নজরুল ও তার মৃত্যুভাবনা

নজরুল ও তার মৃত্যুভাবনা

লীনা তাপসী খান
কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুভাবনার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। প্রায় ৪০ বছর যাবৎ সরাসরি নজরুলসংগীত সাধনা ও চর্চাকে অবলম্বন করে পথচলা আমার। তারই আলোকে নজরুলের গান করি আর তার ভাবনাগুলোকে আবিষ্কার করার সুযোগ খুঁজে বেড়াই, কখনো খুঁজে পাই, কখনো পাই না। কাজী নজরুলের গানে মৃত্যুভাবনাকে খুঁজতে গেলে তার জীবন-পরিক্রমাটি একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন। কী বৈচিত্র্যময় জীবন! ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম। মাত্র ১৮ বছরে সেনাবাহিনীতে যোগদান। তখন থেকেই সাহিত্যে প্রবেশ। ১৯২০-এ তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞ। যদিও গদ্যসাহিত্য দিয়েই নজরুলের সৃষ্টি শুরু, তবে তিনি সাহিত্য থেকে সরে গিয়েছিলেন সচেতনভাবেই। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমি বর্তমানে সাহিত্যের সেবা থেকে, দেশের সেবা থেকে, কওমের খিদমত থেকে অবসর গ্রহণ করে সংগীতের প্রশান্ত সাগরদ্বীপে স্বেচ্ছায় নির্বাসনদন্ড গ্রহণ করেছি।

কবি যখন সম্পূর্ণরূপে সংগীতে আত্মনিমগ্ন তখন তিনি তার আত্মোপলব্ধি থেকেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, গুরুদেব! বহুদিন শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষী হিজ মাস্টার্স ভয়েজের কুকুরের ভয়ে আমায় ত্যাগ করেছে বহুদিন। কাজেই সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি। আরো কয়েকবারই কাজী নজরুল সাহিত্যলোক থেকে নির্বাসনের বিষয়ে তার আত্মভিমান বা বিষাদের আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু তার কোনো সঠিক কারণ তিনি উল্লেখ করেননি। জ্ঞানী-গুণীরা নিজের অবস্থানকে উপলব্ধি করতে পারেন অতি সহজেই হয়তো নজরুল গল্প-উপন্যাসের চেয়ে কবিতা ও গান রচনায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তবে তার শুরুটা তো লেটো গান দিয়েই মাত্র ১১ বছর বয়সে, জীবিকার প্রয়োজনেই হোক আর নাই-বা হোক। পালা রচনা করা, গান বাঁধা, আসরে দাঁড়িয়ে দল পরিচালনা করা-এসব চাচা বজলে করিমের কাছে তার ভালোই শেখা হয়েছিল।

তার প্রতিভার উন্মেষ তখনই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি সেনাবাহিনী থেকে ফিরে এসে কাব্য ও সংগীতে আত্মনিয়োগ করেন এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে অতি দ্রুত। যদিও সে যুগে শুধু বেতার, মঞ্চ এবং গ্রামোফোন ছাড়া সংগীতকে ছড়িয়ে দেওয়ার আর কোনো বাহন ছিল না। নজরুলের জন্য তাই-ই ছিল যথেষ্ট। কাজী নজরুলের সংগীত সৃষ্টির শুরু দেশমাতার গান দিয়ে। স্বদেশিকতা নজরুলকে সংগীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, শাসন শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নজরুলের জাগরণী গান হয়ে ওঠে প্রতিটি মানুষের প্রাণের কথা। ফলে তিনি অতি দ্রুত সকলের মনে ঠাঁই করে নেন।

এসব রচনা এতটাই সাড়া জাগিয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার তার পেছনে লোক নিযুক্ত করলেন এবং তার সব রচনা ইংরেজিতে অনুবাদ করাতেন। ইংরেজ সরকার তাকে প্রতিপক্ষ ভেবে এক বছর জেলে বন্দি করেছিলেন। নজরুল সেখানে ৩৯ দিন অনশন করেন এবং তার এই তীব্র প্রতিবাদে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাসসহ অনেকেই তাকে শিরে ধারণ করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে টেলিগ্রাম করেন।

তিনি লেখেন: নজরুলের ব্যাপ্তি আরো বিস্তৃৃত হয় আর তার সৃষ্টি চলে ফল্গুধারার মতো। মঞ্চ, নাটক, চলচ্চিত্র, আধুনিক গান, রাগসৃষ্টি, রাগপ্রধান গান, গজল, ঠুমরি, লোকজ-কী নেই তার। এই সবই কিন্তু ১৯২০ থেকে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ ২২ বছরের ফসল। তার সুস্থাবস্থার সময়সীমাকে যদি তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে বিভাজন করা হয়, তবে হিসাব মিলবে না; এটি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার একটি তাৎক্ষণিক ধূমকেতুস্বরূপ। এক অপরিসীম ক্ষমতা নিয়ে মাত্র ২২ বছরেই ফুরিয়ে গেল। ‘আমি যখন রইবো না গো, লইবো চির বিদায়’ গানটি কবি ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করে শিল্পী জ্ঞানদত্তকে দিয়ে মেগাফোন কোম্পানিতে রেকর্ড করান।

কবি বলেছেন, ‘জীবনে যাকে চাও তাকে আজ ঘুমাতে দাও। তার সমাধি পরে ফুল দিতে এসে তাকে জাগিও না। অনাদরে যে ফুল ঝরে গেছে তাকে নয়নের জলে বাঁচানোর চেষ্টা কোরো না। জীবনের সকল সাধ-আশা সমাধির মাটিতে মিশে গেছে।’ শেষাংশে কবি লিখেছেন, ‘সমাধি পাষাণ নহে গো-তোমার সমান কঠোর’ অর্থাৎ কবি সমাধির কাঠিন্যকে, পাষন্ডতাকে কবি প্রিয়ার পাষাণত্বের চেয়েও কম বলে ব্যক্ত করেছেন।
মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ।
অনন্ত আনন্দ হাসি অফুরান।।
নিরাশার বিবর হ’তে আয় রে বাহির পথে,
দেখ্ নিত্য সেথায়-আলোকের অভিযান।।
ভিতর হ’তে দ্বার বন্ধ ক’রে, জীবন থাকিতে কে আছিস্ ম’রে।
ঘুমে যারা অচেতন দেখে রাতে কু-স্বপন,
প্রভাতে ভয়ের নিশি হয় অবসান।।

কবি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে গানটি রচনা করেছিলেন। তার বয়স তখন মাত্র ৪০ বছর। জীবনের কঠিন ও রূঢ সত্য মৃত্যুর মধ্যে তিনি এক প্রাণ সঞ্চার করেছেন এই গানে। মৃত্যুর মধ্যে তিনি অনন্ত অফুরান আনন্দ হাসি গানের সন্ধান পেয়েছেন। অর্থাৎ অফুরন্ত মৃত্যুকে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছেন। নিরাশার বিবর্ণ রূপের মধ্যে পেয়েছেন আলোকের অভিযানকে। মৃত্যুর ভয়ে জীবন থাকিতে মরে না-থাকার আহ্বান, ঘুমে অচেতন হয়ে রাতে কুস্বপ্নের আচ্ছন্ন না থেকে প্রাণ সঞ্চারিত করার এক দৃঢ প্রত্যয় এই গানে ফুটে উঠেছে। লক্ষণীয় যে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নজরুল ৪০ বছরেই মৃত্যুভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠেন। মৃত্যুকে তিনি তখনই জয় করে নিয়েছিলেন।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *