পরিবারে নারীর সম্মান ও মর্যাদা

পরিবারে নারীর সম্মান ও মর্যাদা

নারী ডেস্ক: গৃহিনী হোন বা পেশাজীবী, অসহায় বা আপাতত সফল হোন না কেন, নারীর জীবনের নেপথ্যেই রয়েছে একটা অজানা অধ্যায়। কারণ, কোনো না কোনোভাবে (বিবাহিত বা অবিবাহিত) কারো না কারো দ্বারা নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহে সুখ-দুঃখের সমীকরণের অনুপাত পক্ষপাতদুষ্টতায় ভরা।

মেধা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পাড়ি দিতে হয় সমস্যাসংকুল পথ। বাইরে চাকচিক্যময় পোশাক-পরিচ্ছদ আর আপাতত সুখের অন্তরালে ভোগ করতে হচ্ছে বঞ্চনা ও নিগ্রহ। তবু অনেক সহনশীল নারী মা-বাবা তথা সমাজকেও বুঝতে দেয় না। নিখুঁত অভিনয় নৈপুণ্য প্রদর্শনে নিজেকে তুলে ধরে মানুষের কাছে। কারণ সংসার টিকিয়ে রাখতে এবং আত্মসম্মান সমুন্নত রাখতে অভিনয়ই মোক্ষম অস্ত্র। যেহেতু আবহমান কাল থেকেই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত নারী অবলা, দুর্বল ক্রমবর্ধমান এই দৃষ্টিভঙ্গি কখনো-কখনো সামাজিক অবক্ষয়ে রূপ নেয়। এতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে নারীর ওপর। এর ফলে সম্পদ, এমনকি তার নিজের এবং সন্তানের ওপরও নারীর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সারা জীবনই তাই নারীকে পুরুষ স্বজনদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। তাতেও সমস্যা নেই, যদি ন্যায্য অধিকার ভোগে এতটা বাধ্যতামূলক স্বঘোষিত আইন প্রয়োগ করা না হতো। এমনিতেই নারীরা সমাজে এখনো মানুষ হিসেবে মর্যাদা পায়নি। যেটুকু অবস্থান আছে, তা কেবল সহানুভূতিনির্ভর।

সংসারে নারী-পুরুষ একজন আরেক জনের পরিপূরক। যে পরিবারে নারীর সম্মান নেই, সেই পরিবারে কখনো সুখ-শান্তি আসতে পারে না। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, সমাজে এখনো প্রচলিত ধ্যান-ধারণা-ছেলে আপন, মেয়ে পর। এখনো কেউ কেউ মনে করেন, নারী সব পাপের উৎস। নারীরা পাপের পথে পা বাড়ায় কেন? এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান লেখক সমরেশ মজুমদারের কথাগুলো প্রণিধানযোগ্য। তিনি তার ‘মেয়েরা যেমন হয়’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘কোনো মেয়েই খারাপ হয় না। পুরুষেরাই তাদের খারাপ করে। কিন্তু খারাপ হয়ে যাওয়ার পর তারা আর ভালো হতে চায় না, এই যা মুশকিল?’ কেন ভালো হতে চায় না? কারণ, এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত মেয়ের কেউ কেউ ধর্ষিত হয়ে লাশ হয়ে ফেরে। কেউ ফিরে এলেও ঐ মেয়েকে সমাজপতিরা নষ্টা-ভ্রষ্টা মেয়ে বলে সমাজচ্যুত করে। এমনকি নারী হয়েও নারীরা নারীদের ছিঃ ছিঃ করে। তাই তো ফরাসি দার্শনিক সিমন দ্য বোভায়ার বলে গেছেন, পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় নারীও বিচার করে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। নিজের চোখে পৃথিবীকে দেখতে তারা অভ্যস্ত হতে পারছে না।’

প্রেম মানুষের জীবনে এক শাশ্বত সত্য। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর পরস্পর বোঝাপড়া থেকে গড়ে ওঠে প্রেম। শুরুটায় নারীপ্রেমে গদগদ প্রেমিক পুরুষটি শেষমেশ প্রতারণার আশ্রয় নেয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। প্রেমিকার ওপরে দোষ চাপিয়ে সটকে পড়ে। মূলত এক্ষেত্রে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করে সমাজের সবাই। ডিভোর্সি মেয়েদের অবিবাহিত ছেলে বিয়ে করলে সমাজে তুখোর সমালোচনার ঝোড়ো তাণ্ডব শুরু হয়। ঐ ছেলেকেও সমাজে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখে। কারণ, সে তালাকপ্রাপ্ত নারীকে বিয়ে করেছে। নারী যে শতভাগ নিষ্কলুষ তা নয়। গড়পড়তাভাবে নারীর দোষের পাল্লাটা ভারী বলে বিবেচিত হয় সনাতন চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত মানুষের কাছে। কোনো দিন শুনিনি পুরুষকে কেউ স্ত্রী পরিত্যক্ত বলেছে। পুরুষ পুনরায় বিয়ে করতে গেলে তারা অবিবাহিত মেয়ে বিয়ে করতেই আগ্রহী বেশি। কারণ, তাদের গায়ে ডিভোর্সি পুরুষের তকমা লাগানো হয় না। বড় জোর জামাইকে দোজবর বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়।
স্বামী ছাড়া স্ত্রী যেমন মা হতে পারে না, তেমনি পুরুষও স্ত্রী ছাড়া সন্তানের বাবা হতে পারে না। তাই নারী-পুরুষ দুজনের প্রয়োজন দুজনের কাছে সমান গুরুত্ব হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বংশ রক্ষায় পুত্রসন্তানের কামনা নারী-পুরুষ সবারই। তবে কন্যাসন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীর ওপর দায় বর্তায় কেন? ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। এতে কন্যাসন্তানের মায়েরাও নিগ্রহের শিকার হন প্রতিনিয়ত।

সমাজে কতশত নারী স্বামীর পরকীয়াকে জেনেশুনে মেনে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণা। মুখ খুললে ডিভোর্সের হুমকি দেয়। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদে নারীরা কাতরায়। অথচ মানুষের সামনে স্ত্রৈণ স্বামীর মতো সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে স্ত্রীর গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ। এতটুকু বাকস্বাধীনতা নেই অনেক মেয়ের। বিত্তশালী বাবার মেয়েরাও অনেকেই সহ্য করে যায়। তবে কিছু কিছু বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে বা স্বাবলম্বী স্ত্রীরা অনেকেই প্রতিবাদ করে। তখনই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ফলে স্বামী পরিত্যক্ত অনেক মেয়ে সিঙ্গেল মাদার তকমায় সন্তানদের নিয়ে কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করে। তাদের অন্তর্নিহিত কষ্ট আমাদের অনুধাবনে আসে না।
নারী আমাদের মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা। পুরুষও আমাদের জন্মদাতা পিতা, প্রাণপ্রিয় ভাই, প্রিয়তম স্বামী, সর্বোপরি পুত্র। কে আমাদের কাছে মূল্যহীন? বরং আমাদের কাছে তারা সবাই অমূল্য সম্পদ। অনেক বাবা কন্যাসন্তানদেরই বেশি ভালোবাসেন। ‘মা’ বলে ডেকে পরম তৃপ্তি পান। একজন মা-ও কিন্তু পুত্রকেই বেশি ভালোবাসেন, বাপধন বলে ডাকেন। তাদের বিহনে মেয়েদেরও কোনো মূল্য নেই। প্রতিটি সন্তানের কাছে তার বাবা একজন শ্রেষ্ঠ বাবা। মা-ও সন্তানের কাছে একজন শ্রেষ্ঠ মা। আসলে তাদের সম্পর্কে লিখতে আমারও খারাপ লাগছে এ কারণে যে, সব পুরুষই স্বৈরী নয় সব নারীই স্বৈরিণী নয়। তবে কেন সমাজের তথাকথিত একশ্রেণির মানুষ নারীর প্রতি এমন বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি লালন-ধারণ করে পেলেপুষে সমাজটাকে কলুষিত করছে?

আসুন, আমরা সবাই সবার প্রতি মানবিক হই। পুরুষদের যেমন সমাজে হেয় করা যাবে না, নারীদেরও নয়। তাদের ছাড়া মেয়েদেরই জীবনে যেমন কোনো মূল্য নেই, তেমনি নারীবিহীন পুরুষের জীবন মরুভূমির মতো ধূলিধূসরতায় এক শূন্যতার বসবাস। সুতরাং আমরা পরস্পর বোঝাপড়ায় সহনশীল হই। মানবিক হই। জীবন তো একটাই। একে আনন্দে ভরিয়ে তুলি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সুখের সংসার গড়ি। সন্তানদের মানুষ হিসেবে তৈরি করি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দিই। পরিবারে উভয়ের অবদান ও মর্যাদাকে মেনে নিই।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *