৫জি গড়বে স্মার্ট পৃথিবী

0
181

প্রযুক্তি ডেস্ক : ৫জি মূলত ৫ম প্রজন্মের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সিস্টেম। ‘জি’ অর্থে ‘জেনারেশন’কে বোঝানো হয়। অর্থাৎ ওয়্যারলেস কোম্পানিগুলো ১জি থেকে তাদের যাত্রা শুরু করে ধাপে ধাপে উন্নতির ফলে ৫জি-তে উন্নিত হয়েছে। এটি বর্তমানের সবচেয়ে যুগোপযোগী অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সিস্টেম।

প্রচণ্ড শক্তিশালী ৫জি একটি ব্যাপক-ভিত্তিক তারবিহীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রযুক্তি, যার গতি এতটাই বেশি যে এটা প্রায় একই সময়ে (Real Time) তথ্য পাঠানো এবং এর প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করতে সক্ষম। বর্তমান ৪জি প্রযুক্তি থেকে ৫জি-তে ব্যান্ডউইথ স্পীড কয়েকগুণ বেশি। ৫জি প্রযুক্তির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ৯০% কম এনার্জি ব্যয় করে কাজ করবে। অর্থাৎ শুধু গতিই নয় ইন্টারনেটে কানেক্ট হওয়ার পরে দ্রুত চার্জ ফুরিয়ে যাবার যন্ত্রনা থেকেও মুক্তি দেবে এই ৫জি প্রযুক্তি।

শুধু হাই ব্যান্ডউইথই নয়, এই প্রযুক্তি একত্রে অনেকগুলো ডিভাইসকে যুক্ত করে রাখার জন্যও বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। একটি বাড়ি কিংবা অফিসের সকল ইলেকট্রনিকস ডিভাইসকে একটির সাথে আরেকটি যুক্ত করে রাখা যবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে।

৩জি ও ৪জি প্রযুক্তি ইন্টারনেট ব্যবহারের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটাই। যার ফলে সহজেই যেকোনো বড়ো সাইজের ফাইল শেয়ার এবং একসাথে অনেকগুলো ডিভাইস কানেক্ট করা সম্ভব হয়। এরপরে ৪জিকে আরো দ্রুততর করার জন্য প্রযুক্তি নির্মাতারা নিয়ে আসে ৪জি এলটিই প্রযুক্তি, যেটা ৪জি প্রযুক্তিকে করেছিল আরো সমৃদ্ধ। কিন্তু মানুষের চাহিদার শেষ নেই। এই গতিকে আরো বাড়ানো, সেই সাথে অনেক বেশি ডিভাইসকে একত্রে যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন হয় আরো বেশি ব্যান্ডউইথ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা। এই সক্ষমতা অর্জনেই ৫জি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা শুরু হয়।

৪জি নেটওয়ার্ক যেখানে সেকেন্ডে গড়ে সর্বোচ্চ ৫ এমবি পর্যন্ত গতি প্রদান করতে সক্ষম হয়, সেখানে ৫জি-তে প্রাপ্ত ইন্টারনেট গতির গড়-মান সেকেন্ডে প্রায় ১০ গিগাবাইট। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ৫জি-তে লিট্যান্সি মাত্র ১ মিলি সেকেন্ডের হয়ে থাকে। বলাই যায় ৫জি প্রযুক্তি অনেকটা নাটকীয়রূপে ইন্টারনেটের গতি বাড়াবে।

এমন গতির ডাউনলোড স্পিড বিশ্বের হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কিংবা ব্যবসায়িক কাজেও এনে দেবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটদের পাশাপাশি, শিল্পক্ষেত্রের (আইওটি), এন্টারপ্রাইজ নেটওয়ার্কিং এবং জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক হিসাবে ৫জি-এর প্রয়োগের ব্যাপারে টেক দুনিয়ার সবাই আশাবাদী। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ৫জি প্রযুক্তি প্রচণ্ড পরিমাণে ব্যান্ডউইথ ইউজ করার ক্ষমতা রাখলেও মোবাইল অপারেটররা গ্রাহকদেরকে কতটুকু দেবে সেটা তাদের ব্যবসায়িক পলিসির উপর নির্ভর করবে।

২০১৭ সাল থেকেই স্যামসাং, ইন্টেল, কোয়ালকম, নকিয়া, হুয়াওয়ে, এরিকসন, জেডটিই ৫জি বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। চলতি বছর থেকেই সাড়া বিশ্বের ৫জি-কে সহজলভ্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ২০১৮ সালে শীতকালীন অলিম্পিকে দক্ষিণ কোরিয়া দর্শকদের ৫জি উপভোগ করার সুযোগ করে দেয় অর্থাৎ পরীক্ষামূলক উদ্বোধন করা হয়। ২ই এপ্রিল ২০১৮ তারিখে, যুক্তরাজ্যে ভোডাফোন ৩.৪ গিগাহার্জ তরঙ্গ ব্যবহার করে পরীক্ষামূলকভাবে ৫জি চালু করে। বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত টেক কোম্পানিগুলো তাঁদের স্মার্ট ডিভাইসে ৫জি সুবিধা যুক্ত করে বাজারে ছাড়া শুরু করেছে ।

৫জি উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী বৃহৎ গবেষণা
৮ অক্টোবার ২০১২, যুক্তরাজ্যের সারি ইউনিভার্সিটি ৫জি গবেষণার জন্য ৩৫ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউণ্ডের তহবিল সংগ্রহ করে একটি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে যা ব্রিটিশ সরকারের ইউকে রিসার্চ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও হুয়াওয়ে, স্যামসং, টেলিফনিকা ইউরোপ, ফুজিতসু ল্যাবরেটরিজ ইউরোপ, রোডা এন্ড শোয়ার্জ এবং এয়ারকম ইন্টারন্যাশনাল-সহ আরো অন্যতম মোবাইল অপারেটর এর সমন্বয়ে গঠিত কনসোটিয়ামের দ্বারা গঠিত হয়। যেসব মোবাইল অপারেটররা এক দশকের মধ্যে কম শক্তি ও কম রেডিও স্পেক্ট্রাম করে ৪জি এর চেয়ে দ্রুততর গতি প্রদানের জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আগ্রহী তাদেরকে এই গবেষণা কেন্দ্র বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করবে।
২২ মার্চ ২০১৮ তারিখে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদ সদস্যরা নতুন নেটওয়ার্কের জন্য জায়গা তৈরি করতে চলতি বছরের মধ্যে ৩.৬ ও ২৬ গিগাহার্জ ব্যান্ড খুলে দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

৫জি’র সুবিধা :

  • ৫জি প্রযুক্তি শুধু ফোন আর সেলফোন নেটওয়ার্কে নয় বরং ওয়াইফাই এর মতো যেকোনো ডিভাইসে থাকতে পারে একাধিক ডিভাইসকে কানেক্টেড করার জন্য।
  • ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি হেডসেটেও ৫জি চিপ ব্যবহার করে, কম্পিউটারেও একটি চিপ লাগিয়ে ডিভাইস দুটি সহজেই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করানো যাবে।
  • ৫জি প্রযুক্তি চলে আসার পরে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে।
  • ৫জি সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির ক্ষেত্রে চমকে দেওয়া ফলাফল দেবে। যখন একটি ডিভাইস আরেকটির সাথে কানেক্টেড থাকবে, তখন লেটেন্সি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেলফ ড্রাইভিং কারের ক্ষেত্রে, একটি সেলফ ড্রাইভিং কারের সাথে আরেকটির কানেক্টেড থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেখানে কয়েক মিলি সেকেন্ডের বেশি লেটেন্সি প্রাণঘাতী হতে পারে। ৫জি প্রযুক্তি প্রত্যেকটি ডিভাইসের নিজেদের মধ্যে আরো দ্রুততর সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করতে পারে।
  • এই প্রযুক্তি শুধু ফোন এবং সেল টাওয়ার নয় বরং যেকোনো ডিভাইজের সাথে থাকতে পারে এতে হতে পারে আপনার কম্পিউটারে থাকা ৫জি চিপ থেকে ডাটা ট্র্যান্সমিট করে আপনার ফোনে, ট্যাবলেটে, টিভিতে ডাটা সিঙ্ক করা সম্ভব হবে। আবার হতে পারে একটি গেমিং কনসোল দিয়ে একসাথে একাধিক টিভি চালাতে পারবেন স্মুথভাবে।

বর্তমানের অনেক কিছুকেই ৫জি সম্পূর্ণভাবে রূপান্তর ঘটিয়ে মানুষকে অভিনব অভিজ্ঞতার স্বাদ দিবে। এর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, রিমোট রবোটিক্স, এআর-ভিআর, গেমিং এবং আইওটি বা ইন্টারনেট অব থিংসের মতো সেবা- যেগুলোতে তাৎক্ষণিক এবং সার্বক্ষণিক তথ্যের আদান-প্রদান প্রয়োজন হয়।

কনটেন্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের জন্য এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে ৫জি। প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো দুটি সীমাবদ্ধতা – গতি এবং সীমিত ধারণ ক্ষমতা দূর করতে পেরেছে ৫জি। এর ফলে আগামী দিনে টেলিভিশন স্টেশনগুলো তাদের আলট্রা-হাই-ডেফিনিশন বা ইউএইচডি টিভি সেট ব্যবহারকারী দর্শকদের জন্য এইচডিআর (হাই-ডাইনামিক রেঞ্জ), এইচএফআর (হাই ফ্রেম রেটস) এবং বিস্তৃত রং-এর সন্নিবেশ ঘটিয়ে হাই কোয়ালিটিসম্পন্ন কনটেন্ট পরিবেশন করতে পারবে।

এছাড়াও টিভিগুলো ৫জি-র মাধ্যমে তাদের খবর, খেলাধুলা, ধর্মীয় সেমিনার, ওরশ, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল, জাতীয় দিবসের মতো অনুষ্ঠান যেকোনো স্থান থেকে অত্যন্ত সস্তায় সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।

৫জি ব্যবহারে বর্তমান অবস্থান
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এই সেবা চালু করেছে পাকিস্তান। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ২০১৭ সালে শুরু হয়েছে ৫জি কার্যক্রম। জাপান এমনকি তুরস্কেও চালু হয়েছে ৫জি নেটওয়ার্ক সেবা। এশিয়ান গেমসে ৫জি’র স্বাদ দেয় ইন্দোনেশিয়া। ২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষ্যে রাশিয়া উদ্বোধন করেছে ৫জি নেটওয়ার্ক। ৫জি’র বাণিজ্যিক সেবা চালু করতে চলতি বছরে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, এর আগেই সফলতা আসতে শুরু করেছে। আর এক্ষেত্রে চালকের আসনে থাকছে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া। এর পরের অবস্থানে থাকছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান।

বাংলাদেশে ৫জি
বন্ধু রাষ্ট্র চীনের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৫জি তথা আগামী প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কের পরীক্ষামূলক যাচাইকরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণায়ণালয় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। পর্যবেক্ষণ চালাতে ৫জি নেটওয়ার্ক গবেষণা, উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে অগ্রজ প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েকে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে এসে তাদের প্রাথমিক কাজ সেরেছে। পরীক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনার অনুমতি দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ সম্পন্ন করেছে বিটিআরসি।

৫জি বিদ্যমান ৪জি নেটওয়ার্ক থেকে একটি আপগ্রেড ভার্সনের মতো শোনালেও এটি আমাদের ভাবনার থেকেও আরো বেশি কিছু। এটি হতে যাচ্ছে সেলুলার নেটওয়ার্কের বিপ্লব এবং যোগাযোগের জন্য একটি দুরন্ত গতির সীমান্তহীন মাধ্যম।

এই প্রযুক্তি যে মোবাইল ইন্টারনেট প্রযুক্তির সু-নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। হাই ব্যান্ডউইথ হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকার কারণে হতে পারে এই প্রযুক্তি শুধু মোবাইল ইন্টারনেট নয় বরং হোম ইন্টারনেটেও নিজের জায়গা দখল করে নেবে। অর্থাৎ অফিস, স্মার্ট হোমের ধারণাকে বাস্তবায়িত করবে। ব্যবহারকারীকে একগাদা তারের সাথে পেঁচিয়ে আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে না।

অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে ৫জি মানুষের আগামী দিনের জীবনযাপনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। এই প্রযুক্তিতে এমন কিছু নতুন সেবা গ্রহণের অভিজ্ঞতা মানুষ অর্জন করবে যা বর্তমানে পাওয়া সম্ভব নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here