চা: বৈশ্বিক ইতিহাস

চা: বৈশ্বিক ইতিহাস

প্রথম কাপ চা আমার ঠোট আর গলাকে চুম্বন করে গেল,

দ্বিতীয় কাপ আমার একাকীত্বের বেদনার দেওয়াল চূর্ণ করে দিলো,

তৃতীয় কাপ চা আমার আত্মার অলিগলিতে পাঁচ হাজার পুঁথির গল্প খুঁজে বেড়ালো,

চতুর্থ কাপে অতীত অবিচারের সব জ্বালা জুড়িয়ে গেলো,

পঞ্চম কাপ যেন আমার রক্তমাংস পবিত্র করে দিলো,

ষষ্ঠ কাপ শেষে মনে হলো, আমি অমর,

সপ্তম কাপ নিয়ে এলো অসহ্য সুখ,

বিশুদ্ধ বাতাস এসে আমার ডানায় লাগল,

আমি উড়ে চললাম পেংলাই এর পানে

-লু টং

চীনারা চা পান করে ছোট্ট কাপে, জাপানিরা বানায় আচ্ছা করে নেড়ে। আমেরিকায় চা আসে বরফের সাথে। তিব্বতিয়রা চায়ে মাখন মেশায়। রাশিয়ানরা মেশায় লেবু। উত্তর আফ্রিকায় চায়ে পুদিনা দেওয়া হয়। আফগানিরা দেয় এলাচ। ভারতীয়রা ঘন দুধে চা জ্বাল দেয়। অস্ট্রেলিয়ায় আবার ‘বিলি ক্যানে’ চা জ্বাল করা হয়।

চিরসবুজ গুল্মজাতীয় Camellia sinensis-এর শুকনো পাতা গরম পানিতে মিশিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়, সারা দুনিয়ার লাখ লাখ লোক চা পান করে। বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়ের তালিকায় চায়ের স্থান দ্বিতীয়, প্রথম স্থানে আছে পানি। চা তৃষ্ণা নিবারণ করে, রোগ ভাল করে এবং সুস্থ রাখে। এটা আনন্দের জন্য পান করা হয়, পান করা হয় স্বাস্থ্যের জন্যও। যেখানে যেভাবেই পান করা হোক, চা মঙ্গল, সম্প্রীতি, ভদ্রতা, বন্ধুত্ব¡ আর আতিথেয়তা নিয়ে আসে। চীনে কিংবদন্তীতুল্য শুরু থেকে বর্তমান জনপ্রিয়তা, চায়ের এক দীর্ঘ আর প্রাণবন্ত ইতিহাস রয়েছে। চায়ের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্ম ও আচার, এডভেঞ্চার আর ব্যবসা, চোরাচালান ও বিপ্লব, সাহিত্য ও সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস।

চায়ের ইংরেজি নাম Tea শব্দটি চাইনিজ শব্দ ‘টে’ থেকে এসেছে। ওলন্দাজ, যারা সর্বপ্রথম ফুজিয়ান প্রদেশের আময় বন্দর থেকে ইউরোপে চা আমদানি করে, তারা এটাকে ‘থি’ নামে ডাকত। সেখান থেকে ইংরেজিতে Tea শব্দের প্রচলন হয়। Tea-এর মান্দারিন প্রতিশব্দ হলো, ‘চা’, যা বাংলার অনুরূপ। এখান থেকেই বিভিন্ন ভাষায় চায়ের নাম এসেছে, ভারত, আফগানিস্তান, ইরান আর রাশিয়ায় এটা ‘চায়ে’, আরবিতে ‘সাই’, জাপানি ভাষায় বলে ‘ওচা’।

প্রথমদিকে স্বাস্থ্য ভালোরাখার জন্য একে গুরুত্ব দেওয়া হলেও পরবর্তীতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আবিস্কার করেন যে, চা পান করলে ধ্যানের লম্বা সময় জেগে থাকা যায়। জাপানিরা চাকে ‘ওচা’ নামে ডাকে, যার অর্থ সম্মানিত চা,  জাপানিদের চা নিয়ে ধর্মীয় আচার পালনের ইতিহাসও রয়েছে।

একেবারে শুরুর দিকে চা প্রাচীন কাফেলার পথ ধরে পরিবহন করা হতো দূরে, অনেক দূরের আর দুর্গম এলাকাতেও বিপনন করা হতো। চা কীভাবে পশ্চিমে এলো? আমরা ঘুরে আসব চা বাগান আর টি হাউজে। দেখব চা নৃত্য। কীভাবে ব্রিটিশ ‘আফটারনুন টি’-এর প্রচলন হলো। আটলান্টিকের ওপারে দেখা পাব বিখ্যাত বোস্টন টি পার্টির, যেটি আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। জানব কীভাবে ‘আইসড টি’ আর টি ব্যাগের আবিস্কার হলো। জানব সাম্প্র্রতিককালের চায়ে আর বাবল টি ট্রেন্ড সম্পর্কেও।

ভারতে কীভাবে চা গাছ পাওয়া গেলো, আর কীভাবে ভারত চীনের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হলো। কীভাবে চা ব্রিটিশ শাসনের সময়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিল, কীভাবে ভারতীয়রা ইরানি ক্যাফেগুলোতে চা পান করত। আর এখন যখন আর্জেন্টিনা থেকে জিম্বাবুয়ে পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের চায়ের চাষাবাদ হয়, এখন এটা কীভাবে পান করা হচ্ছে, আমরা সেটাও জানার চেষ্টা করব। কীভাবে সব কিছুর শুরু হলো? এই বই সেই গল্পই বলবে।

হেলেন সাবেরির ‘Tea: A Global History’ থেকে অনূদিত। অনুবাদ: সালাহউদ্দিন

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *