জীবনবাদী কবি জীবনানন্দ দাশ

জীবনবাদী কবি জীবনানন্দ দাশ

গোলাম কবির
ধর্মকে ধ্বজা রেখেই মানুষ তার আত্মপ্রচার শুরু করেছে চারুশিল্প কবিতা সম্ভারে। আজও সে ধারা চলমান। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাক্ষ্য বহনকারী চর্যাপদও সে ধারার অনুসারী। এরই ফাঁকে জীবনের উল্লাস আজও আমাদের মোহিত করে।

উনিশ শতকে এলো জীবনের জোয়ার। মধুসূদন ধর্মের মোড়কে জীবনকে দেখার নতুনের অভিসারী হলেন। চলছিল তার ধারাবাহিকতা, মোটাদাগে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনের ধারাপাতে বাঙালি পাঠক হলেন বিমোহিত। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে জাঁকিয়ে বসল অতি আধুনিক কবিকুল। তাদের মধ্যে বিশুদ্ধ মানবভাবনার বাণী নিয়ে এলেন জীবনানন্দ দাশ। নামের সঙ্গে সৃষ্টির এমন যুগপৎ মিল আমার চোখে পড়েনি।

জীবনানন্দের অকাল তিরোধানের পর (১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর, রাত ১১টা ৩৫ মিনিট, শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতাল, কলকাতা)। তাঁকে নিয়ে তখনকার জীবনবাদী রসও মানুষ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘সাহিত্য ও সাহিত্যক’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় ‘বর্ষা আর নদীর কবি’। যদিও তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক…তারে তোমার বীণা যায় না যেন ভুলে, তোমার ফুলে ফুলে/মধুকরের গুঞ্জরণে বেদনা তার থাক।’ কেবল ঘোষণাই দেননি কবি, তিনি বসন্তবিহ্বল কবিও ছিলেন। একই সঙ্গে জীবনানন্দ দাশকে বলা হয়েছে হেমন্ত আর নদীর কবি হিসেবে। বাঙালির জীবন আর ধান কাটার মৌসুম হেমন্ত। হবে না কেন! বাঙালির প্রধান খাদ্য ধান, যা কিনা নিরবধি ক্ষুধা নিবারক। জীবনানন্দ তাইতো এই নিবারণকারীকে সম্মান দিয়ে বলেছিলেন, ‘সৌন্দর্য রাখিছে হাত ক্ষুধার বিবরে’।

জীবনানন্দ দাশ আমাদের পথ দেখিয়েছেন ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ আর ‘রূপসী বাংলা’র রচনাবলি থেকে। কবিতার ইতিহাসে এমন আন্তরিক আবাহন খুব বেশি নেই। আশ্চর্যের বিষয়, সেই হেমন্তের দিনে বাংলার প্রকৃতিপ্রেমিক কবিকে ‘কল্লোলিনী কলকাতা’য় অকালে প্রাণ দিতে হলো। রবীন্দ্রনাথের হেমন্ত স্মরণ আজও আমাদের কাছে অভিনব হয়ে আছে। তিনি এই ঋতুকে বলেছিলেন, ‘হেমন্তলক্ষ্মী’। বলেছিলেন, ‘নমো, নমো, নমো। তুমি ক্ষুধার্তজন শরণং। অমৃত অন্ন-ভোগধন্য করো অন্তর মত্র।’ এই ছিল পূর্ব বাংলার সৃষ্টিশীল দিনগুলোতে অবস্থানের প্রভাব। জীবনানন্দের হেমন্ত ছিল প্রাণের প্রতীক। জীবনের প্রভাতবেলায় তিনি দেখেছেন দক্ষিণ বাংলার প্রকৃতিকে। যাকে তিনি কল্পনেত্রে নয়, জীবন নাট্যে প্রতি প্রহরে উজ্জীবিত করে রেখে গেছেন। তাই তিনি বলতে পেরেছেন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাইনা আর…।’ না, তিনি কৃত্রিম কোনো খোঁজায় হাত দেননি। নির্ভীক চিত্তে বলতে পেরেছেন ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িটির তীরে-এই বাংলায়।’

জীবনানন্দের জীবনকেন্দ্রিক কিছু কবিতা আমরা পড়ে দেখতে পারি। তাঁর কবিতা ধর্ম কিংবা মতবাদকেন্দ্রিক নয়, নিছক জীবনকেন্দ্রিক। যে জীবন শিকড় থেকে গজিয়ে উঠে আমাদের ছায়া পল্লবের আশ্রয়ে লালিত করেছে; ধর্ম বা মতবাদ তাঁর কবিতার বাহন হয়নি। তিনি কবিতার পরিবেশকে বিশেষ কোনো ধর্মের জাঁতাকলে জুড়ে দিয়ে তাকে সাম্প্রদায়িক হওয়ার অবকাশ দেননি।
জীবনানন্দের তিরোধানের বছর আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। কবি ও কবিতা তেমন বুঝি না। এর প্রায় এক দশক পরে কলেজে ভর্তি হলাম (১৯৬৩) জীবনানন্দের কবিতা ছিল পাঠ্যতালিকায়। আমাদের কবিতা পাঠের চেনা পথের বাইরের এ কবিতা। কবিতার নাম ‘মৃত্যুর আগে’, কাব্য ‘ধূসর পান্ডুলিপি’। মনে হয়েছিল অদ্ভুত চিত্রলিপি। রবীন্দ্রনাথ তাই বোধ করি তাঁর কবিতা পড়ে লিখেছিলেন জীবনানন্দের কবিতা ‘চিত্ররূপময়’! এর চেয়ে উত্তম পরিচিতি আমার অজ্ঞাত। তখন থেকেই তাঁকে নিয়ে একটা নতুন ভাবনার দ্বার উদঘাটিত হয় আমার মননে।

জীবনানন্দের বন্ধুর সংখ্যা বেশি ছিল না! ছিলেন নিভৃতচারী। ফলে কেউ কেউ তাঁকে নির্জনতার কবিও বলেছেন। এটা সুবিচার নয়। বুনো ফুল পথে-প্রান্তরে ফোটে, যাঁরা সন্ধান পান, তাঁরা তার সুবাসে লুটিয়ে পড়েন। দুঃখের বিষ, নগদপ্রাপ্তির ফাঁকফোকর নেই, পন্ডিতরা সেদিকে চেয়ে দেখেন না। জীবনানন্দের কবিতা কথনের নতুন বাগভঙ্গি আমরা অনুধাবন করি না বলেই সেদিকে আমরা ঝুঁকি না। জীবনানন্দ বুঝতেন, আমাদের বিমুখতা। তিনি এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। কেবল মৃদুস্বরে বলেছেন: ‘এখন চৈত্রের দিন নিভে আসে;/এখানে মাঠের পরে শুয়ে আছি ঘাসে;/এসে শেষ হয়ে যায় মানুষের ইচ্ছা কাজ/পৃথিবীর পথে,/দু-চারটে বড়ো জোর একশো শরতে।’ ‘আছে’, বেলা অবেলা কালবেলা।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *