বাণিজ্যে বিশেষ ট্রানজিট ভুটানকে

বাণিজ্যে বিশেষ ট্রানজিট ভুটানকে

বাণিজ্যে বিশেষ ট্রানজিট ভুটানকে

দেওয়ানবাগ ডেস্ক: পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নৌ, সমুদ্র এবং বিমানবন্দরের অবকাঠামো সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটান। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতিদাতা রাষ্ট্র এবং স্থলবেষ্টিত দেশ (ল্যান্ডলক কান্ট্রি) হওয়ার কারণে ভুটানকে বিশেষ ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, যার মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের জল-স্থল এবং আকাশপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে। এরই মধ্যে ভুটানকে বিশেষ ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানান, ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার জন্য খসড়া প্রটোকলে পাঁচটি সড়কপথ ও দুটি রেলপথের প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। এ ছাড়া নৌপথে ট্রানজিট সুবিধার জন্য নৌ মন্ত্রণালয়, রেল রুট ব্যবহারের জন্য রেল বিভাগের সঙ্গে ভুটানের প্রটোকল স্বাক্ষরিত হবে। এ জন্য দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি সই হবে তার শিরোনাম হচ্ছে ‘প্রটোকল অব দ্য এগ্রিমেন্ট অন দ্য মুভমেন্ট অব ট্রাফিক ইন ট্রানজিট বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ভুটান।

কর্মকর্তারা জানান, ভুটানকে এই ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতের চেয়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। ৮ লাখ জনসংখ্যার ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে খুব বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে না। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যও খুবই কম। তবে এই সুবিধা পরবর্তীতে ভারত, নেপালসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে কানেকটিভিটি বাড়াতে সহায়তা করবে বলে মনে করছে সরকার।

সূত্র জানায়, আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে যে চারদেশীয় পণ্য এবং যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল চুক্তি (বিবিআইএন) এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, ভুটান তার অনুমোদন দেয়নি। মাত্র ৮ লাখ জনসংখ্যার দেশটি চার দেশের গাড়ির চাপ সামলাতে পারবে না বলে তারা বিবিআইএন থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতিদাতা রাষ্ট্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বিবেচনায় ভুটানকে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থলপথ, রেল, নৌ, বিমান এবং সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামো ব্যবহারে সম্মতি দেন।

যে পাঁচ রুট ব্যবহার করে বাণিজ্য করবে ভুটান: গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় দুই দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে তৃতীয় দেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ভুটানকে বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে ট্রানজিট চুক্তির খসড়া ও প্রটোকল চূড়ান্ত করা হয়। এরপর সেটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়। খসড়া প্রটোকল অনুযায়ী সড়কপথে পণ্য পরিবহনের জন্য বাছাইকৃত রুটগুলো হচ্ছে: ১. (ভুটান থেকে পণ্য নিয়ে) সামসি/গোমটু/ফুয়েন্টসলিং/গেলেপু-বুড়িমারী-রংপুর-বগুড়া-হাটিকুমরুল-ঢাকা-চট্টগ্রাম; ২. সামসি/ গোমটু/ফুয়েন্টসলিং/গেলেপু-ফুলবাড়ী-বাংলাবান্ধা-রংপুর-বগুড়া-হাটিকুমরুল-ঢাকা-চট্টগ্রাম; ৩. গেলেপু-তামাবিল-সিলেট-ঢাকা; ৪. গেলেপু-সামদ্রুপ-জংখর-তামাবিল-সিলেট-সরাইল-ঢাকা-বেনাপোল এবং ৫. সামসি/গোমটু/ফুয়েন্টসলিং/ গেলেপু-নাকুগাঁও নালিতাবাড়ী-ময়মনসিংহ-ঢাকা।

সড়কপথে এই পাঁচটি রুট ছাড়াও রেলপথে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানির জন্য আরও দুটি রেল রুট যুক্ত করা হয়েছে খসড়া প্রটোকলে।

এই রুটগুলো হচ্ছে: ১. সামসি/গোমটু/ফুয়েন্টসলিং/গেলেপু-চিলাহাটি-সৈয়দপুর-পার্বতীপুর-সান্তাহার-ঈশ্বরদী-ভেড়ামারা-যশোর-নওয়াপাড়া-খুলনা-মোংলা; ২. চট্টগ্রাম-লাকসাম-কুমিল্লা-আখাউড়া-ঢাকা-সিরাজগঞ্জ-বগুড়া-লালমনিরহাট-বুড়িমারী- সামসি/ গোমটু/ফুয়েন্টসলিং/গেলেপু।

সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত রুটগুলোতে পণ্য পরিবহনের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে ভুটানের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছে। যে রুটগুলো প্রটোকলে উল্লেখ আছে, প্রতিনিধি দল সেই রুটগুলো ব্যবহার করে ভারত হয়ে স্থলপথে বাংলাদেশে পৌঁছায়। এ সময় তারা বাংলাদেশের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং হলদিবাড়ি-চিলাহাটির রেল প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল প্রকল্পের পরিচালক আবদুর রহিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভুটানের প্রতিনিধি দল ৩১ অক্টোবর থেকে পরবর্তী ১০ দিন ভারত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। চিলাহাটি রেল রুট ব্যবহারের বিষয়ে আমরা তাদের সামনে একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেছি। তারা আমাদের প্রস্তাবে খুব খুশি। আবদুর রহিম বলেন, বর্তমানে চিলাহাটি রেল রুট ব্যবহার করে খুলনা পর্যন্ত পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারবে ভুটান।

আগামী ছয় মাসের মধ্যে মোংলা বন্দরের সঙ্গে এই রুটের সংযোগ তৈরির পর সরাসরি রেল রুটে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে তারা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনার সুযোগ পাবে। এ রটটি ভারতে হাসিমারা নামক স্টেশন পর্যন্ত যাবে, যেখান থেকে ভুটানের সীমান্ত মাত্র ১০ কিলোমিটার। এ ছাড়া যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু চালু হওয়ার পর ওই রেলপথ ব্যবহার করে ভুটান ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত পণ্য পরিবহন সুবিধা পাবে। কর্মকর্তারা জানান, তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য ভুটানের গাড়িগুলো পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশের বিমান ও সমুদ্রবন্দরে যাবে। এরপর এসব পণ্য বহির্বিশ্বে পাঠানো হবে।

বাংলাদেশের ওই একই অবকাঠামো ব্যবহার করে আবার আমদানি করা পণ্য ভুটানে পরিবহন হবে। এক্ষেত্রে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করবে ভুটান। এ ছাড়া আকাশপথে পণ্য পরিবহনের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। এসব বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে এমন সড়ক, রেলপথ ও নৌপথ খসড়া প্রটোকলে যুক্ত রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং আকাশপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযোগ রেখে এই রুটগুলো প্রটোকলে যুক্ত করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের অবকাঠামো ব্যবহার করে ভুটান যাতে কলকাতার সমুদ্র ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারে প্রটোকলে সেই সুবিধাও রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৩ নম্বর রুটে ভুটানের গেলেপু থেকে সিলেটের তামাবিল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ঢাকা হয়ে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে বেনাপোল দিয়ে কলকাতায় যেতে পারবে ভুটানের পণ্য। একই পথে আবার কলকাতা থেকেও আমদানি পণ্য ভুটানে পরিবহনের সুযোগ থাকছে।

লোকসানে ৭০ শতাংশ পোলট্রি খামার বন্ধ
রাজশাহী সংবাদদাতা: পোলট্রি খাবারের দাম বাড়লেও তুলনামূলক বাড়েনি মুরগি ও ডিমের দাম। বিক্রির টাকায় উঠছে না উৎপাদন খরচও। এতে লোকসানে পড়েছেন রাজশাহীর ক্ষুদ্র খামারিরা। ফলে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন পোলট্রি খামারিরা। অন্যদিকে দফায় দফায় মুরগি ও ডিমের দাম বাড়লেও মধ্যস্বত্বভোগী আর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এর সুফল পাচ্ছেন না ক্ষুদ্র খামারিরা। রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাজার পরিস্থিতিতে বর্তমানে মুরগির চাহিদা কম থাকায় বাজার দর পড়ে গেছে। ফলে ক্ষুদ্র খামারিরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। এ অবস্থায় রাজশাহীতে প্রায় ৭০ শতাংশ পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ৩ দশক আগে ১ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে মুরগির খামার গড়ে তোলেন রাজশাহী নগরীর হেতেম খাঁ এলাকার শফিকুল ইসলাম। দুই দশক ভালোভাবে চললেও বিপত্তি বাধে ২০১২ সালের পর থেকে। কিন্তু বড় ধাক্কা খেয়েছেন করোনার প্রথম বছরেই। ১৬ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে গুটিয়ে নিয়েছেন ব্যবসা। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় পরের বছর ৩ হাজার লেয়ার মুরগি পালন করেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই লাভের মুখ দেখতে পারছিলেন না। খাবারের দাম বাড়ার কারণে দিন দিন আশাহত হয়েছেন তিনি। শফিকুল বলেন, খুচরা বাজারে দাম থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে একের পর এক লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ বছর ব্রয়লার মুরগি না থাকলেও ডিম বিক্রি করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। এ খামারি আরও বলেন, গত তিন বছরে ১৬ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ব্রয়লার পালন ছেড়েছি। একটা ৯ লাখ টাকার শেড পড়ে আছে। পোলট্রি সেক্টর ঝুঁকির সম্মুখীন। বলা যায়, খামারিরা পথে বসেছেন। ডিমের উৎপাদন খরচ এখন ১০ টাকা আর বিক্রি হচ্ছে ৭ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ৫০ টাকা পিস কিনে কেজিতে ৯০ টাকা করে ১২০ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়। ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বাগমারা উপজেলার দামনাশ এলাকার লেয়ার খামারি হাসানুল ইসলাম বলেন, খাদ্যের দাম অনেকটা বেড়েছে। ১৬০০ টাকার খাবারের বস্তা এখন ৩৪০০ টাকা। পাইকারি ডিমের দাম ১২ টাকা পিস হলে লাভ হবে। এ ছাড়া ব্যবসা ছাড়তে হবে। এ বছর দেখব, এরপর খামার ব্যবসা ছেড়ে অন্য কিছু করব। পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের আলেয়া বেগম বলেন, খামারে যে পরিশ্রম করতে হয় তাতে লাভের কোনো আলোচনা করা যাবে না। ৬০ দিনে সোনালি মুরগি বিক্রির উপযোগী হয়। আমার খামারের মুরগি বিক্রির উপযোগী হয়ে গেছে।

পাইকাররা প্রতি কেজি মুরগি ১৯০ টাকা দর করছেন, যেখানে আমার খরচ পড়েছে ২৩০ টাকা। হিসাব করে দেখেছি, এ পর্যায়ে মুরগি বিক্রি করলে মোটা অঙ্কের লোকসান যাবে। কিছু করার উপায় নেই, বিক্রি করতে হবে। লোকসান একবার যায় আবার আরেক চালানে কিছু লাভ আসে। সেটা দিয়ে আবার খামার চালু রাখি। এভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছি। খাদ্যের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। ফলে খামারিরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।

রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, রাজশাহীর ৭০ শতাংশ খামার বন্ধ। বহুবার বলেছি বিভিন্ন জায়গায়। কোনো কাজ হয় না। পোলট্রি খাবারের বর্তমান দাম খামার চালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত নয়। ডিমের দাম উৎপাদন খরচের তুলনায় কম। প্রতি পিস ডিমে ৩ টাকা লোকসান দিচ্ছেন খামারিরা। খাদ্যের দাম কমানো, প্রণোদনার ব্যবস্থা করা, সঠিক বাজার নির্ধারণ এখন জরুরি প্রয়োজন। তা না হলে পোল্ট্রি খাত টিকবে না।

রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, ডিম ও মুরগির দাম ওঠানামা হয়। লাভের বিষয়টা আসে খামার ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগের পরিমাণসহ নানা বিষয়ের ওপর। এর আগে ডিমের দাম কমে যাওয়ার কারণে খামারিরা স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। প্রাণিসম্পদ দফতর বিষয়টি দেখছে।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *