জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে যে তথ্যগুলো জানা জরুরি

জলাতঙ্ক রোগ সম্পর্কে যে তথ্যগুলো জানা জরুরি

ডা. মো. তারেক ইমতিয়াজ (জয়)
র‌্যাবিস ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত এক প্রাণঘাতী মারাত্মক রোগ হলো জলাতঙ্ক। একে ইংরেজিতে বলে হাইড্রোফোবিয়া (Hydrophobia)। কারণ, আক্রান্ত রোগী পানি দেখে বা পানির কথা মনে পড়লে এমনকি পানির কল থেকে পানি পড়ার শব্দ শুনলেও প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এজন্যই এ রোগকে বলা হয় জলাতঙ্ক। এটা এক মারাত্মক রোগ। কারণ, রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

এ রোগ কীভাবে হয়?
জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত বা জলাতঙ্ক ভাইরাস বহনকারী কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বাদুড়, বেজি, বানর ইত্যাদি প্রাণী সুস্থ মানুষ বা গবাদিপশুকে কামড়ালে ওই মানুষ কিংবা সেই গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে।

আক্রান্ত প্রাণীর মুখের লালায় জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাস (র‌্যাবিস ভাইরাস) থাকে। এসব প্রাণির কামড়ে ভাইরাস সংক্রমিত সেই লালা কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে একজন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কুকুর- বিড়াল কিংবা শিয়াল এই প্রাণিগুলো প্রায় সময়ই তাদের পা জিহ্বা দিয়ে চেটে পরিস্কার করে, ফলে এসব প্রাণির নখেও সেই ভাইরাস সংক্রমিত লালা লেগে যায়। ফলে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত এসব প্রাণির আঁচরেও মানবদেহে এই ভাইরাস প্রবেশ করে জলাতঙ্ক রোগ করতে পারে। মানবদেহে প্রবেশের পর র‌্যাবিস ভাইরাস স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত করে এবং ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। সাধারণত আক্রান্ত প্রাণি সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ানোর ২০ দিন থেকে ৩ মাসের মধ্যে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। তবে এ সময়সীমা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্তও হতে পারে।

রোগের লক্ষণ
– ক্ষতস্থানে ব্যথা, চুলকানো বা কিছুটা অবস ভাব অনুভূত হতে পারে; সাথে জ্বর, শরীর ও মাথা ব্যথা থাকে।
– আক্রান্ত রোগীর শব্দ, উজ্জ্বল আলো অসহ্য লাগে।
– রোগীর পানির প্রতি ভীতি তৈরি হয়।
– রোগীর মুখের সামনে কোনো কিছু দিয়ে জোড়ে বাতাস করলে রোগী তা সহ্য করতে পারে না।
– রোগীর কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যায়, মেজাজ খিটখিটে হয়, আচরণে অস্থিরতা প্রকাশ পায়।
– ক্ষেত্রবিশেষে জলাতঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে পারে, রোগীর ঝিমুনি হয়, খিঁচুনি হতে পারে, এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
– শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ও মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
– পরিশেষে সাধারণত ১১-১২ দিনের মাথায় রোগী মারা যায়।

জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুর চেনার উপায়
জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুরের আচরণে কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যেমন-
– কোনো উস্কানি ছাড়াই যাকে-তাকে কামড়ানোর প্রবণতা
– যৌক্তিক কারণ ছাড়াই দৌঁড়ানো
– সরু কোনো লাঠি, নিজের মল-মুত্র ইত্যাদি খেয়ে ফেলা
– কুকুরের ডাকের শব্দে পরিবর্তন হওয়া
– মুখ হতে অতিরিক্ত লালা পড়া বা ফেনা বের হওয়া

জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা কী?
এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এই রোগে কেও আক্রান্ত হলে তার মৃত্যু অবধারিত। সুতরাং, চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য থাকে রোগীর কষ্ট কিছুটা কমানো। যেমন-
– ক্ষতস্থানে ড্রেসিং এর ব্যবস্থা করতে হবে এবং ঘা শুকানোর জন্য এন্টিবায়োটিক দিতে হবে।
– রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখতে হবে।
– রোগীর মানসিক চাপ, হতাশা কমানো এবং রোগের উপসর্গগুলোকে কমানো হবে চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য।
– রোগীর শব্দ, উজ্জ্বল আলোয় অসহ্য বোধ করলে রোগীকে কম আলো বা নিরিবিলি কক্ষে রাখতে হবে।
– রোগীর মেজাজ খিটখিটে হলে বা আচরণে অস্থিরতা প্রকাশ পেলে তাকে শান্ত করার জন্য ঔষধ দিতে হবে।
– রোগী যদি খাবার খেতে না পারে, সেক্ষেত্রে রোগীকে শিরাপথে স্যালাইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে হবে।

জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের উপায়?
এ রোগের যেহেতু সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যু অবধারিত, সুতরাং, প্রতিরোধই একমাত্র উপায়।

কোনো ব্যক্তিকে যদি জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কোনো প্রাণি কামড়ায় বা আঁচর দেয় তাহলে সর্ব প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো কাপড় কাঁচার সাবান দিয়ে এবং পানির কল ছেড়ে রেখে প্রবাহমান পানি দ্বারা আক্রান্ত স্থানটি ন্যূনতম ১৫ মিনিট যাবৎ ধুতে হবে। এর মাধ্যমে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হবার আশংকা প্রায় শতকরা প্রায় ৬৫-৭০ ভাগ কমানো সম্ভব।

তারপর রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন নিতে হবে।

আক্রান্ত স্থানে রক্তপাত হলে ভ্যক্সিন নেবার পাশাপাশি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিনও নিতে হবে। ৪৮ ঘন্টা সময় পার হয়ে গেলে এই র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন কাজ করবে না। তাই এটা নেবার প্রয়োজন হলে ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই নিতে হবে।

জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন কীভাবে নিতে হয়?
জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন দুইভাবে নেওয়া যায়। চামড়ার নিচে অথবা মাংসপেশিতে। ভ্যাক্সিন চামড়ার নিচে নিলে নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে ৩টি ডোজ নিতে হয় এবং ভ্যাক্সিন মাংশপেশিতে নিলে নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে ভ্যাক্সিনের ৪টি ডোজ নিতে হয়।

গর্ভবতী মহিলাকে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কোনো প্রাণি কামড়ালে ভ্যাক্সিন নেওয়া হবে?
একজন গর্ভবতী মহিলা তার গর্ভকালীন যে কোনো সময়ে কোনো জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত প্রাণি দ্বারা আক্রান্ত হলে জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন এবং র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন নিতে পারবে।

গৃহপালিত কোনো কুকুরের যদি র‌্যাবিস প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন দেওয়া থাকে এবং সেই কুকুর যদি কাওকে কামড়ায় তাহলে সেক্ষেত্রে কি ভ্যাক্সিন নিতে হবে?
সেই কুকুরকে যদি সঠিক নিয়মে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়ে থাকে এবং সেই কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের যদি কোনো লক্ষণ না থাকে এবং ল্যাবরেটরিতে সেই কুকুরের লাল পরীক্ষা করে যদি টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সেই কুকুর কামড়ালে ভ্যাক্সিন নেবার প্রয়োজন নেই। অন্যথায় কুকুর দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভ্যাক্সিন নিতে হবে।

পূর্বে ভ্যক্সিন নেওয়া কোনো ব্যক্তি যদি পরবর্তীতে আবার কখনো কুকুরের কামড়ের শিকার হয়, সেক্ষেত্রে তাকে কি আবার ভ্যাক্সিন নিতে হবে?
– পূর্বে ভ্যক্সিন নেওয়া কোনো ব্যক্তি যদি ভ্যাক্সিন নেবার ৩ মাসের মধ্যে আবার কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়, সেক্ষেত্রে তার ভ্যাক্সিন নিতে হবে না। তবে আক্রান্ত স্থানে যদি রক্তক্ষরণ হয় তবে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন নিতে হবে।
– কোনো রোগী যদি ভ্যাক্সিন নেবার ৩ মাস থেকে ৫ বছরের মধ্যে আবার কুকুর দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে সেক্ষেত্রে তাকে ৭ দিনের ব্যবধানে ভ্যাক্সিনের ২টি ডোজ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সবগুলো ডোজ নিতে হবে না।
– কোনো রোগী যদি ভ্যাক্সিন নেবার ৫ বছর পরে আবার কুকুর দ্বারা আক্রান্ত হয়। সেক্ষেত্রে তাকে ভ্যাক্সিনের সবগুলো ডোজ নিতে হবে।

রাস্তর কোনো কুকুর বা বিড়াল যদি কামড় বা আঁচর দেয় তাহলে কি ভ্যাক্সিন দিতে হবে?
এক্ষেত্রে আঁচর দেওয়া সেই কুকুর বা বিড়াল জলাতঙ্ক রোগে ভুগছে কিনা সেটা মূল বিষয়। সেই কুকুর বা বিড়াল জলাতঙ্ক রোগে ভুগছে কিনা অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টা বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে রাস্তার সেই কুকুর বা বিড়ালকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেই কুকুর বা বিড়াল যদি ১০ দিনের মধ্যে মারা যায় তাহলে ধরে নেওয়া যাবে যে সে হয়তো জলাতঙ্কে আক্রান্ত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে অতদিন অপেক্ষা করা যাবে না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভ্যাক্সিন দেওয়া শুরু করতে হবে। তারপর সেই কুকুর বা বিড়ালকে পর্যবেক্ষণ করে যদি দেখা যায় যে ১০ দিন পরেও সেই কুকুর বা বিড়াল সুস্থ আছে সেক্ষেত্রে এই ১০ দিন সময়ের মাঝে জলাতঙ্কের ভ্যাক্সিনের যে কয়টি ডোজ সে পেয়েছে তা পাবার পর ভ্যাক্সিন এর বাকী ডোজগুলো দেওয়া বন্ধ করা যেতে পারে।

ইঁদুরের কামড়ে কি জলাতঙ্ক হতে পারে?
আমাদের দেশে বাসা-বাড়িতে যে ধরনের ইঁদুর পাওয়া যায় তার কামড়ে জলাতঙ্ক হবার সম্ভাবনা নেই। ইঁদুরের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগের ভ্যাক্সিন নেবার প্রয়োজন নেই।
[লেখক: এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য); সহকারি রেজিস্ট্রার, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।]

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *