি হজের চেয়ে উত্তম ও বেশী ফলদায়ক হবে। আকবরি হজ হলো- শুক্রবারে যে হজ পালিত হয়। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজ শুক্রবার পালন করেছিলেন। আকবরি হজের মর্তবা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত মাওলানা রুমী (রহ.) বলেন- “ছদ হাজারা কাবা এক দিল বেহেতরাস্ত”- লক্ষ কাবার চেয়ে আল্লাহ্কে ধারণকারী একটি পুতঃপবিত্র হৃদয়ের মর্তবা অনেক বেশি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, “এ কাবা বেনায়ে আবো গেলাস্ত; আক্বাবা বেনায়ে আজ নুরে খোদাস্ত”- অর্থাৎ বায়তুল্লাহ্ শরীফের কাবা ঘরকে পানি, পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। আর মুমেন ব্যক্তির দিল কাবাকে আল্লাহর খাছ নুর দিয়ে তৈরী করা হয়েছে।” “এ কাবা গুজার গাহে খালিলাস্ত-আক্বাবা গুজারগাহে রাব্বে জালিলাস্ত”- এই ক্বাবায় হযরত ইব্রাহীম (আ.) বসবাস করতেন, আর মুমেন লোকের দিল কাবাতে আল্লাহ্ নিজে বসবাস করেন। হাদিস শরীফে বলা হয়েছে- “কুলুবুল মু’মেনীনা আরশুল্লাহ্।” অর্থ- “মুমেনের দিল আল্লাহর আরশ।” সুতরাং যে ঘরে আল্লাহ্ নিজে বসবাস করেন- সে ঘরের মর্তবা ইব্রাহীম (আ.)-এর ঘরের চেয়ে বেশি। তাই হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “আল মু’মিনু আকরামা হুরমাতাম মিনাল ক্বা’বাতি।” অর্থ- “মুমেন ব্যক্তি কাবাঘরের চেয়েও অধিক সম্মানিত।” (আবু দাউদ শরীফ)

বায়তুল্লাহ্ শরীফ জিয়ারত করে ও হজের আহকামসসূহ পালনের মাধ্যমে আমাদের মাঝে ধর্মের প্রতি যে মহব্বত পয়দা হয়, আল্লাহর বন্ধুদের ভালোবাসলে তার চেয়েও বেশি মহব্বত পয়দা হয়। আপনার মাঝে যদি আল্লাহ্ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর মহব্বত পয়দা হয় এবং আপনি যদি নবি করিম (সা.)-এর আশেকে পরিণত হতে পারেন, তবে অবশ্যই তাঁর সাথে আপনার যোগাযোগ হবে। আর হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে পরিচয় হলে তিনি আপনাকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন। কাজেই আল্লাহ্কে পেতে হলে যিনি আল্লাহ্কে পেয়েছেন, তাঁর সাহচর্যে গিয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানুত্তাকুল্লাহা ওয়াকুনু মা’আছ ছাদেকীন।” অর্থ- “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো; আর সত্যাশ্রয়ীদের সংসর্গ লাভ করো।” (সূরা তাওবা ৯ : আয়াত ১১৯)

মুমেন ব্যক্তির মাঝে আল্লাহ্ তায়ালা বসবাস করেন বিধায় তাঁকে শ্রদ্ধা করার অর্থই হলো আল্লাহ্কে শ্রদ্ধা করা; তাঁর নির্দেশ মতো চলার অর্থই হলো আল্লাহর নির্দেশে চলা। আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি রাসুলের অনুসরণ করলো প্রকারান্তরে সে আল্লাহ্কেই অনুসরণ করলো” (সূরা নিসা ৪ : আয়াত ৮০)
আর হযরত রাসুল (সা.)-এর অবর্তমানে তাঁর নায়েব বা উত্তরসূরি হেদায়েতের দায়িত্ব অলী-আল্লাহ্ বা মোর্শেদের তাবেদারি করতে হবে। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা আরও ঘোষণা করেছেন যে, তোমরা আমার তাবেদারি করো, রাসুলের তাবেদারী করো এবং তোমাদের মধ্যে যিনি আমার পক্ষ থেকে নিযুক্ত আদেশদাতা তার তাবেদারি করো। যিনি সাধনা করে আল্লাহর পরিচয় লাভ করেছেন, তিনি এলহামের মাধ্যমে প্রাপ্ত আল্লাহর নির্দেশেই চলবেন। যিনি পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হননি, তিনি রাসুলের নির্দেশে চলবেন, আর যিনি রাসুলকে পাননি তিনি হেদায়েতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো অলী-আল্লাহর নির্দেশে চলবেন- আল্লাহর বিধান এরকম। অলী-আল্লাহ্ হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট সিলেবাস আছে। যিনি কোনো মোকাম্মেল মোর্শেদের সাহচর্যে গিয়ে সিলেবাস অনুযায়ী সাধনা করে আল্লাহ্র সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে পারেন, তিনিই হন অলী-আল্লাহ্। যেমন, বলখের বাদশাহ্ হযরত ইব্রাহীম বিন আদহাম (রহ.) একবার হজে যাওয়ার নিয়ত করেছিলেন। কিতাবে আছে, তিনি একাধারে ১৪ বছর পায়ে হেঁটে হজে গিয়েছিলেন। দিব্য দৃষ্টিতে কাবাঘরকে দেখতে দেখতে তিনি এক কদম হাঁটতেন আর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। এভাবে বলখ থেকে ইব্রাহীম আদহাম (রহ.) হেরেম শরীফে গিয়ে দেখেন সেখানে কাবাঘর নেই। তখন তিনি পেরেশান হয়ে গেলেন। সিজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন, “হে প্রভু! এত কষ্ট করে হজ করতে এলাম, এখন কাবাঘর দেখছি না কেন? এলহাম হলো- “হে ইব্রাহীম আদহাম! অপেক্ষা করুন।” তিনি পুনরায় প্রার্থনা জানালেন, “হে প্রভু! কিসের জন্য অপেক্ষা করব, দয়া করে জানান।” পুনরায় এলহাম হলো- “আপনি অপেক্ষা করুন, কাবাঘর আমার আশেক বন্ধু রাবেয়া বসরিকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছে। রাবেয়া বসরি আমার বন্ধু, সে নিয়ত করেছে, হজ করার জন্যে। তাই তাকে সম্মান দেখানো আমার কর্তব্য। এ জন্যে আমি কাবাঘরকে নির্দেশ দিয়েছি রাবেয়া বসরিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসার জন্যে।” পরবর্তী সময়ে রাবেয়া বসরি (রহ.) কাবাঘর-সহ যখন আসলেন, তখন হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, “হে রাবেয়া! আমি এত কষ্ট করে হজ করতে আসলাম, কিন্তু কাবাঘর দেখতে পাচ্ছিলাম না।” তখন রাবেয়া বসরি (রহ.) বলেছিলেন, “হে ইব্রাহীম! বল তুমি কার জিয়ারত করতে এসেছো?” ইব্রাহীম আদহাম (রহ.) বললেন, “আমি কাবাঘর জিয়ারত করতে এসেছি।” হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.) বললেন, “আমি কাবার মালিক আল্লাহ্কে জিয়ারত করতে এসেছি। সুতরাং আমি আমার মনিবকে জিয়ারত করতে এসেছি বলে কাবা আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিল।” এ ঘটনা থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, মুমেনের মর্যাদা কত বেশি।
হালাতে মাশায়েখ কিতাবে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.)-এর একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। একবার তিনি হজে যাওয়ার নিয়ত করেছিলেন। কাবা শরীফ ও হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করার জন্যে তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন একদিন হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.) মাগরিবের নামাজ পড়ে মোরাকাবায় বসেছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি দেখতে পেলেন, সমস্ত জীন ও ইনসান তাঁকে কেবলা করে নামাজ পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.) মোরাকাবা ছেড়ে দিলেন। আবার মোরাকাবায় বসে তিনি ঐ একই দৃশ্য দেখতে পান। এভাবে তিনবার দেখার পর তিনি আল্লাহর কাছে বিষয়টি অবগত হওয়ার জন্য ফরিয়াদ জানিয়ে বললেন, “হে প্রভু! আমি কি মুশরিক হয়ে গেলাম? আমাকে ক্ষমা করো।” আল্লাহর পক্ষ থেকে এলহাম হলো- “হে আমার বন্ধু! আপনি হজ করার নিয়ত করেছিলেন। যেহেতু আপনি আমার বন্ধু! এ জন্যে কাবাঘরকে আমি নির্দেশ করেছি, আপনার জিয়ারতে উপস্থিত হতে, সুতরাং কাবাঘর এখন আপনার জিয়ারতে হাজির। যেহেতু সমস্ত জীন-ইনসান কাবাকে কেবলা করে আমাকে সেজদা করছে, তাই আপনি দেখছেন- তাদের কেব্লা আপনার দিকে।” তখন হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রহ.) তাঁর একজন খাদেমকে ডেকে একটি জায়গা দেখিয়ে বললেন যে এই স্থানটি (২৫ ফুট * ৪০ ফুট জায়গা) দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করে রাখ। তারপর থেকে ঐ সংরক্ষিত জায়গার নাম হয় ‘বায়তুল কাবা’। কিন্ত পরিতাপের বিষয় আজ আমরা আল্লাহ্র অলীগণের বিরোধিতা করে আল্লাহ্র বান্দাদের উপর জুলুম নির্যাতন করে, তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করে লক্ষ টাকা ব্যয় করে যাচ্ছি হজ করার জন্য। আসলে আল্লাহ্কে পেতে হলে আল্লাহর বন্ধুদের কাছে যেতে হবে এবং তাঁদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত হয়ে ধর্মকে ব্যক্তি জীবনে বাস্তবায়িত করে আল্লাহর সৃষ্টির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। তবেই হাকিকতে হক পালন করা সম্ভব হবে। আপনি যদি সাধনার মাধ্যমে আপনার হৃদয়কে পবিত্র করতে পারেন, তবে আল্লাহ্ নিজেই সেখানে অবস্থান নেবেন। যে কথা হাদিস শরীফে বলা হয়েছে- “কুলুবুল মুমেনীনা আরশুল্লাহ্।” অর্থ- “মুমেনের দিল হলো আল্লাহর বাসস্থান।” ঐ অবস্থায় আপনি আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে অসীম শান্তি লাভ করবেন।

হজে গিয়ে হাজিগণ বায়তুল্লাহ্ শরীফে রক্ষিত হাজরে আসোয়াদ পাথরে চুমু খায়। প্রচলিত ধারণা- ঐ পাথরে চুমু খেলে মানুষের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে ‘হাজরে আসোয়াদ’ এককালে সাদা ছিল। মানুষের গুনাহ্ চুষতে চুষতে সেটা কালো হয়ে গেছে। হাজরে আসোয়াদ শব্দের অর্থই হলো, ‘কালো পাথর’। সুতরাং তা কখনও সাদা ছিল- এ ধারণা অবান্তর। ‘নির্বাসিতা হযরত হাজেরা (রা.)’ নামক জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যায়- হযরত বিবি হাজেরা (আ.) যখন মক্কার মরুভূমিতে নির্বাসিত ছিলেন, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) একবার তাঁকে দেখতে যাওয়ার মনস্থ করলেন। এ কথা শুনে তাঁর অপর স্ত্রী শর্তারোপ করলেন যে, আপনি যদি সেখানে যেতে চান, তবে যান। কিন্তু উটের পিঠ থেকে জমিনে নামতে পারবেন না। হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাতে সম্মত হলেন। তারপর তিনি যখন মক্কায় গিয়ে পৌঁছলেন, বিবি হাজেরা তাঁর শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে তাকে দেখতে এলেন। শিশু ইসমাঈল তাঁর মা বিবি হাজেরাকে জিজ্ঞেস করেন, মা! উনি কে? তখন বিবি হাজেরা জবাব দিলেন- ইনি তোমার পিতা! ইসমাঈল (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে উটের উপর থেকে জমিনে নামতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু বিবি সারার সাথে দেওয়া ওয়াদার কথা স্মরণ করে তিনি উটের পিঠ থেকে নামলেন না। তিনি পুত্র স্নেহে অশ্রু বিসর্জন করছিলেন। তখন বিবি হাজেরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর বন্ধু! আপনি কি এখানে না নামার ওয়াদায় আবদ্ধ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর বিবি হাজেরা একখানা কৃষ্ণবর্ণের পাথরের উপর হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে নামতে অনুরোধ করলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) সেই পাথরের উপর অবতরণ করেন। বিবি হাজেরা ও ইসমাঈল (আ.) অত্যন্ত আদব, ভক্তি ও মহব্বতের সাথে আল্লাহর নবি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পদচুম্বন করলেন, তাঁর পা মোবারক জমজম কূপের পানি দিয়ে ধুইয়ে দিলেন। বিবি হাজেরা নিজের মাথার চুল দিয়ে তাঁর পা মোবারক মুছে দিলেন। আল্লাহর নবিকে খেজুর খেতে দিলেন। জমজম কূপের পানি পান করতে দিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) নির্বাসিত স্ত্রী ও পুত্রের সেবাযত্নে তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হলেন। পুনরায় উটের পিঠে চড়ে বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি তাঁদের মঙ্গলের জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার পর বিবি হাজেরা ও ইসমাঈল (আ.) পাথরটিকে যত্নসহকারে একটি উঁচু স্থানে নিয়ে রাখেন। যখনই তাদের মনে আল্লাহর নবি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কথা স্মরণ হতো, তাঁরা ঐ পাথরে চুমু খেতেন। আল্লাহ্র নির্দেশে কাবাঘর নির্মিত হওয়ার পর আল্লাহর বন্ধু হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত এ ‘হাজরে আসোয়াদ’ অত্যন্ত মর্যাদার সাথে সেখানে রক্ষিত হয়। তখন বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর বন্ধুর পদস্পর্শে পবিত্র এ পাথরে চুমু দিয়ে আল্লাহর বন্ধুকে সম্মান দেখানোর ফলে আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুর অসিলায় মানুষের গুনাহ্ মাফ করে দেন। এ কারণেই ইব্রাহীম (আ.)-এর বংশধরগণ আদিকাল থেকে ‘হাজরে আসোয়াদ’ পাথরে চুম্বন করে আসছেন। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর বংশধর ছিলেন বলে তিনিও ঐ পাথরকে চুম্বন করতেন। হাজরে আসোয়াদকে চুম্বন প্রসঙ্গে হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, “আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি এক টুকরা পাথর মাত্র, কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ সাধনের ক্ষমতা তোমার নেই। সুতরাং নবি (সা.)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।” অথচ আজ আমরা আল্লাহর বন্ধুদের বিরোধিতা করে সে পাথরকে চুমু খেতে গিয়ে ঠেলাঠেলি করে নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলি।

আজ সারা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে- আল্লাহর বন্ধুদের প্রকাশ্য বিরোধিতা করে, অন্যের ধন-সম্পদ, অর্থ-কড়ি আত্মসাৎ করে হজ পালনের মাধ্যমে আমরা অনেকে হাজি হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু একটিবারও ভেবে দেখিনা যে, আল্লাহ্কে পেতে হলে আল্লাহর বন্ধুদের কাছে যেতে হয়- মানুষকে ভালোবাসতে হয়। পার্থিব বিদ্যা শিক্ষার জন্যে শিক্ষকের প্রয়োজন হয়। অথচ আল্লাহ্কে পাওয়ার কথা বললে ধারণা করা হয় যে, এ জন্যে কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আসলে প্রত্যেকটি বস্তুরই জাহের ও বাতেন আছে। তেমনি হজেরও জাহের ও বাতেন আছে। হজের জাহেরি আহ্কামগুলোর পাশাপাশি বাতেনি দিকগুলোও যদি ঠিকভাবে পালন করা যায়, তবেই হাকিকতে হজ পালিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আবদুল্লাহ্ ইবনে মোয়াফেক নামে ইয়েমেনের অধিবাসী এক দরিদ্র কসাই দীর্ঘ ৩০ বছর তার কষ্টার্জিত অর্থ সঞ্চয় করেছিল হজ করার জন্যে। সে যখন হজে যাবে, তার আগের দিন তার স্ত্রী বললো- আমি মাংস খাবো। সে বললো- আমার কাছে বাড়তি টাকা নেই মাংস কেনার মতো। হজের টাকা থেকে যদি মাংস কিনি তবে আমার হজে যাওয়া হবে না। তখন সে স্ত্রীর আবদার রাখতে গিয়ে পাশের বাড়িতে গেল একটু মাংস আনার জন্যে। সে তার প্রতিবেশীকে বললো- আপনাদের বাড়ী থেকে মাংস রান্নার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের একটু মাংস দিন। আমি হজে যাব। আমার স্ত্রী মাংস খেতে চাচ্ছে; বাজার থেকে যদি মাংস এনে দিই তবে আমার হজে যাওয়ার টাকা কম পড়ে যাবে। তখন ঐ বাড়ীওয়ালা বললো- ভাই, এ মাংস আমাদের জন্যে হালাল কিন্তু আপনাদের জন্যে হারাম। কারণ সাত দিন যাবৎ আমরা অনাহারে আছি। অবশেষে অনাহারক্লিষ্ট ছেলে-মেয়েদের কান্নাকাটি সহ্য করতে না পেরে নদীর পানিতে ভেসে থাকা একটা মরা গাধা তুলে এনে তার মাংস রান্না করে খাচ্ছি। কাজেই এটা আমাদের জন্যে হালাল তবে আপনাদের জন্যে হালাল নয়।

এ কথা শুনে হজে গমনেচ্ছু ব্যক্তি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ভাবলেন- হায়রে! আল্লাহ্র বান্দাদের এমনিভাবে অভুক্ত রেখে হজে গিয়ে আমার কী লাভ হবে? তখন তিনি হজে না গিয়ে তাঁর সঞ্চিত সমস্ত টাকা ঐ পরিবারের লোকদের দিয়ে দিলেন। সে বছর হজ হয়ে যাওয়ার পর জনৈক অলী-আল্লাহ্ স্বপ্নে দেখেন- ঐ বছর মাত্র একজনের হজ আল্লাহ্ দয়া করে কবুল করেছেন। আর সে ব্যক্তি হলেন উক্ত কসাই। তাই হাদিস শরীফে বলা হয়েছে- “ইন্নাল্লাহা লা ইয়ানজুরু ইলা ছুয়ারিকুম ওয়া আমওয়ালিকুম ওয়ালা কিইয়ানজুরু ইলা কুলুবিকুম ওয়া নিয়্যাতিকুম।” অর্থ- “আল্লাহ্ মানুষের ধন-সম্পদ ও চেহারা দেখেন না, তিনি দেখেন মানুষের অন্তর ও নিয়ত।” সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। হাদিস শরীফে আরো বলা হয়েছে- “ইরহামু মান ফিল আরদি ইয়ার হামুকা মান ফিস সামায়ি।” অর্থ- “যে সৃষ্টির প্রতি দয়াশীল উপরওয়ালা (আল্লাহ্)-ও তার প্রতি দয়াশীল।” (মেশকাত শরীফ)

আল্লাহর বন্ধুগণের আদর্শে নিজেকে পরিচালিত করার প্রার্থনা জানানোর পদ্ধতি পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ শিক্ষা দিয়েছেন- চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি। আল্লাহর প্রিয়জনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মানুষ সহজে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। হজের আহকামসমূহ পালনের মাধ্যমে অতীতের মহামানবগণের স্মৃতিচারণ থেকে তাঁদের অনুকরণ অনুসরণের প্রেরণা ও সংকল্প নিয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর উত্তরসূরিগণের অনুসরণের মাধ্যমে বাস্তব জীবন পরিচালনা করা সহজ হয়। হজ পালনে এরূপ জীবনযাপনের প্রক্রিয়া শুরু করার প্রেরণা ও সংকল্প লাভ হয়ে থাকে, যা পরিণামে মানুষকে আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হতে সক্ষম করে তোলেন।

বস্তুত হাকিকতে হজ পালন করে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জন্যে আমাদের অবশ্যই মহামানবদের সাহচর্যে গিয়ে এলমে তাসাউফের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কারণ তাসাউফ সাধনার মাধ্যমে অন্তরের পবিত্রতা আনয়ন করতে সক্ষম হলেই হাকিকতে হজ পালন করা সম্ভব।

হজ ও কাবার সঠিক ধারণা হলো এই যে, মুক্তিকামি মানুষ যাতে প্রকৃত কাবার তাৎপর্য অনুধাবন করত আত্মসংশোধনে সংকল্পবদ্ধ হয়ে সঠিক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।

হাদিস শরীফে হযরত রাসুল (সা.) ফরমান- “লা ইউমিনু আহাদুকুম হাত্তা আকুনা আহাব্বা ইলাইহি মিউ ওয়ালিদিহি ওয়া ওয়ালাদিহি ওয়ান্নাসি আজমায়িন।” অর্থ- “ততক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তি মুমেন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের ধন-সম্পদ, পিতা-পুত্র এমনকি নিজের জানের চেয়েও আমাকে বেশি ভালো না বাসবে।” (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)

আমরা আল্লাহ্র নবি (সা.)-কে দেখিনি, কেবল তাঁর কথা শুনেছি। তিনি কত কষ্ট করে, কত নির্যাতন সহ্য করে ধর্ম প্রচার করেছেন, মানুষের মুক্তির জন্যে দেওয়ানা হয়েছেন। যদিও শরিয়তের বিধান মোতাবেক হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করা হজের অংশ নয়, তথাপি যারা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে মক্কায় হজ করতে গেছেন, হজ সমাপ্ত করার পর তারা নবি করিম (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের এ সুবর্ণ সুযোগ সহজেই নিতে পারেন। হযরত রাসুল (সা.) হায়াতুন্নবি। হাদিস শরীফে রাসুলুল্লাহ্ (সা.) ফরমান- “আমার ওফাতের পরে যে আমার রওজা জিয়ারত করল সে যেন জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল।” (তিরমিজি শরীফ)

উক্ত হাদিসের আলোকে বোঝা যায় যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় তাঁর সান্নিধ্যে গিয়ে হৃদয়ে ফায়েজ হাসিলের মাধ্যমে যেমন ইমানের নুর পয়দা হয়েছে, তদ্রুপ ভক্তি-মহব্বতের সাথে তাঁর পবিত্র রওজা জিয়ারতের মাধ্যমেও হৃদয়ে ইমানের নুর বৃদ্ধি পায়।

হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রেম অর্জনের মাধ্যমে নিজের ইমান মজবুত করার জন্যে নবিজির পবিত্র রওজা জিয়ারত করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। যে কেউ হযরত রাসুল (সা.)-এর নামে দরূদ ও সালাম পাঠ করলে নবিজি তার জবাব দিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে তিনি ফরমানঃ: “তোমরা আমার উদ্দেশ্যে যে দরূদ ও সালাম পাঠ করো আমি আল্লাহর অনুগ্রহে তা গ্রহণ করি ও তার জবাব দিয়ে থাকি।”

হযরত রাসুল (সা.)-এর শাফায়াত ব্যতীত শেষ বিচার দিনে কোনো উম্মত মুক্তি পাবে না। তাঁর প্রেম অর্জনের মাধ্যমে আমরা তাঁর শাফায়াত লাভের পথ সুগম করতে পারি।

দূর থেকে হযরত রাসুল (সা.)-এর কথা শোনা বা তাঁর কথা চিন্তা করা আর রওজা মোবারকে গিয়ে তাঁকে স্মরণ করা এক জিনিস নয়। তাই প্রত্যেক হাজির উচিত হযরত রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারকে হাজির হয়ে তাঁর জিয়ারত ও প্রেম হাসিলের এমন সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করা।

হজের আহকামসমূহ কিভাবে পালন করতে হবে, কেন তা পালন করতে হয়, শুদ্ধভাবে সেগুলি পালন করতে পারলে একজন হাজি তা থেকে কি উপকার লাভ করবেন- এ সকল বিষয় বিস্তারিত জেনে নিয়ে যদি একজন মুসলমান নিষ্ঠার সাথে হজ পালন করেন, তার হজ বৃথা যাওয়ার কথা নয়, বরং কবুল হওয়ার কথা। আমরা যদি যে কোনো নবির যুগে ধর্মপালনের প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, ধর্মের সব কর্মকান্ড আবর্তিত হয়েছে নবি-রাসুলকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ- ধর্ম পালনের মূলমন্ত্র ঐ ধর্মের প্রবর্তক মহামানবকে যথাযথ অনুসরণের মধ্যে নিহিত আছে। আল্লাহর বন্ধুর প্রতি ভক্তি বিশ্বাস ও ভালোবাসা পোষণ করা এবং তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে ধর্মপালনকারী আপন হৃদয়ে নবির রূহানি মদদ ও নেয়ামত লাভ করে ইমানদার হন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সক্ষম হন। প্রকৃতপক্ষে ধনীগণ শুদ্ধভাবে হজ পালনে সক্ষম হলে তাদের হৃদয়ে মহান আল্লাহর নেয়ামতস্বরূপ ফায়েজ বর্ষিত হয়। কিন্তু সেটুকু যথেষ্ট মনে করা যাবে না। শুষ্ক জমিতে একপশলা বৃষ্টি হলে তখন বীজ বপনের ক্ষেত্র তৈরী হয়। ফসল পেতে গেলে ঐ জমিতে বীজ অবশ্যই বপন করতে হয়। বীজ বপন না করে ফসল আশা করা যায় না। তেমনি শুদ্ধভাবে হজ পালনের মাধ্যমে ধনীগণ তাদের হৃদয়কে ইমানের বীজরূপ নুর ধারণের যোগ্য করে তুলতে পারেন।

হজ সমাপনান্তে দেশে ফিরে এসে তাঁদেরকে রাসুলের ওয়ারেস কোনো হেদায়েতকারী অলী-আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে ক্বালবে ইমানের নুর বপন করে সাধনার মাধ্যমে পূর্ণ মুমেনে পরিণত হতে হবে। তবেই তাদের হাকিকতে হজ পালনের সার্থকতা লাভ হবে।

[সূফী সম্রাটের যুগান্তকারী ধর্মীয় সংস্কার ১ম খণ্ড থেকে সংকলিত]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here