২০২২ ছিল অর্থনীতির জন্য উদ্বেগ ও চাপের বছর

২০২২ ছিল অর্থনীতির জন্য উদ্বেগ ও চাপের বছর

বাণিজ্য ডেস্ক: বিদায়ী ২০২২ সালের প্রথম কার্যদিবসে আন্তঃব্যাংক ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। গত ২৮ ডিসেম্বর বছরের শেষ কার্যদিবসে তা ১০৭ টাকা পর্যন্তও উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এত অল্প সময়ে বাংলাদেশী মুদ্রার এত বড় মাত্রায় অবমূল্যায়নের আর কোনো নজির নেই।

মুদ্রাবাজারের মতো প্রায় প্রতিটি খাতেই ২০২২ সালে বড় ধরনের নিম্নমুখী চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতেই সংশ্লিষ্টদের জন্য গোটা বছর কেটেছে ব্যাপক উদ্বেগ ও চাপের মধ্যে। কভিডের অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির ধস গোটা বিশ্বের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ দুশ্চিন্তা রূপ নিয়েছিল অর্থনীতির নানামুখী বিপদের চেহারায়।
বছর শেষ হওয়ার আগেই রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে। সংকট মোকাবেলায় লাগাম টেনেও হ্রাস করা যায়নি আমদানির পরিমাণ, বরং তা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৫৯ কোটি ডলারে। যেখানে আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৯১৬ কোটি ডলার। একই সময়ে বেড়েছে চলতি হিসাব ও ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অক্টোবর শেষে দেশে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ডলারে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৮৩ কোটি ডলার। একই সঙ্গে বড় হয়েছে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও। অক্টোবর শেষে দেশে লেনদেনের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮৭ কোটি ডলারে, যা গত বছর একই সময় ছিল প্রায় ১৩৪ কোটি ডলার।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শিল্প, কৃষি, জ্বালানিসহ অর্থনীতির উৎপাদনশীল-অনুৎপাদনশীল প্রায় সব খাতই বছরজুড়ে কমবেশি উদ্বেগের মধ্যে পার করেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২২ সালকে কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক বছর হিসেবে দেখা যাচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই এ বছরটা খারাপ গিয়েছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে কতগুলো জায়গায় আমরা ভিন্ন। আমাদের সংকটের গভীরতা বেশি ছিল, ব্যাপ্তিও ছিল বেশি। তার কারণ হলো আমাদের অর্থনীতির অভিঘাত সহনশীলতা তুলনামূলক কম। সঙ্গে কিছু নীতিগত ব্যর্থতাও রয়েছে। বিশেষত টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হারের কথা উল্লেখ করা যায়। একবারে অনেক বেশি অবনমন হয়েছে। এ কারণে জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে বেশি। পর্যায়ক্রমে এটি করা হলে আরেকটু ভালো হয়তো থাকতে পারতাম। নীতিগত ব্যর্থতার কারণেই বিনিময় হার ও ডলারের সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছি না। এ সংকট এখনো বিরাজ করছে। বিদেশী ঋণ আছে। আমদানির জন্যও প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা। ডলার সংকটে বেসরকারি খাত এলসি খুলতে পারছে না। এসব মিলিয়ে আগামী বছর আমাদের ভুগতে হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাত নিয়ে যে সমস্যা তা আমাদের অভ্যন্তরীণ। এর সঙ্গে বৈশ্বিক সংকটের যোগসূত্র নেই। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে আগামীতেও খাতটির এসব সমস্যা থেকে যাবে। সুদহার কম হওয়ায় ডলারের উচ্চমূল্যের চাপ কাটিয়ে উঠতে পারতাম। সুদহার নীতি এক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারত। একক বিনিময় হার নির্ধারণ প্রয়োজন। আমদানিকারকদেরও এ নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এটির প্রয়োজনীতার কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ প্রবণতা আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। আশার কথা হলো বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য কমে আসছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে তা ভূমিকা রাখতে পারে।’
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন অস্থিতিশীল হওয়ার পাশাপাশি এর সঙ্গে অন্যান্য অনেক কারণ যুক্ত হয়ে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা অবস্থান করছিল উদ্বেগজনক অবস্থানে। এ সময় পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশে। আগের মাসে এর হার ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ।

বিদায়ী বছরে রেকর্ড আমদানি দায়ের পাশাপাশি বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। এ অস্থিরতা কাটাতে ২০২২ সালের পুরো সময় ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ সালের শেষ কর্মদিবসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর তা নেমে এসেছে ৩৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে। সে হিসেবে ২০২২ সালে রিজার্ভের ক্ষয় হয়েছে ১২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পরিসংখ্যান নিয়ে আপত্তি রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (্আইএমএফ)। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, রিজার্ভের হিসাব করতে হয় রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা অর্থকে বাদ দিয়ে। সে অনুযায়ী ইডিএফ ও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে দেশে এখন নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে।
রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকেও বিদায়ী বছরটি খুব একটা ভালো যায়নি বাংলাদেশের জন্য। আগের বছর বাড়ার পর ২০২২-এ এসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৯ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বরের হিসাব যুক্ত হওয়ার পরেও তা ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক মাত্রায় অবমূল্যায়নের কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। আবার অক্টোবরের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশমুখী শ্রমিকের সংখ্যা আগের বছরের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর পরেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়েনি। বরং বিদায়ী বছরে যেসব দেশে বেশি শ্রমিক গিয়েছেন, সেসব দেশ থেকেই রেমিট্যান্স কমেছে সবচেয়ে বেশি।

এর কারণ হিসেবে অর্থ পাচার ও হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, প্রবাসীদের বড় একটি অংশ এখন দেশে স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাতে ব্যাংকিং চ্যানেলের পরিবর্তে বেছে নিচ্ছেন অবৈধ হুন্ডি ব্যবস্থাকে। ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতার পাশাপাশি হুন্ডির বাজার জমজমাট থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় উৎসাহিত হচ্ছেন।
নগদ বা তারল্য সংকটের মধ্য দিয়ে বছর শেষ করছে দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংকগুলোয় এখন নগদ অর্থ যুক্ত হওয়ার তুলনায় বেরিয়ে যাচ্ছে বেশি। নগদ প্রবাহের এ ঘাটতি ব্যাংকগুলোর তারল্য ঝুঁকিকে বাড়িয়ে তুলছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৩ ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি নিট পরিচালন নগদ প্রবাহ (এনওসিএফএস) বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ১৮টিরই এনওসিএফএস ঋণাত্মক ধারায় নেমে এসেছে। সে অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখন নগদ প্রবাহের ঘাটতিতে ভুগছে।

ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, ২০২০ ও ২০২১ সালজুড়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় পেয়ে এসেছেন ঋণগ্রহীতারা। এখন আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে সামনে এনে ঋণ পরিশোধে নতুন ছাড় দেওয়া হয়েছে। বারবার ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড়ের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমছে। বিপরীতে বাড়ছে মেয়াদোত্তীর্ণ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ঋণপত্রের দায় সমন্বয়ের সময়সীমাও কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া নীতি ছাড়ের প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর নগদ প্রবাহে। ব্যাংকঋণ বাড়াতে না চাইলেও অসমন্বিত এলসি দায় ফোর্স লোন হয়ে মেয়াদি বিনিয়োগে রূপান্তর হচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতাও এখন ব্যাংকের নগদ প্রবাহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০২২ সালের শুরুতে আমদানি ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। খেলাপি ঋণ, মুদ্রা পাচার, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব এগুলো অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করেছে। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ছড়িয়েছে বাংলাদেশেও। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা প্রভাবক আমাদের মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়। দ্রুত রিজার্ভ কমেছে। সব মিলিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টাকার বড় অবমূল্যায়ন হয়েছে দ্রুত। অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা অনেক বেশি। ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং করতে হবে। আশার কথা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন। সমস্যা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হলে অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসবে।
ডলার সংকটের মুহূর্তে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিদেশী উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৯৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশিতে, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২২ শতাংশ। বিপুল অংকের এ ঋণের ৭৩ শতাংশ সরকারের। বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত।
২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশী ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস রয়েছে। ২০২৪ সাল শেষে তা দাঁড়াতে পারে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের তৈরি করা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট মুভমেন্ট’ শীর্ষক প্রকাশনায় পূর্বাভাস দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২ সাল শেষে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ঠেকবে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে সরকার। তবে আগামী দুই বছর বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমতে পারে। এ সময়েও বাংলাদেশকে প্রতি বছর সুদসহ ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

এসব সংকটের কারণে ভারী শিল্পের উদ্যোক্তা ও ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ আমদানিকারকদের অনেকেই এখন প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। বিশেষ করে ভারী শিল্প খাতের জন্য বিষয়টি এখন বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে এমনিতেই উৎপাদন চালু রাখা নিয়ে বিপাকে উৎপাদনমুখী শিল্প খাত। তাদের এ বিপদকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে চাহিদামতো এলসি খুলতে না পারা ও নগদ অর্থ সরবরাহে ব্যাংকের ধীরগতি।
বেশ কয়েকটি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকাররা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ব্যবসায়ীদের এ বিড়ম্বনা না কাটলে অচিরেই অনেক শিল্প-কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ভারী শিল্পের অনেক উদ্যোক্তা তাদের উৎপাদন ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছেন। মজুদ কাঁচামাল দিয়ে ফিনিশড পণ্য উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও বেশ কয়েকটি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ মুহূর্তে উৎপাদন কার্যত বন্ধ রেখেছে। একসময় ভারী শিল্পের একেকটি এলসি ভ্যালু ১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠে যেত। বর্তমানে ১০ হাজার ডলারের বেশি এলসি খুলতে বাধা দিচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজারেও। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ। এখানকার আমদানিকারক, ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বেঁধে দেয়া দামের ওপর সারা দেশের পণ্যমূল্য ওঠানামা করে। প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনজনিত গুজবের কারণে বিক্রি হওয়া এসওর দাম কমছে। শীর্ষ আমদানিকারকদের অনেকেই পাইকারি পর্যায়ে সরবরাহ আদেশ (এসও) পেয়েও পর্যাপ্ত ঋণপত্র খুলতে পারছে না। এমন খবরে এখন খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে বা মেঘনা গ্রুপের বিক্রি করা ভোগ্যপণ্য ভবিষ্যতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয় নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন ব্যবসায়ীরা।

তথৈবচ দশা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেরও। বাজার অস্থিতিশীলতা ও ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে জ্বালানি পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। কয়লা ও জ্বালানি তেলের চাহিদামাফিক আমদানি চালু রাখার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানামুখী সংকট। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রেই এখন উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ কমে বিপাকে পড়েছে শিল্প খাত। প্রয়োজনীয় গ্যাসের চাপ না থাকায় দেশের কোনো শিল্পাঞ্চলের উৎপাদনমুখী বৃহৎ গ্রাহকরা এখন কারখানা লে-অফের কথাও ভাবছেন।

যদিও অর্থনীতিতে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব সরকার ভালোভাবে সামাল দিয়েছে বলে মনে করছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘বছরটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে অর্থনীতির সব সূচকে পুনরুত্থান ঘটবে বলে আশা ছিল। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর ঢেউ এসে পড়ে আমাদের ওপরও। যুদ্ধ ও মূল্যস্ফীতি আমাদের অর্থনৈতিকভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। টাকার অবমূল্যায়ন অবধারিতই ছিল। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছি আমরা। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছি। নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রফতানি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কিছুটা কমলেও সেখানে হুন্ডির প্রভাব থাকতে পারে। রিজার্ভ এখন যে অবস্থায় রয়েছে তা স্থিতিশীল। অন্যদিকে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে, যা অর্থনীতির সক্রিয়তাকেই নির্দেশ করে। নতুন কোনো সংকট তৈরি না হলে আগামী বছর আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে আশা করছি।’

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *