রানি এলিজাবেথের সিংহাসনে ৭০ বছর

রানি এলিজাবেথের সিংহাসনে ৭০ বছর

নারী ডেস্ক: রানি এলিজাবেথের পুরো নাম আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। তিনি ছিলেন ইয়র্কের ডিউক এবং ডাচেসের প্রথম সন্তান। তিনি যে এক সময় রানি হবেন একথা খুব কম লোকই তখন ধারণা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে তাঁর চাচা ৮ম এডওয়ার্ড দুবার তালাকপ্রাপ্ত এক আমেরিকান নারী ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেন। ১৯৩৭ সালে এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজার আসনে বসেন। এলিজাবেথ হন ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। বয়স ১৮ পেরোনোর পর যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ পাঁচ মাসের মতো সময় অক্সিলিয়ারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে কাজ করেন এবং মোটর মেকানিক হিসেবে বুনিয়াদি জ্ঞান ও ড্রাইভিংয়ের দক্ষতা অর্জন করেন।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অদ্ভুত একটি দিনে জীবনটা বদলে যায় সেই রাজকন্যার। সুদূর কেনিয়ায় বসে সেদিন শোনেন পিতা ব্রিটিশ রাজ ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুসংবাদ। সেই দুঃখ-ভারাক্রান্তহৃদয়ে সেদিনই তিনি জেনে গিয়েছিলেন রানি হওয়ার সংবাদ। ২৭ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালের ২ জুন রাজকুমারী এলিজাবেথকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে গির্জায় ব্রিটেনের রানির মুকুট পরানো হয়েছিল। ২ কোটিরও বেশি টিভি দর্শক এই অনুষ্ঠান দেখেছিলেন, যাছিল সে সময়ের একটি রেকর্ড। এরপরের দশকগুলোতে দেখা গিয়েছিল বিশাল সব পরিবর্তন- বিদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান এবং ‘সুইং গিং সিক্সটি’ নামে পরিচিত ‘৬০-এর দশক, যে সময়ে ব্রিটেনের পুরনো সব সামাজিক নিয়ম-কানুন ভেসে গিয়েছিল। পরিবর্তনের হাওয়ায় রানি এলিজাবেথ মনোনিবেশ করেন রাজতন্ত্রের সংস্কারে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এবং নানাধরনের রাজকীয় পরিদর্শনে। কমনওয়েলথের প্রতি তাঁর ছিল অবিচল অনুরাগ। অন্তত একবারের জন্য হলেও তিনি প্রত্যেকটি কমনওয়েলথ রাষ্ট্র পরিদর্শন করেছিলেন। এলিজাবেথের দাম্পত্য সঙ্গী হলেন প্রিন্স ফিলিপ, ডিউক অব এডিনবারা। তিনি গত বছর মারা গেছেন। তাদের চার সন্তান রয়েছে- চার্লস, অ্যানি, অ্যান্ড্রু এবং এডওয়ার্ড। ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজসিংহাসনে আসীন ছিলেন রানি এলিজাবেথ। ব্রিটেনের হাজার বছরের ইতিহাসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ দীর্ঘসময় সিংহাসনে থাকার রেকর্ড গড়েছেন। সিংহাসনে তাঁর সত্তর পেরিয়ে গেছে। এর আগের রেকর্ডটি রানি ভিক্টোরিয়ার। ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত ৬৪ বছর রাজত্ব করেন ভিক্টোরিয়া। রানি বিশ্বের ১৬টি সার্বভৌম রাষ্ট্র, অর্থাৎ কমনওয়েলথ রাষ্ট্রগুলোর বর্তমান রানি ও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। কমনওয়েলথ-প্রধান ছাড়াও তিনি ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট কমনওয়েলথ অব নেশনসেরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুক্তরাজ্যের শাসনকর্তা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডেরও প্রধান ছিলেন। সুদীর্ঘ সাত দশক প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থেকে রানি এলিজাবেথ মানুষের কল্যাণে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা আর বার্ধক্যের কাছে হার মেনে অবশেষে ৮ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান রানি। ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসন অলংকৃত করে রাখা দ্বিতীয় এলিজাবেথের বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। কয়েকমাস আগেই তাঁর সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর উদযাপন করা হয়েছিল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। হাঁটা চলা ও দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর সমস্যা হচ্ছিল।

ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ তাঁর শাসনামলে দুবার বাংলাদেশে এসেছেন। প্রথমবার এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আমলে। দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে। তাঁর প্রথম সফর ছিল ১৯৬১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রানির রাজকীয় বিমান নেমেছিল পুরনো বিমানবন্দরে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। রমনা পার্কের সামনে একটি পুরনো বাড়ি সাজানো হয়েছিল রানির জন্য। সেই বাড়িটি বর্তমানে বঙ্গভবন। ১৩ ফেব্রুয়ারি রানি বের হয়েছিলেন স্টিমারে বুড়িগঙ্গা ভ্রমণে। ভ্রমণশেষে রানি গিয়েছিলেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল পরিদর্শনে। এরপর চট্টগ্রামে সার্কিট হাউসে এক নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেন রানি। সেসময় তাঁকে গভর্নর হাউসে সংবর্ধনা দেওয়া হয় ও আতশবাজি পোড়ানো হয় রাতের ঢাকায়। গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান রানিকে পুরনো বিমানবন্দর অর্থাৎ তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। ১৯৮৩ সালে চারদিনের সরকারি সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন রানি। সেসময় তিনি বাংলাদেশের গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বৈরাগীরচালা গ্রাম দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে গ্রামীণ নারীদের অবস্থান দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। রানির আগমন উপলক্ষ্যে ওই গ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ওই এলাকায় কল-কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করে। রানি তাঁর সফরে ঢাকা থেকে ট্রেনে গাজীপুরের শ্রীপুর, পরে সেখান থেকে গাড়িতে করে বৈরাগীরচালায় যান।

বিশ্ব সেদিন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিল ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথের নিভৃত পল্লীর মানুষের মিছিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার অনন্য দৃশ্য।

editor

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *