মহাকবি ফেরদৌসি

মহাকবি ফেরদৌসি

তানভীর আহমেদ

মহাকাব্য শাহনামার রচয়িতা ফেরদৌসি। বিশ্ব তাকে চেনে ফারসি মহাকবির পরিচয়ে। তার পুরো নাম হাকিম আবুল কাসেম ফেরদৌসি তুসি। উত্তর-পূর্ব ইরানের তুস শহরের কাছে পাজ গ্রামে তার জন্ম।  শুরুতেই মহাকাব্য শাহনামার কথা জানা যাক। ৯৭৭-এর দিকে  ফেরদৌসি এটি লেখার কাজ শুরু করেন। এই মহাকাব্যে তিনি ইরানের বিভিন্ন শাসক ও শাহদের কাহিনি তুলে এনেছেন। প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃৃতি উঠে এসেছে এ মহাকাব্যে। কথিত আছে, শাহনামা লেখার সময় সুলতান মাহমুদ ফেরদৌসিকে বলেন, ‘মহাকাব্যে যতগুলো শব্দ থাকবে, প্রত্যেক শব্দের জন্য একটি করে স্বর্ণ মুদ্রা দেওয়া হবে।’ প্রায় ৩৩ বছর ধরে এই মহাকাব্য রচনা করেছিলেন ফেরদৌসি। এখানে রয়েছে ৬০ হাজার শ্লোক। আছে ৯৯০টি অধ্যায়, ৬২টি কাহিনি।

গ্রিক মহাকবি হোমারের ইলিয়াডের সঙ্গে এর তুলনা করলে আকারে শাহনামা ইলিয়াডের চেয়ে সাতগুণ বড়ো। ফেরদৌসির  শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। যতটুক তথ্য গবেষকরা তুলে এনেছেন সেগুলো সুবিন্যস্ত নয়। গবেষকদের কেউ কেউ তার শৈশবের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, তার পিতা মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফশাহ তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। আবুল কাশেমের বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। মৃত্যুর সময় তিনি সন্তানের জন্য অনেক জমি জায়গা রেখে গিয়েছিলেন। আবুল কাশেম প্রতি বছর এসব জায়গা জমি থেকে ভালো আয় করতেন। তবে ভোগবিলাসে তিনি জীবন কাটাননি। তরুণ বয়সেই তিনি কবিতা লেখায় মগ্ন হন। ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি দেশ-বিদেশের জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন। তাছাড়া দরবারে দেশ-বিদেশের কবিদের কবিতা আবৃত্তির আসর হতো। কিন্তু সুলতানের রাজদরবারে প্রবেশে মোটেও সহজ ছিল না। সুলতান মাহমুদের উজির মোহেক বাহাদুরের সহযোগিতায় তিনি রাজদরবারে প্রবেশ করতে সক্ষম হন বলে কেউ কেউ দাবি করেন। সুলতানের সামনে প্রথম পরিচয়ে আবুল কাশেম তার লেখা কয়েকটি কবিতা পাঠ করেন। প্রথম সাক্ষাতেই সুলতান কবির আবৃত্তি ও কয়েকটি কবিতা শুনে অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং এ বলে কবিকে সংবর্ধনা করলেন, ‘হে ফেরদৌসি, তুমি সত্যিই আমার দরবারকে যেন বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছ।’ সুলতান মাহমুদ আবুল কাশেমের কবিতা শুনে তিনি তাকে ‘ফেরদৌসি’ উপাধি দিলেন। সেই থেকে আবুল কাশেম নামটিকে ছাপিয়ে গেল ফেরদৌসি। গজনির সুলতান মাহমুদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন এই সাহিত্যচর্চার গুণে।  তার জায়গা হলো রাজদরবারে। সুলতান কবির জন্য আলাদা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সুলতান মাহমুদই কবির শাহনামা মহাকাব্য রচনা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ফেরদৌসি সেকথা রেখেছিলেন। শাহনামা কাব্য রচনা শেষ হয় হিজরি ৩৯৩ সনে। সুলতান কথা দিয়েছিলেন, মহাকাব্যে যতগুলো শব্দ থাকবে, প্রত্যেক শব্দের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে। বলা হয়ে থাকে, রাজদরবারের কতিপয় ষড়যন্ত্রকারীর কুমন্ত্রণা শুনে সেই প্রতিশ্রুতি রাখেননি সুলতান। তার প্রতিশ্রুতি ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্য মুদ্রা মতান্তরে ৬০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন। কবি ফেরদৌসির অর্থ লোভ ছিল না। কিন্তু সুলতানের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ঘটনায় তিনি দুঃখ পেলেন ও রাজদরবার ত্যাগ করেন। এক সময় সুলতান ষড়যন্ত্রকারীদের চাল বুঝতে পেরেছিলেন।  সুলতান কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রাসহ ইরানের তুস নগরীতে কবির বাড়িতে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু দূত যখন স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যান তখন কবি পৃথিবীতে বেঁচে নেই। কবি ফেরদৌসি ১০২০ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *