বাঙালি রেনেসাঁর ঈশ্বর

বাঙালি রেনেসাঁর ঈশ্বর

রাজিক হাসান
আমার বাবার ঠাকুমা বেঁচেছিলেন ১০২ বছর। এই দীর্ঘ জীবনলাভ তার জন্য যে কতটা দুঃসহ ছিল, তা বাবার মুখে তার গল্প শুনে বুঝতে পারি। তিনি বিধবা হন সতেরো বছর বয়সে। বৈধব্য যোগের সঙ্গে; সমস্ত আনন্দ-হাসি তার জীবন থেকে বিয়োগ হয়ে যায়। দীঘল চুল হয়ে যায় কদমছাঁট। বাড়িতে উৎসব-অনুষ্ঠান হলে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হতো সারা জীবন। বাড়িতে পেঁয়াজ-রসুন সহকারে রান্না বা কষিয়ে মাংস রান্না হলে, তিনি বারান্দার এককোণে লুকিয়ে কাঁদতেন। কখনো জোরে-জোরে খাবারের গন্ধ শুঁকতেন। এভাবেই নিজের স্বাদ-আহ্লাদ অবদমিত করতেন নানা উপায়ে। কোনো কামনা-বাসনাই যে মেটানোর উপায় ছিল না তার। তার বড় জারা সন্ধ্যার শুরুতেই জোর করে আফিম খাইয়ে দিত। একাদশী পূর্ণিমা অমাবস্যার মতো বিশেষ পালনীয় তিথির প্রত্যুষে বেশি করে আফিন খাইয়ে দেওয়া হতো তাকে। যাতে সারা দিন ক্ষুধা না পায়। বাড়িতে অধিক মেহমান আগমনীর দিনে তাকে আফিম খাইয়ে ঘরে বন্দি করে রাখা হতো। যাতে তার অপরূপ সৌন্দর্য সম্পর্কে কোনো পুরুষ অবগত না হয়। নারীর যে সবকিছুতেই দোষ! সুন্দরী হলেও দোষ; কুৎসিত হলেও তার দোষ। পুরুষের দৃষ্টির কখনো কোনো দাষ নেই। তার নাম ছিল মাধবী রানী পাল। সমস্ত গল্পটাই আমার পরলোকগত বাবার মুখ থেকে শোনা। গল্পগুলো তার ঠাকুমা তাকে বলতেন মজার ছলে। মজাটা খুব ভারী হয়ে উঠলে তার চোখের কোণে জল চিকচিক করতে দেখত আমার বাবা ও অন্যান্যরা। তখন যেন তার সমস্ত জীবনের ব্যথাই জল হয়ে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ত। দুর্ভাগ্য ছিল যে, এই নাতবৌদের যুগেও মাধবী রানী তার আফিমের নেশা ত্যাগ করত পারেনি। ততদিনে আফিমের নেশা তাকে পুরোপুরিভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সন্ধ্যার আহারাদি সম্পন্ন হলেই তিনি দুধের সঙ্গে আফিমের একটি গুলি মিশিয়ে খেয়ে নিতেন। তারপর চলত নানা গপ্পো। এই গপ্পের মাঝেই তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন।

গল্পটি যখন শেষ হলো তখন চেয়ে দেখি আমার বৃদ্ধ শিক্ষকটির চোখ বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। তারই ঠাকুমার গল্প যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন সংস্কৃতি কলেজের প্রিন্সিপাল। সেই সময় বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে এমন বিধবার গল্প মেলে। ‘দেশের লোক কোনো শাস্ত্র মানিয়া চলে না, লোকাচার ইহাদের ধর্মও’- আজীবন এই ছিল বিদ্যাসাগরের ধারণা, তাই তিনি লোকাচার স্বরূপ কুসংস্কার থেকে ধর্মকে মুক্ত করতে গিয়ে সংশয়বাদী হয়ে ওঠেন।

১৮৫৩ সালের ঘটনা। বেলা ১১টা, হুগলীর দশঘরাতে এক অভিজাত বাড়ির ঘরের মধ্যে চলছে এক আলোচনা সভা। পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত। জলখাবারের আছে লুচি, ছোলার ডাল, নানা মিষ্টি। সুখাদ্যের সুঘ্রাণে ঘর মাতোয়ারা। আহার শেষে হবে আলোচনা। বিষয়বস্তু একটি মেয়েদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা মেয়েদের বাইরে আসতে দিতে নারাজ। বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। চলছে তারই প্রস্তুতি। এমন সময় একটি সাদা থান পরা ছোট্ট ৬/৭ বছরের মেয়ে দৌড়ে এলো ঘরে, ‘বাবা বাবা, মাকে বলো না, আমার খুব খিদে পেয়েছে। দাদারা লুচি খাচ্ছে, আর আমি চাইলেই মা বলছে, ছিঃ আজ একাদশী না। খাবার কথা বলতে নেই মা। কিন্তু বাবা, আমি সকাল থেকে কিচ্ছু খাইনি। একটু জল পর্যন্ত না। তুমি, মা, দাদারা কেউ একাদশী করো না। আমায় কেন করতে হবে! আমার বুঝি খিদে পায় না?

সকলের সামনে লজ্জায়, আর মেয়ের প্রতি মায়ায় করুণ হয়ে ওঠে গৃহকর্তার মুখ। আস্তে করে বলেন, এখানে সভা চলছে মা, তুমি ঘরে যাও। করুণ দৃষ্টিতে সকলের পাতের দিকে তাকিয়ে বিফল মুখে ভেতরের ঘরে ঢুকে যায় একরত্তি অভাগা মেয়েটি। তার পরেই রূপোর থালা বাটিতে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্য সুখাদ্য সাজিয়ে ঘরে আসে বামুন ঠাকুর। বিদ্যাসাগর বলেন শরীরটা ঠিক নেই, আমি খাব না কিছু। নিয়ে যাও।
শুরু হয় সভা। গ্রামে মানুষদের কাছে প্রথমেই বিদ্যাসাগর তুলে ধরেন নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। নারীশিক্ষা বিয়য়ে শ্লোকগুলি বলতে থাকেন একের পর এক। তীক্ষè যুক্তি, উদাহরণ আর বাগ্মীতার সামনে ভেঙে পড়ে সংস্কারের দেয়াল।

সকলে চলে যাবার পর গৃহকর্তাকে বিদ্যাসাগর বলেন, আমি নারীদের শিক্ষার জন্য ছুটছি, কিন্তু এই বিধবা নারীরা, তাদের দুঃখ, তাদের প্রতি এই ধর্মীয় অমানবিকতা এই দিকে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলাম আমি। ছিঃ ছিঃ, ভাবতেই আমার গ্লানি হচ্ছে। রামমোহন রায় মহাশয় তাদের বাঁচিয়ে ছিলেন জ্বলন্ত চিতা থেকে। কিন্তু ওরা মরছে, রোজ জ্বলছে খিদেয়, অবহেলায়, অমানবিকতায়। আপনার কন্যা আজ চোখ খুলে দিয়েছে।
শুরু হলো নতুন লড়াই। কলকাতার রক্ষণশীল দল, পুরোহিত সমাজ বিধবা বিবাহের ঘোর বিপক্ষে। তারা কিছুতেই মেনে নেবে না এই অনাচার। তারা পালটা আবেদন করেছে ব্রিটিশ সরকারের কাছে, ধর্মবিরোধী এই আইন চালু হলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে তারা।

জানুয়ারি, ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগরের ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বাংলার পথে-ঘাটে-সমাজে তীব্র আলোচনা শুরু হলো। পক্ষে মত কম না হলেও বিপক্ষে মত ধারে-ভারে অনেকটিই এগিয়ে। বিদ্যাসাগরের এই বই ও ভাবনার প্রতি শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব প্রথমে সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু পরে তিনি বিরুদ্ধবাদীদেরও ‘তুষ্ট’ করলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সোজাসুজিই লিখলেন, ‘বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল।/ বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।’ ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ একটি চিঠিতে পত্রলেখক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রীতিমতো নানা অশালীন ইঙ্গিত করলেন। দাশরথি রায় আর শান্তিপুরের তাঁতিরা দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগরের পক্ষে। ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি বুনলেন তাঁতিরা।

পাড়ে লেখা থাকল বিদ্যাসাগরের জয়গান, ‘সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে’। আর পালটা বাঙালি শুনল, ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে।’ এইসব কটাক্ষেও কিন্তু বিদ্যাসাগর অনড়। বড়লাটের দপ্তর বলেছে বেদ-পুরাণে কি কোনো উদাহরণ আছে পুনর্বিবাহের? না হলে আইন পাশ করা মুশকিল। রক্ষণশীলদের চটিয়ে কিছু করার ইচ্ছা নেই ডালহৌসির।

তাই রাতের পর রাত জেগে পুঁথিপত্র পড়ছেন তিনি। অবশেষে পাওয়া গেল সেই মুক্তো। পরাশর সংহিতার অমর সেই শ্লোক “নষ্টে মৃতে প্রবরজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ/পচস্বাপতসু নারীনাং পতিরন্যো বিধয়তে।” (স্বামী মারা গেলে, সন্ন্যাস নিলে, নিখোঁজ হলে, সন্তান গ্রহণে অক্ষম হলে, অধার্মিক ও অত্যাচারী হলে পত্নী আবার বিবাহ করতে পারে।)

তিনি ছুটলেন সরকারের দ্বারে। প্রমাণ করলেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। আর বাধা রইল না কিছুই। ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই পাশ হলো বিধবা বিবাহ আইন। কিন্তু প্রবল বিরুদ্ধবাদীরা ভাবলেন, আইনে কী বা হয়। কিন্তু সেই ধারণাও গুড়িয়ে গেল ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। আইনসম্মত প্রথম বিধবা বিবাহ হলো শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কালীমতী দেবীর। কিন্তু বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার ‘অপরাধে’ সমাজে একঘরে করা হলো বিদ্যাসাগরকে। পথে বেরোলেই জোটে গালমন্দ, ঠাট্টা, অশালীন ইঙ্গিত, খুনের হুমকি।

শুধু সমাজ নয়, বাঙালির বড় আপনজন, বড় গর্বের ব্যক্তিরও বিদ্যাসাগরকে বুঝতে সমস্যা হলো- ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের সূর্যমুখীকে দিয়ে বঙ্কিম লেখালেন, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পন্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পন্ডিত, তবে মূর্খ কে?’

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার তিনি ছিলেন একান্ত পক্ষপাতি। এজন্য বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের অযৌক্তিক নিয়মজাল থেকে মুক্ত করে নির্মেদ ও আধুনিক করে তোলাকে তিনি বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন। বর্ণপরিচয় গ্রন্থে তাঁর লিপিসংস্কারই পরবর্তীকালে বাংলা লিপির আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়। আজ পর্যন্ত এই লিপিই বাংলায় প্রচলিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্যাসাগরের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজির কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্রের প্রধান গৌরব তাহার অজেয় পৌরুষ, তাহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ তাঁর মৃত্যুতে কবিগুরু বলেছিলেন, ‘আশ্চর্যের বিষয়, কী করে ভগবান ৪ কেটি বাঙালির মধ্যে একটি মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন’।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *