চায়ের শুরু

চায়ের শুরু

চীনা কিংবদন্তী অনুযায়ী, চায়ের গল্পের শুরু সম্রাট শেননং (খৃষ্টপূর্ব ২৭৩৭-২৬৯৭)-কে দিয়ে, যাকে স্বর্গীয় আরোগ্য দাতা ও স্বর্গীয় কৃষক নামেও ডাকা হতো। সম্রাট তার প্রজাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নির্দেশ জারি করেছিলেন, পানি পান করার পূর্বে অবশ্যই ফুটিয়ে নিতে হবে। সম্রাট একদিন পানি ফুটাচ্ছিলেন, কোথা থেকে কয়েকটা পাতা বাতাসে উড়ে এসে পানির পাত্রে পড়ল। সেই পানি পান করতে গিয়ে সম্রাট সেটার  ঘ্রাণে মুগ্ধ হলেন, একই সাথে চাঙ্গাও অনুভব করলেন। পাতাগুলো Camellia sinensis নামক গাছ থেকে এসেছিল। সম্রাট শেন তার প্রজাদের বিপুল সংখ্যায় এই গাছ লাগানোর নির্দেশ দিলেন, প্রজাদের পানিতে চা পাতা সিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শেখালেন, আর ঘোষণা দিলেন, ‘চা শরীরে কর্মশক্তি যোগান দেয়, মানসিক তৃপ্তি আনে এবং কর্মসাধনে সংকল্প যোগায়।’

জাপানিরা চায়ের আবিস্কারের জন্য বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধর্মা বা বোধিধর্মাকে কৃতিত্ত্ব দেয়, যিনি পঞ্চম শতাব্দীর শেষদিকে ভারত থেকে চীন গিয়েছিলেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী, ধর্মা সাত বছর নির্ঘুম থেকে বুদ্ধের ধ্যান করেছিলেন। ধ্যান করতে গিয়ে তিনি টের পান, ঘুমের কারণে তার ধ্যানে মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। জেগে থাকার জন্য তিনি তার চোখের পাতা কেটে মাটিতে নিক্ষেপ করেছিলেন। সেই কেটে ফেলা চোখের পাতা থেকে একটা করে চা গাছের জন্ম হয়। সেই গাছের পাতা থেকে তৈরী পানীয় এই পুণ্যাত্মা সন্ন্যাসী ও তার অনুসারীদের চাঙ্গা করছিল আর ঘুমের ঝিমুনি থেকে রক্ষা করেছিল।

কিছু সূত্রমতে, চা গাছ আদিতে আসামের জঙ্গলে জন্মাত, অন্য আরেক মতে, বৌদ্ধ পন্ডিত ইউ লি শেন, যিনি ভারতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন, ৫৩ খৃষ্ট পূর্বাব্দে চীন ফেরত যাওয়ার সময় ৭টি চা গাছের চারা সাথে করে নিয়ে যান। তিনি শিচুয়ান প্রদেশের মেং পাহাড়ে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। শিচুয়ান প্রদেশে উক্ত সময়কালে সর্বপ্রথম চা চাষ শুরু হয় বলে প্রাচীন রেকর্ডপত্রে পাওয়া যাওয়ার কারণে এই মতের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। মেং পাহাড়ে লাগানো চা চীনে খ্যাতি লাভ করে, এটাকে তখন ‘গেন লু’ মানে ডাকা হতো, যার অর্থ ‘মিষ্টি শিশির’।

চীনের ইউনান প্রদেশেরও চায়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এখনো সেখানে প্রাচীন কিছু চা গাছ রয়েছে, যার মধ্যে বাদায় অবস্থিত একটি গাছের বয়স প্রায় ১৮০০ বছর বলে ধারণা করা হয়। ইউনান থেকেই চায়ের সুনাম চীনের অন্যান্য অংশে ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

চায়ের উৎপত্তির গল্প যাই হোক, চা গাছের অনেক প্রজাতি রয়েছে, তাদের সবাই সাদা ফুলের চিরসবুজ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ Camellia sinensis থেকে এসেছে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আসামে ব্রিটিশরা যখন চা গাছ আবিস্কার করল, কিছু উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ভাবলেন, নতুন একটা প্রজাতি বুঝি আবিস্কার হলো। তারা সেটার নাম দিলেন, Thea assamica। যদিও বর্তমানে সবাই একমত যে, সকল চা Camellia sinensis  থেকে এসেছে, এখনো অনেকে এই নামটি ব্যবহার করেন। Camellia sinensis এর তিনটি প্রধান জাত রয়েছে চীনা জাত (C. sinensisvar. sinensis), আসামীয় জাত (C. sinensisvar. assamica) ও কম্বোডিয়ান জাত (C. sinensisvar. combodiensis). ভিন্ন ভিন্ন জাত আলাদা সুগন্ধ ও গুণাগুণ ধারণ করে।

চীনা জাতের চা গাছের পাতা ছোট, ঝোপালো গাছে একাধিক প্রধান শাখা থাকে, এটাকে ১-৩ মিটার সাইজে ছেটে রাখা হয়। এই জাতের ছোট পাতা কোমল স্বাদের চা তৈরি করে। প্রাকৃতিকভাবে বাড়তে দিলে এই জাতের গাছ ৮-২০ মিটার লম্বা হতে পারে এবং শতশত বছর বাঁচতে পারে।

আসামীয় জাত কড়া স্বাদ ও গন্ধ তৈরি করে। এর গাছের আকার ছোট, একটি প্রধান কান্ড থাকে, পাতার আকার বড়। প্রাকৃতিকভাবে এই জাত ৬-২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কিন্তু চা বাগানে কোমর সমান উচ্চতায় ছেটে রাখা হয়। বাগানে চাষ করা গাছ ৪০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

কম্বোডিয়ান জাতটি মূলত চীনা জাত ও আসাম জাতের শংকর। এটাতে দুই জাতের বৈশিষ্টপূর্ণ গুণাগুণ ও স্বাদ-গন্ধের মিশ্রণ পাওয়া যায়।

এই তিনটি জাতই ব্যপকভাবে চাষ করা হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে। চা গাছ যে স্থানে চাষ করা হয়, সে স্থানের জল বায়ু আর মাটির গুণাগুণের ভিত্তি করে তার স্বাদ-গন্ধ তৈরি হয়, এর ফলে বিভিন্ন স্বাদ ও গন্ধের চা সারা দুনিয়ার নানা প্রান্তে তৈরি হয়েছে।

এ সকল গাছের কচি পাতা প্রক্রিয়াজাত করে নানারকম চা প্রস্তুত করা হয়। কিভাবে জন্মানো হলো, কি প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা হলো ও কিভাবে প্রক্রিয়াজাত বা শুকানো হলো, এসব কিছুর উপরেই চায়ের গুণাগুণ নির্ভর করে।

চা সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০ থেকে ২০০০ মিটার উচ্চতায় জন্মায়। অধিক উচ্চতায় জন্মানো চায়ে সাধারণত অধিক সুঘ্রাণ থাকে। চা উৎপাদনের জন্য তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত গুরুত্ত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। চা চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ১০-২৪ ডিগি্র সেন্টিগে্রড। আদর্শ বৃষ্টিপাত বছরে ২০০-৩০০ সেমি, যদিও কম বৃষ্টিপাতেও চা ভালো জন্মাতে পারে।

চা গাছকে মাঝারি আকারে ছেটে রাখা হয়, তাতে পাতা সংগ্রহে সুবিধা হয়। চায়ের পাতা নরম হাতে দ্রম্নত সংগ্রহ করতে হয় এবং এই কাজ সাধারণত নারী ও শিশুরা করে থাকে। তারা সাধারণত ডালের মাথায় থাকা কুঁড়ি ও কয়েকটি পাতা (সাধারণত দুইটি) সংগ্রহ করে থাকে।

কি ধরেরে চা তৈরি হবে, তার উপর নির্ভর করে চায়ের প্রক্রিয়াজাতকরণ নির্ভর করে। ছয় ধরনের চা রয়েছে, সাদা, হলুদ, সবুজ, ওলং, কালো ও পুয়াহ। সাদা, হলুদ ও সবুজ চা গাঁজানো হয় না, ওলং চা অল্প গাঁজানো হয়, আর ব্লাক টি বা কালো চা পুরোপুরি গাঁজানো হয়। সাদা, হলুদ ও সবুজ চা গাঁজানো হয় না, এর মানে হলো, অক্সিডাইজেশন ও এনজাইমের ক্রিয়া বন্ধ করার জন্য চায়ের পাতা সংগ্রহের পরপরই শুকিয়ে ফেলা হয়।

সাদা চা চীনের ফুজিয়ান প্রদেশে উদ্ভাবিত বিশেষ চা, এই চায়ের পাতা সংগ্রহের পর শুধুমাত্র দুইটি ধাপ সম্পন্ন করা হয়, উইদারিং আর শুকানো। চায়ের পাতায় ছোট ছোট চুলের মতো সাদা অংশ থেকেই সাদা চায়ের নামকরণ। সাদা চা প্রধাণত দুই ধরনের, ইন জেন বা সাদা সুঁই, পাই মু টান, যার অর্থ সাদা পিওনি (এক ধরনের ঝোপালো ফুল গাছ)। ইন জেনের ক্ষেত্রে সকাল বেলায় সবচেয়ে ডগার কুঁড়িটি ফোঁটার পূর্বেই সংগ্রহ করা হয় ও খুব সাবধানে রাখা হয় যাতে কোমল সাদা চুলগুলো নষ্ট না হয়। কুঁড়িগুলো সূর্যের আলোয় দুদিন শুকানো হয়, তারপর সাবধানে মেশিনে শুকিয়ে প্যাকেটজাত করা হয়। পাই মু টান ও একইভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়, এই চায়ের ক্ষেত্রে কুঁড়ির পাশাপাশি দুটি পাতাও সংগ্রহ করা হয়। এই দুই ধরনের চাই খুব মৃদু ও কোমল গন্ধ তৈরি করে। চীনে সাদা চা প্রায় হাজার বছর ধরে চাষাবাদ ও উৎপাদিত হয়ে আসছে। এই চা বর্তমানে দার্জিলিং, আসাম ও শ্রীলংকায়ও উৎপাদিত হয়।

হলুদ চা খুবই বিরল, আর এটা শুধুমাত্র চীনে উৎপাদিত হয়। কুঁড়ি আর একটি পাতা সংগ্রহ করা হয় এবং উত্তাপ দেওয়া হয়। উত্তাপে নেতিয়ে যাওয়া পাতা কাগজে মুড়িয়ে ধীরে ধীরে শুকানোর জন্য রেখে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে পারে। পরবর্তীতে মেশিনে শুকানো হয়। চায়ের পাতার রঙ হয় সোনালি হলুদ, চায়ের লিকার ও একই রকম হলুদ রঙ ধারণ করে। হলুদ চা কোমল ও মৃদু স্বাদ তৈরি করে।

(চলবে)

(হেলেন সাবেরির ‘Tea: A Global History’ থেকে অনূদিত, অনুবাদ: সালাহ উদ্দিন)

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *